
নিজস্ব প্রতিবেদক: সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ফিংড়ি ইউনিয়নের বুড়ামারার খাল ওই এলাকার তিনটি ইউনিয়নের ৩০টি গ্রাম ও ১৩টি বিলের পানি নিস্কাশনের একমাত্র পথ। দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর যাবত এই খালের মাঝে অসংখ্য নেট-পাটা. বাঁধ দিয়ে পানি নিস্কাশন বন্ধ করে সেখানে মাছ চাষ করছে এলাকার প্রভাবশালীরা। পানি নিস্কাশনের পথ বন্ধ থাকার কারণে বুড়ামারা বিলসহ আশপাশের ১৩টি বিলের প্রায় ২০ হাজার একর জমিতে কোন ধরনের ফসল ফলাতে পারছে না এলাকার কৃষকরা। এনিয়ে কোন অভিযোগ দিলে অভিযোগকারীকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোসহ নানা হুমকী-ধামকি দেয়া হচ্ছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন ৭ অক্টোবরের (চলতি মাসের) মধ্যে জেলার সব খাল-বিলের অবৈধ নেট-পাটা উচ্ছেদের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি জারি করলেও বুড়ামারার খাল বা বিলে বহাল তবিয়তে প্রভাবশালীরা মাছ চাষ করে যাচ্ছে। যেনো দেখার কেউ নেই। আর নেট-পাটা অপসরণ বিষয়ে স্থানীয় তহশিলদার মিজানুর রহমান বলছেন ‘নেট-পাটা পাজা করে আমি কি শুয়ে থাকবো, ওরা সরকারি খাল দখর করে নিলে আমার কি করার আছে ?’
সোমবার সকালে সরেজমিন বুড়ামারার খাল ও বিল ঘুরে দেখা গেছে অসংখ্য নেট-পাটা, বাঁধ-এর কারণে পানি নিস্কাশন হচ্ছে না। ফলে ওই এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। বিলের মধ্যে অথৈ পানি। দখলদাররা এতোটাই প্রভাবশালী যে, কোন মানুষ দখলদারদের নাম পর্যন্ত উচ্চারন করতে সাহস পাচ্ছে না। তারা বলছে “ ওদের নাম বললে আপনারা চলে যাওয়ার সাথে সাথে আমাদের বাড়িতে হামলা করবে, আমাদের নামে হয়রানিমূলক মামলা হবে, রাস্তা-ঘাটে আমাদের ধরে অপমান করবে,মারপিট করবে। আমরা এলাকায় বসবাস করতে পারবো না’। এলাকাবাসী জানায়, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ফিংড়ি, ধুলিহর ও বক্ষ্ররাজপুর ইউনিয়নের বুড়ামারা বিল, কচুর বিল, ডেঘুর বিল, বেনিখালী বিল, চেনার বিল, জোড়দিয়া বিল, বেউলা বিলসহ আশপাশের ১৩টি বিলের পানি নিস্কাশনের বর্তমানে একমাত্র চ্যানেল আমদখালী স্লইজগেট। এই স্লুইজগেট দিয়ে আশপাশের ১৩টি বিলের পানি বেতনা নদীতে নিস্কাশন হয়ে থাকে। এক সময় ফিংড়ি স্লইজগেট দিয়ে মরিচ্চপ নদীতে পানি নিস্কাশন হতো। কিন্তু মরিচ্চপ নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় ফিংড়ি স্লুইজগেট দিয়ে আর পানি নিস্কাশন হয় না। যে কারণে এখন একমাত্র ভরসা আমদখালি স্লুইজগেট। কিন্তু নেট-পাটার কারণে ওই স্লুইজগেট পর্যন্ত পানি পৌছাচ্ছে না।
স্থানীয় গাভা গ্রামের আব্দুল ওয়াদুদ সরদার (৬৮), একই গ্রামের সরোয়ার আজাদ (৭৩) জানান, ফিংড়ি, ধুলিহর ও বক্ষ্ররাজপুর ইউনিয়নের ৩০টি গ্রাম এবং গ্রাম সংলগ্ন ১৩টি বিলের পানি নিস্কাশনের চ্যানেল আমদখালি স্লুইজগেট। এই স্লুইজগেট দিয়ে এলাকার পানি বেতনা নদীতে নিস্কাশন হয়ে থাকে। এক বছর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্ল-গোল্ড প্রকল্পের আওতায় আমদখালি খাল খনন করেছে। খাল খননের ফলে দীর্ঘ ১৬ বছর পর কিছু এলাকায় এবার ধান চাষ হলেও জলাবদ্ধতার করণে প্রায় ২০ হাজার একর জমিতে কোন ধরনের ফসল ফলানো সম্ভব হয়নি। এসব জমি পতিত পড়ে আছে। তারা বলেন, বুড়ামারার খালে অসংখ্য নেট-পাটা ,বাঁধ দিয়ে প্রভাবশালীরা সেখানে মাছ চাষ করছে। ফলে এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।
গবরদাড়ি গ্রামের রিপন হোসেন (৪০), সর্বকাশেম পুর গ্রামের মোজাম্মেল হক মোড়ল (৫৫) জানান, ‘গত প্রায় ১৬ বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে আমাদের গ্রাম পানিতে তলিয়ে যায়। বাড়ি-ঘরে, উঠানে পানি ওঠে। বিলে কোন ধরনের ফসল ফলাতে পারছি না। চারিদিকে পানি আর পানি। স্থানীয় কয়েক জন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতারা খালে নেট-পাটা দিয়ে মাছ চাষ করছে। ফলে পানি আমদখালি স্লুইজগেট পর্যন্ত যাচ্ছে না। সারাবছর ধরে বিলে পানি জমে থাকছে। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের মরণ ছাড়া আর কোন উপায় দেখছি না। সরকারি খালে যে একটু মাছ ধওে জীবিকা নির্বাহ করবো সে উপায়ও নেই। সরকারি খাল যারা দখল করে আছে তারা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের স্থানীয় নেতা-কর্মী । এদের বিরুদ্ধে কথা বললেই তারা বাড়িতে গিয়ে হামলা, মামলা, হয়রানি করছে। ওদের ভয়ে এলাকার কোন মানুষ প্রতিবাদও করতে সাহস পায়না’।
খোঁজ নিয়ে যানাগেছে, ফিংড়ি, গাভা, হাবাসপুর, কুলতিয়া, সুলতানপুর, সর্বকাশেরপুর, জোড়দিয়া, ব্যাংদহ, বালিথা, এল্লারচর, শিমুল বাড়িয়া, জি-ফুলবাড়িয়া, চাঁদপুর, ধলিহর, বক্ষ্ররাজপুরসহ ওই এলাকার ৩০টি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ বর্ষা মৌসুমে পানি নিস্কাশন না হওয়ায় চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিনাতিপাত করে। সোমবার সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে গ্রাম গুলো এখনো পানি ছুঁই ছুঁই।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল গত ৭ অক্টোবরের মধ্যে জেলার প্রতিটি খাল, বিল, জলাশয় থেকে নেট-পাটা, বাঁধ অপসরনের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেন। এর কয়েকদিন আগে তিনি সাতক্ষীরার সব নদী-খাল-জলাশয়ের একসনা লীজ / ইজারা বাতিল ঘোষনা করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেন। গণবিজ্ঞপ্তি জারির পর প্রায় দুই সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও বুড়ামারার খালের নেট-পাটা, বাঁধ এখনো অপসারন হয়নি। বহাল তবিয়তে সরকারি ওই খালে নেট-পাটা দিয়ে বন্ধ করে প্রভাবশালীরা মাছ চাষ করছে।
এ ব্যাপারে ফিংড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শামছুর রহমান বলেন, ‘সরকারি লোকজন কিছুদিন আগে এলাকায় গিয়ে নেট-পাটা অপসরণ করেছে শুনেছি। কিন্তু তার পরেও কিছু কিছু এলাকায় নেট-পাটা থাকতে পারে। তিনি বলেন, বিল থেকে নদী উচুঁ হয়ে যাওয়ার কারণে আসলে পানি নিস্কাশন হচ্ছে না। নেট-পাটা পানি নিস্কাশনের তেমন একটা বাঁধা নয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিগত দিনে আওয়ামী লীগের যেসব নেতা-কর্মী জামাত শিবিরের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত তারাই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ওই খালে নেট-পাটা দিয়ে সেখানে মাছ চাষ করছে’।
ফিংড়ি ইউনিয়নের তহশিলদার মিজানুর রহমান বলেন, ‘গত ৩০ সেপ্টেম্বর ৮/১০ জন লোক নিয়ে বুড়ামারার খালের নেট-পাটা অপসারণ করে দেয়া হয়েছে। এর পর কি হয়েছে তার আর খবর রাখি না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি তো নেট-পাটা পাজা করে শুয়ে থাকবো না, আমার তো অন্য কাজ আছে ..। তিনি উল্টো প্রশ্ন রেখে বলেন ‘আমি চলে আসার পর তারা আবার খাল দখল করে নিলে আমার কি করার আছে ? সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের নির্দেশ উপেক্ষিত হচ্ছে কি-না জানতে চাইলে তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘আরে ভাই উনি নির্দেশ দিলে কি হবে। উনি তো জানেন না আমাদের কতো কাজ করতে হয়। নির্দেশ দিলেই কি সব কিছু হয়’।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, ‘অবৈধ দখলদাররা যতই প্রভাবশালী হোক না কেনো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। জনবল সংকটের কারণে সব এলাকায় এখনো পৌছানো সম্ভব হয়নি। বুড়িমারা বিলে তহশিলদারের অভিযানের পর আবারও কিভাবে নেট-পাটা বসানো হলো তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শিঘ্রই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’। এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক সকলের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন।