সাঈদুর রহমান রিমন, ঢাকা অফিস:
ঘটনার দিন ৩১ জুলাই বিকেল ৪ টার আগেই মেজর সিনহা (অব.) তার সহযোগী ডিডিওগ্রাফার সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে নিয়ে টেকনাফ থানায় গিয়ে ইয়াবা বিষয়ক ওসি প্রদীপের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করেই নোয়াখালীপাড়ার কোবরা বাজার হয়ে নারিসবুনিয়া পাহাড়ে যান। মেরিন ড্রাইভওয়ে ঘেষা কোবরাবাজার ও সংলগ্ন কথিত ‘মালয়েশিয়ান বন্দর’ এলাকায় অন্তত দুই ঘন্টা কাটানোর পর পাহাড়ে উঠে তারা টাইম ল্যাপস শর্ট নিয়েছেন। সেখানে কোনো বাগানবাড়ী যাওয়ার কথা স্বীকার না করলেও সিফাত ইলিয়াস কোবরার মালিকানাধীন বাজার এলাকায় বেশ কিছুটা সময় অবস্থান নেওয়ার কথা জানিয়েছেন।
গত সোমবার দুপুরে কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে সিফাত মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর যেসব সদস্য তার নিরাপত্তা দেখভাল করছেন তাদেরই একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। সিফাত মুক্তির একদিন আগে রোববার শিপ্রা দেবনাথ জেল থেকে ছাড়া পান। উভয়েই তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একত্রেই কক্সবাজার এলাকায় অবস্থান করছেন। গত ৩১ জুলাই রাতে সিনহা নিহতের ঘটনার পর পুলিশের করা মামলায় গ্রেফতার হয়ে কক্সবাজার কারাগারে ছিলেন বেসরকারি স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথ।
সূত্রটি জানায়, নির্দ্দিষ্ট তদন্তকারী সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে ১৬১ ধারায় জবানবন্দী দেয়ার আগে সিফাত ও শিপ্রাকে মামলা বিষয়ক কোনো বক্তব্য, বিবৃতি বা ফেসবুক স্ট্যাটাস না দেয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে পরিবার পরিজনের সঙ্গে কক্সবাজারে অবস্থানকালে সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সদস্যদের প্রশ্নের জবাবে সিফাত থানায় যাওয়া, ইয়াবা সংক্রান্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণ, ‘ইলিয়াস কোবরার বাজার’ এলাকায় বেশ কিছু সময় কাটানোসহ নারিসবুনিয়ার পাহাড়ে ওঠার কথা জানিয়েছেন। তবে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার তদন্তকারী সংস্থা র্যাব কর্মকর্তারা গতকালই শিপ্রা ও সিফাতের সঙ্গে বেশ সময় নিয়ে কথা বলেছেন। তবে তাদের এ বক্তব্যই ১৬১ ধারায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে কি না তা কেউ নিশ্চিত করেননি।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্ভরযোগ্য সূত্রটি আরো জানায়, শামলাপুর চেকপোস্টে মেজন সিনহাকে হত্যা ও সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে আটক করার সময় ওসির নির্দেশে গাড়িটি তল্লাশি করা হয় এবং ল্যাপটপ, ক্যামেরা ও মোবাইল সরিয়ে ওসির নোহা গাড়িতে নিয়ে তোলা হয়। বাকি ট্রাইপডসহ অন্যান্য জিনিসপত্র চেকপোস্টের ইনচার্জ লিয়াকত আলীর জিম্মায় জমা থাকে।
এ ব্যাপারে থানা সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের মামলায় সিনহা রাশেদ ও সিফাতের কাছ থেকে ২১ রকমের আলামত জব্দ দেখানো হয়েছে। এগুলো হলো একটি বিদেশি পিস্তল, পিস্তলর কাভার, ৯ রাউন্ড গুলি, ৫০ পিস ইয়াবা, ২৫০ গ্রাম গাঁজা, মানিব্যাগ, দুটি পরিচয়পত্র, দুটি মোবাইল ফোন, একটি ব্লুটুথ ডিভাইস, ছুরি, স্ক্রু ডাইভার সংবলিত ছুরি, দুটি কালো রঙের মাস্ক, একটি ক্যানন ব্রান্ডের ডিএসএলআর ক্যামেরা, ৯টি ডিস্কের একটি ডিসি বক্স, একটি সেনাবাহিনীর ক্যাপ, একটি গাড়ির ম্যানুয়াল বই, দুটি কাঁধের ব্যাগ, একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, তিনটি ব্যাংকের ভিসা কার্ড, একটি মাস্টার কার্ড এবং সিলভার রঙের এলিয়ন গাড়ি। তবে জব্দকৃত ডিএসএলআর ক্যামেরার মেমোরি কার্ড, দুটি পেন ড্রাইভ ও মেজর সিনহার ব্যবহৃত উচ্চ রেজুলেশনের ভিডিও রেকর্ডারযুক্ত ঘড়িটির কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। জব্দ তালিকায় মেমোরি কার্ড, পেনড্রাইভ ও ঘড়ির ব্যাপারে কিছু উল্লেখও করা হয়নি।
স্বজন ও তদন্তকারীরা বলছেন, হত্যা মামলার আসামি পুলিশ সদস্যরা সিনহার কাছে থাকা ক্যামেরা ও ল্যাপটপে স্পর্শকাতর বা গোপনীয় কিছু থাকলে তা সরিয়ে নিয়েছেন বা এরইমধ্যে তা নষ্ট করেছেন। সিফাতের খালু মাসুম বিল্লাহ বজানিয়েছেন, ‘সিফাতের সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র কোথায় আছে তা এখনো জানা যায়নি।’ তবে মেজর (অব.) সিনহার তিন সহকর্মির মধ্যে পুলিশের কাছ থেকেই ছাড়া পাওয়া তাহসিন ইতিমধ্যেই সাংবাদিকদের কাছে জানিয়েছেন, ঘটনার দিন তাদের রিসোর্ট থেকে দুটি কম্পিউটার, হার্ডডিস্ক ও ক্যামেরার সরঞ্জাম নিয়ে যায় পুলিশ। অথচ পুলিশের জব্দ তালিকায় সেগুলোর কিছুই উল্লেখ নেই।
প্রসঙ্গত, গত ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাতে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ রোডে টেকনাফের বাহারছড়া চেকপোস্টে তল্লাশির সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পরিদর্শক লিয়াকত আলী, ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ নয়জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।