
আকরামুল ইসলাম: দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা সাতক্ষীরা। পর্যটনকে ঘিরে এ জেলার রয়েছে সম্ভাবনা। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের একটা বৃহৎ অংশ রয়েছে এ জেলায়। রয়েছে নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন ও স্থাপনা। এছাড়া সুন্দরবনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে নানা পর্যটন কেন্দ্রগুলোও আকৃষ্ট করে পর্যটকদের।
বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশ অভ্যন্তরে বাকি ৩ হাজার ৯৮৩ বর্গকিলোমিটার পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অভ্যন্তরে। বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনকে পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগ নামে ভাগ করা হয়েছে। বাগেরহাট ও বরিশাল অংশ পূর্ব বন বিভাগ আর খুলনা ও সাতক্ষীরার অংশ পশ্চিম বন বিভাগ নামে পরিচিত।
সাতক্ষীরার জেলার আয়তন ৩৮৫৮.৩৩ বর্গকিলোমিটার। এরমধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশই বনাঞ্চল। আর জেলার মধ্যে সুন্দরবন রয়েছে ১৪৪৫.১৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে। সুন্দরবন ঘেষে সাতক্ষীরার অবস্থান হওয়ায় সড়কপথ দিয়েই সুন্দরবন দেখা যায়। ভ্রমন পিপাসু মানুষরাও সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র ও প্রাকৃতিক সৌন্দার্য দেখতে প্রবেশ করেন সুন্দরবনে।
একদিকে হিং¯্র রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কুমির, বানর, হরিণসহ বিভিন্ন পশুপাখিদের সমাহার। অন্যদিকে, বনের গভীর নিরবতা খুব সহজেই পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
এছাড়া সুন্দরবন ঘিরে গড়ে ওঠা পর্যটন কেন্দ্রগুলো এখন আকর্ষন করে পর্যটকদের। সুন্দরবনকে ঘিরে গড়ে উঠা পর্যটন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছে, কলাগাছিয়া ইকো ট্যুরিজম সেন্টার, দোবেকী ইকো ট্যুরিজম সেন্টার, ক্যারাম মুরা ম্যানগ্রোভ ভিলেজ, ক্যারাম মুরা পাখি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র, আকাশলীনা ইকো ট্যুরিজম, মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত, আদিবাসী গ্রাম, নৌকা ভ্রমণ সাইট ও শিয়ালকুনি বনায়ন, কৈখালী সীমান্ত ও পাঁচ নদীর মোহনা। যা পর্যটকদের কাছে সুন্দরবনকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
সাতক্ষীরা শহরের মুনজিতপুর এলাকার মৃত. শওকতা আলীর ছেলে আব্দুল্লাহ্ আল মাহফুজ। ২০১৫ সাল থেকে সুন্দরবন ভ্রমন করেছেন সাতবার। সুন্দরবনকে নিয়ে তিনি বলেন, সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র ও প্রকৃতি আমাকে কাছে টানে যার কারণেই ২০১৫ সাল থেকে সাতবার গিয়েছি। সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের আওতাধীন কটকা, কাচিখালি, কালিরচর, দুবলারচর, ডিমেরচর, হাড়বাড়িয়া, মান্দারবাড়িয়া, বঙ্গবন্ধু দ্বীপ ঘুরেছি। চোঁখে পড়েছে অজগর, হরিণ, শুকোর, বিভিন্ন ধরণের পাখি, ডলফিন, হাজার হাজার বানর, লাল কাকড়া। তবে আমি এখনো বাঘ দেখতে পায়নি।
তিনি বলেন, সরকারি যদি পর্যটকদের জন্য সুবিধা বাড়ায় তবে পর্যটক আরও বাড়বে। সুন্দরবনকে ঘিরে পর্যটন শিল্পের দারুন সম্ভাবনা রয়েছে। আমি মনে করি সুন্দরবনের দেখভালের বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে সরকারকে। সুন্দরবনের মধ্যে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও জেলেদের বিষ দিয়ে মাছ ধরতে দেখেছি। এটা বন্ধ করতে হবে। বিষ দিয়ে মাছ ধারার কারণে সুন্দরবনের পরিবেশ নষ্ট হয়। স্পট কেন্দ্রগুলোতে ট্রলারযোগে পৌঁছালেও পর্যটক নামার ব্যবস্থা নেই। কাঁদামাটি বা পানিতে নেমে স্পটে নামতে হয়। জেলেরা সুন্দরবনে গিয়ে হরিন শিকার করে এগুলোও কঠোরভাবে আইন প্রয়োজ করে বন্ধ করতে হবে।
তিন বার সুন্দরবন ভ্রমন করেছেন সাতক্ষীরা শহরের মুনজিতপুর এলাকার মুক্তিযোদ্ধা হাবলুর রহমানের ছেলে ব্যবসায়ী শান্ত। একই এলাকার ব্যবসায়ী আলামিন হোসেনও ভ্রমন করেছেন দুইবার। তারাও অভিযোগ করেন, পর্যটন স্পট কেন্দ্রগুলোতে ট্রলারযোগে পৌঁছালেও পর্যটক নামার ব্যবস্থা নেই। কাঁদামাটি বা পানিতে নেমে স্পটে নামতে হয়।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের সাতক্ষীরা-খুলনা অংশের বন কর্মকর্তা বশিরুল আল মামুন জানান, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ ভ্রমন করেছেন ৬২ হাজার ৮৯০ জন পর্যটক। এর মধ্যে দেশী পর্যটক ৬২ হাজার ৭২২ জন ও বিদেশী ১৬৮ পর্যটক। রাজস্ব আহোরিত হয়েছে ৯১ লক্ষ ৫০ হাজার ২১৫ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৭১ হাজার ৫১৪ জন পর্যটক। এরমধ্যে দেশী ৭১ হাজার ২১৪ জন পর্যটক ও বিদেশী ৩২৭ জন। রাজস্ব হয়েছে ৮৮ লক্ষ ৭৪ হাজার ৬৬৪ টাকা। এছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে সুন্দরবন ভ্রমন করেছে ৭০ হাজার ৪৬৫ জন পর্যটক। এর মধ্যে দেশী পর্যটক ৭০ হাজার ২৮০ জন ও বিদেশী পর্যটক ১৮৫ জন। রাজস্ব হয়েছে ৭৩ লক্ষ ৮৬ হাজার ৬৫৭ টাকা।
তিনি জানান, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১০ হাজার ৭৮৮ জন পর্যটক সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ ভ্রমন করেছেন। এরমধ্যে দেশী পর্যটক ১০ হাজার ৬৫২ ও বিদেশী ১৩৬ জন। রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৫ লক্ষ ৮৮ হাজার ১৫৮ টাকা।
পশ্চিম সুন্দরবনকে নিয়ে পর্যটকদের জন্য বিশেষ কোন পরিকল্পনা রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে বন কর্মকর্তা বশিরুল আল মামুন বলেন, সুন্দরবনের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য প্রজেক্ট তৈরী করে পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে। যেটি এখন অনুমোদনের অপেক্ষায়। এটা অনুমোদন হলে সুন্দরবনের মধ্যের অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাড়বে। এছাড়া প্রজেক্টটির মধ্যে পশ্চিম বনবিভাগের কলাবগি ও শেখেরটেক নামক এলাকায় নতুন করে দুইটি পর্যটন স্পট তৈরী করা হভে। প্রজেক্টটি অনুমোদন হলে সুন্দরবনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন বাড়বে তেমনি পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে।
তিনি বলেন, এছাড়া সুন্দরবনের মধ্যে বিষ দিয়ে মাছ শিকার বা হরিণ শিকারের বিষয়ে সুনিদৃষ্ট তথ্য থাকলে অবশ্যই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে পর্যটকদের কাছে অনুরোধ থাকবে এমন দৃশ্য সামনে এলে তাৎক্ষনিক বিষয়টি বনবিভাগকে অবহিত করার।
বন সংরক্ষক দফতর খুলনা সার্কেলেরে বন সংরক্ষক মো. মঈনুদ্দনি খান বলেন, সুন্দরবন একটি বিশ্ব ঐতিহত্য। এখানকার জীব বৈচিত্র রক্ষা ও প্রাকৃতিক সোন্দার্য বাড়ানোর লক্ষ্যে ইতোমধ্যে দুইটা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি সুন্দরবনে পরিবেশ বান্ধব পর্যটন সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্প, অপরটি সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্প। সুন্দরবনের তীরবর্তী ৩৫ লাখ মানুষ সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। তাদের জীবন ও জীবিকায়নের জন্য সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পের মধ্যে কাজ করা হবে। যাতে করে সুন্দরবনের উপর চাপ না পড়ে। এছাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট না হয়।
তিনি আরও বলেন, সুন্দরবনে পরিবেশ বান্ধব পর্যটন সম্প্রসারন প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে সুন্দরবনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও নতুন পর্যটন কন্দ্রে স্থাপন। এর মধ্যে দুইটি পশ্চিম বন বিভাগ ও দুইটি পূর্ব বন বিভাগের মধ্যে করা হবে। এছাড়া বন্যপ্রাণী পাচার রোধ, টেলিকমনিকেশন উন্নয়ন করা, ইকোট্যুরিজম সুবিধা বাড়ানো। বর্তমানে পর্যটকদের জন্য সুন্দরবনে ইকোট্যুরিজম সুবিধা নেই। আমরা এ সুবিধা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। পর্যটন হিসেবে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন যে সম্ভাবনার জায়গা সেই সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে। পর্যটকদের জন্য ইকোট্যুরিজম সুবিধা বাড়ানো গেলে একদিকে যেমন পর্যটক বাড়বে অন্যদিকে, সরকারও রাজস্ব বেশী পাবে।