
জাতীয় ডেস্ক: ভূমিহীন, দুস্থ ও গরিব মানুষের আশ্রয়ের জন্য সরকারিভাবে নির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো দীর্ঘদিন ধরে মেরামত না করায় সেগুলো বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। বছরের পর বছর ধরে এসব ঘর জীর্ণ হয়ে ঘরের চাল ফুটো হওয়া ও বেড়া খুলে পড়ায় অনেকে এখন আর এখানে থাকতে নিরাপদবোধ করছেন না। বারেবারে সরকারি কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও সমাধান না পেয়ে অসহায় মানুষগুলো রয়েছেন চরম দুর্ভোগে। এদিকে, সরকারি কর্মকর্তাদের দাবি, জরাজীর্ণ আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো মেরামতের জন্য মন্ত্রণালয়ে পত্র পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ এলে পুনর্নির্মাণ বা নতুন করে নির্মাণের কাজ করা হবে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, জেলায় প্রায় ৬শ’রও অধিক ভূমিহীন, দুস্থ ও গরিব পরিবার রয়েছেন দুর্ভোগে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব ঘর নতুন করে নির্মাণ করা হবে বলে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে।
দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার চিরিরবন্দর গ্রামে অবস্থিত রেলব্রিজ আশ্রয়ণ প্রকল্প। ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলে প্রায় ৩ একর জায়গার ওপরে ৩টি ব্যারাকে মোট ৩০টি পরিবারের জন্য এখানে ঘর নির্মাণ করা হয়। নির্মাণ করা হয় ১২টি শৌচাগার, ৬টি গোসলখানা। এছাড়া সুপেয় পানির জন্য বসানো হয় ৩টি নলকূপ। তবে এরপর দীর্ঘ প্রায় ২১ বছর ধরে এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাঠামোতে কোনও ধরনের সংস্কার করা হয়নি। ফলে একসময়ের নতুন ঘর তার জৌলুস হারিয়েছে ধীরে ধীরে, ঘরের টিন পুরনো হতে হতে জং পড়ে মরিচা ধরে ফুটো হয়ে গেছে, শৌচাগার ও গোসলখানাগুলো এখন ব্যবহারের অনুপযোগী এবং টিউবওয়েলগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টি আসলেই এসব টিনের ফুটো দিয়ে ঘরের মধ্যে পানি পড়ে, বিছানা-বালিস ও আসবাবপত্র সব ভিজে যায়। এমন অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে তারা টিনের ওপরে পলিথিন দিয়ে কোনোরকমে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। এমন দুর্ভোগের জীবন সহ্য করতে না পেরে ইতোমধ্যেই ৪টি পরিবার অন্যত্র বসবাস করছেন বলেও জানিয়েছেন তারা।
এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারী প্রায় ৭০ বছর বয়সী জহরা বেওয়া বলেন, ‘ঘর-বাড়ি ভাঙ্গি গেইছে, ভাল করিবা পারো না (ভালো করতে পারি না), একখান বাঁশও কিনিবা পারো না। চাইয়া চুইয়া খাও, তার উপর অসুস্থ। টিনদি ভুল হই গেইছে, মাঝিয়াত (মেঝেতে) পানি পড়ে, থাকিবা পারো না। সেইদিন অল্প পানিতে বিছানা ভিজি গেইছে, আরমি ঘরের কাছত চাইয়া টিনের উপর পলিথিন দিছু।’
এখানে বসবাসকারী হাসনা বানু নামের আরেক নারী বলেন, ‘আমরা ঘর বাড়িতে থাকিতে পারি না। এতদিন হয়ে গেছে, ছবি তুলে ভিডিও করে নিয়ে গেছে কিন্তু কোনও কাজ হয় নাই। আমরা অতিদরিদ্র, কাজ করি খাই। একটু যদি থাকার ব্যবস্থা ভালো করে দিতো তাহলে আমাদের সুবিধা হতো।’
এলাকার শরিফ উদ্দিন বলেন, ঘর হওয়ার ১৫ বছর আগে থেকেই এখানে আছি। পরে ঘর পেয়েছি, অনেক দিন থেকেছি কিন্তু এখন আর থাকার উপযোগী না। যদি সরকার এই ঘরগুলো ঠিক করে না দেয় তাহলে আর থাকা যাবে না। অন্যদের মতো আমাদেরকেও চলে যেতে হবে।
একই অবস্থা বিরল উপজেলার ধামইর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর ঋষিপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের। ২০০০ সালের দিকে গড়ে ওঠা এই আশ্রয়ণটির অবস্থা এখন একেবারেই নাজুক।
স্থানীয়রা জানান, ওই সময় বাঁশের তৈরি চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে এবং ওপরে টিন দিয়ে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক ঋষি সম্প্রদায়ের মানুষজনের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিল এই আশ্রয়ণের বাড়িগুলো। প্রতিটি ঋষি সম্প্রদায়ের পরিবারকে বরাদ্দ দেয়া হয় ৮ শতক করে জমির ওপর দুটো করে ঘর। এছাড়া ছিল টিউবওয়েল, শৌচাগার। কিন্তু দীর্ঘদিন হয়ে যাওয়ায় ঘরের টিনে মরিচা পড়ে ফুটো হয়ে গেছে।
বাশের চাটাইও ভেঙে গেছে। এরপরে নিজ উদ্যোগে বসবাসকারীরা মাটির ঘর তৈরি করলেও ২০১৭ সালের বন্যায় অধিকাংশ ঘর ভেঙে যায়। এখন এক প্রকারে অসহায় অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন এসব পরিবারের লোকজন।
এলাকার খুশিলাল ঋষি বলেন, ‘আমরা কৃষি কাজ করি। বাড়িঘর এমন হয়েছে কিন্তু কেউই আমাদের দিকে তাকায় না। সরকার বাড়িঘর করে দিয়েছে তা ভেঙে গেছে। এখন আবার নিজে উপার্জন করে বাড়িঘর করেছি। আমাদেরকে ৮ শতক করে জমি দিয়েছে। সরকার বাড়িঘর করে দেক এটাই আমরা চাই।’
পলাশ ঋষি বলেন, ‘হামরা দিন মাঠে মুজুরি করি খাই। সরকার আমাদের দিকে তাকায় না। বাড়িঘর ভেঙে গেছে, ১০ টাকা জোগাড় করে বাড়ি ঠিক করবো এই ক্ষমতা আমার নাই। আমরা গরিব মানুষ, যেন ঠিকভাবে বসতবাড়িতে থাকতে পারি এটাই আমরা চাই।’
এলাকার বীণা ঋষি বলেন, ‘আগে চাটাইয়ের ঘর আর টিনের চালা ছিল। এলা কামাই করি যা তা খাইতে চলি যায়। এখনও সরকার থাকি কেউ আসে নাই। কামাই করে খাওয়ার পাশাপাশি টিন, বাঁশসহ অন্যকিছু কিনে কিনে ঘর দিচ্ছি।’
জানতে চাওয়া হলে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দায়িত্ব পাওয়া দিনাজপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা এবিএম আকরাম হোসেন বলেন, আমি নতুন এসেছি। এজন্য বিষয়টি তেমনভাবে আমার জানা নেই। তবে এসব আশ্রয়ণের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে।
সদ্য বিদায়ী দিনাজপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান বলেন, দুর্ভোগে রয়েছেন এমন পরিবারগুলোর তালিকা পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। গত বছরের আগস্ট মাসে মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প কর্মকর্তা জেলা পরিদর্শন করেছেন এবং সবার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওই সময় স্যারকে বিষয়টি অবহিত করা হলে তিনি জানিয়েছেন যে, নতুন ডিপিপি তৈরি করে এসব ঘর নতুন করে তৈরি করা হবে। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে যারা বসবাস করছেন তাদেরই এইসব মেরামত করে নেওয়ার কথা। নতুন ডিপিপি করে ঘর নির্মাণের চিন্তা রয়েছে।
জেলায় প্রতিটি উপজেলায় এই রকম জরাজীর্ণ অবস্থায় ২ থেকে ৮টি কিংবা ১০টি পর্যন্ত ব্যারাক রয়েছে। প্রতি ব্যারাকে রয়েছে ১০টি করে পরিবার। ১৯৮৬ সাল থেকে এসব ব্যারাক নির্মাণ হয়ে আসছে। ৮৬ থেকে ৯০ দশকে যেসব ব্যারাক হয়েছে সেসব নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করেছে। ওইসব এলাকার জনগণও আমাদেরকে বিষয়গুলো জানিয়েছে। প্রতি উপজেলায় গড়ে প্রায় ৫০ থেকে ৬০টি করে পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছেন বলে জানান তিনি।