সিরাজুল ইসলাম শ্যামনগর সাতক্ষীরা প্রতিনিধি। বাঘের ভয়, সাপের ছোবল, কুমিরের ও বনদস্যূ দের অপহরণ মুক্তিপণের কারনে আয় কমে যাওয়া—এমন নানা কারণে সুন্দরবনের বনজীবীরা এখন অন্য কাজ চান।
পশ্চিম সুন্দরবন সংলগ্ন নলিয়ান বাজার এলাকার ষাটোর্ধ্ব রসূল মিয়া বলেন, “ছোট ভাই কালাম শিকারিকে বাঘে নিয়েছে সাত বছর আগে। ছোট ভাইয়ের পরিবারকে সেই থেকে আমাকেই দেখতে
আমি নিজেও বাঘের সামনে পড়েছি একাধিকবার। ডাকাতদের অস্ত্রের আঘাতে দুটি দাঁত হারিয়েছি। বিকল্প কাজ নেই বলে এটাই করতে হচ্ছে।” সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবন উপকূলের মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের সিংহত্তলী গ্রামের আজিজ ৬৫ মজিবর 57 আনসার ৬৫ মোতালেব ৪০ কাওসার ৬৫ মান্নান ২৭ আদম ৫৫ সাইফুল ৪৮ রুহুল আমিন ৫৫ হরষিত ৪৫ বিনয় ৩৭ বুড়ি গোয়ালিনী ইউনিয়নের ধাতিনাখালী গ্রামের শওকত ২২ মনসুর ৪৮ মিজানুর ৩০ সাকাত ২২ আমিনুর ৪০ জিয়াউর ৫৫ গাবুরা ইউনিয়নের চাঁদনী মুখা গ্রামের আনোয়ার ৩০ রহিম ২৭ রেজাউল ৪০ আনসার ৪২ জাবেদ আলি ৫৫ বাকের আলি ৩০ মনিরুজ্জামান ৩৭ বাক্কার ৩০ এরা সবাই পেশায় বনজীবী তারা এই প্রতিবেদককে জানান দীর্ঘ ৩ মাস সুন্দরবনে মাছ কাঁকড়া আহরণ করতে যেতে পারে না বনদস্যুদের কারণে। সুন্দরবনে প্রবেশ করলে বাঁকে বাঁকে বনদস্য দল ওত পেতে বসে আছে অপহরণ আর মুক্ত পনের জন্য একজনকে অবহেলা করতে পারলে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকার নিচে মুক্তি মেলেনা এই টাকা এই টাকা বনজীবীদের কাছে দেওয়া মোটেই সম্ভব না উল্লেখিত ব্যক্তিদের মধ্য অনেকেই ভাটায় গিয়েছিল নতুন মানুষ কাজ বোঝনা তাই আবার অনেকেই ফিরে এসেছে অনেকের ঘাড়ে এনজিওরিনীর বোঝা চেপে গিয়েছে প্রতিদিন এনজিও কর্মীরা বাড়ি বাড়ি হাঁটছে দিনের কিস্তি নেওয়ার জন্য। তাছাড়া বনে গেলে বন বিভাগের কর সরকারের রাজস্ব বনে বাঘ সাপ নদীতে কুমির তাই তারা সরকারের কাছে বিকল্প পেশা চান। সুদি মহলের অভিমত বনজীবীদের বিকল্প পেশার একমাত্র ব্যবস্থা উপকলীয় অঞ্চলে গার্মেন্টস মিল কল কারখানা গড়ে তুলে বনজীবীদের সেই পেশায় নিয়ে যাওয়া উত্তম।
নলিয়ান বাজারটি খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালি ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত।
রসূল মিয়া ওই এলাকায় রসুল শিকারি বলে পরিচিত।
তিনি বলেন, জমিজমা নেই। নলিয়ান বাজারের লঞ্জঘাটের পাশে বেড়িবাঁধের ওপর ঘর তুলে থাকেন। নদীভাঙন আর আইলা-আম্পানে কয়েক দফায় ঘর ভেঙেছে তার।
ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে থেকে এই কাজ শুরু করেন বলে তিনি জানান।
রসুল বলেন, বন বিভাগ থেকে পাস মিললে নৌকায় তিনজনের দলে সাত দিনের জন্য মাছ ধরতে যান বনে। এ সময় পাঁচ-ছয় হাজার টাকার মাছ পাওয়া যায়। এতে সংসার চলে না। সুন্দরবনে সারা বছর মাছ ধরার সুযোগ পেলে জীবীকা চালানো সহজ হত।
পশ্চিম সুন্দরবনের কালাবগী এলাকার বাসিন্দা খুলনার দাকোপ উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি বাসুদেব রায় এই পেশাজীবীদের জীবন-জীবিকার প্রত্যক্ষদর্শীতিনি বলেন, অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বনে গিয়েও বনজীবীদের সারা বছর সংসার চালিয়ে নেওয়ার মত অবস্থা হচ্ছে না। বনের মাছ কমে গেছে, আগের মতো মধু পাওয়া যাচ্ছে না, গোলপাতা-গরান কাটা বন্ধ। এসব কারণে অধিকাংশ বনজীবীর বনে যেতে আগ্রহ দিন দিন কমছে।
নলিয়ান বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে জেলে-বাওয়ালীদের ছোট-বড় নৌকা, মাছ ধরার জাল, ড্রাম, দড়ি ইত্যাদি। এ এলাকার বেশির ভাগ মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। বনে মাছ-কাঁকড়া, চিংড়ির পোনা ধরে, মধু আহরণ করে, গোলপাতা কাটাসহ বিভিন্ন কাজে যুগ যুগ ধরে জীবিকা চলছে তাদের।
ওই এলকার সাংবাদিক আবুল বাশার বলেন, সুন্দরবনের নদী-খালে মাছ শিকার, বনের মধু ও গোলপাতা আহরণ করে এসব মানুষের জীবিকায়ন হয়ে থাকে।
বাশার বলেন, সুন্দরবনে মাত্র চার-পাঁচ মাস কাজ করতে পারেন বনজীবীরা। এতে পরিবার-পরিজন নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। ছোটবেলা থেকে বনের বিভিন্ন কাজে পারদর্শী হয়ে ওঠে এ এলাকার শিশুরা। লেখাপড়া শেখার জন্য বিদ্যালয়ে যাওয়ার চেয়ে বনে গিয়ে বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে ধরাটা তাদের যেন নিয়তি।
“জলবায়ু পরিবর্তনে সুন্দরবনের সম্পদ আহরণে প্রভাব পড়েছে। আগে একবার বনে গেলে যে পরিমাণ মাছ পাওয়া যেত, এখন সারা বছরেও তা মেলে না। অন্যান্য সম্পদও কমে গেছে। তাছাড়া বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনৈতিক সুবিধা আদায় এবং হয়রানি তো রয়েছেই।”
বাজারের কাছেই বাড়ি ২০ বছর বয়সী আলামিন ফকিরের।
তিনি বলেন, তার বাবা জামাল ফকির খুলনায় রিকশা চালান।
“আমি স্থানীয় মহাজনের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে মধু আহরণের পাস নিছিলাম এক মাস চার দিনের জন্য। দলে ছিলাম ১০ জন। প্রত্যেকে প্রায় চার মণ করে মধু পেয়েছি। তবে পাস নিতে এবং মধু আহরণকালে বনে যেসব ঝুঁকিতে পড়তে হয়েছে, তা এই মধুর দামের তূলনায় সামান্য।”
আলামিন বলেন, আগামী মধু আহারণ মৌসুম পর্যন্ত আর তেমন কোনো কাজ নেই তার।পশ্চিম সুন্দরবনের দাকোপ উপজেলার কালাবগী এলাকার বাসিন্দা সালাম মোল্লা নামে স্থানীয় একজন মহাজন বলেন, তিনি প্রায় দুই যুগ ধরে সুন্দরবনের সম্পদ আহরণের সঙ্গে জড়িত। প্রতিবছরই বৈধ পাস নিয়ে সুন্দরবনে যান। বর্তমানে এ ব্যবসায় সুবিধা হচ্ছে না।
নানা প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সুন্দরবনে যেতে বনজীবীদের এখন আগ্রহ কম। তারা এখন বিকল্প কাজ চান। জলবায়ু পরিবর্তনে সুন্দরবনের সম্পদ আহরণে প্রভাব পড়েছে। আগে সুন্দরবনে যে পরিমাণ মাছ-কাঁকড়া পাওয়া যেত, এখন তা মিলছে না। অন্যান্য সম্পদও কমে গেছে। তাছাড়া পাস নিতে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়।
তবে হয়রানি ও অনৈতিক সুবিধা আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পশ্চিম বিভাগের বন কর্মকর্তা মো. নুরুল করিম। এই প্রতিবেদক কে বলেন, সুন্দরবনের আশপাশের এলাকায় অভাবী মানুষদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন সুন্দরবন। পাস নিয়ে মাছ, মধুসহ বিভিন্ন সম্পদ আহরণের সুযোগ তাদের আছে। তবে লক্ষ করা যাচ্ছে, বনে আসা বনজীবীদের সংখ্যা আগের চেয়ে কমেছে। বিশেষ করে বাওয়ালিদের সংখ্যা আগের চেয়ে অর্ধেকে নেমে এসেছে।
তবে বন এর সুফল পাচ্ছে বলে নুরুল করিম জানান।
তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের প্রবেশ সীমিত এবং বনের ভেতরে নদ-নদীতে ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল কম থাকায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যে পরিবর্তন এসেছে। বনে এখন সুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। বন্যপ্রাণীর দল নতুন পরিবেশে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান খুলনার সুন্দরবন অ্যাকাডেমির নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কাদির বলেন, আগের চেয়ে সুন্দরবনে বনজীবীদের সংখ্যা কমে আসছে দুটি কারণে। প্রথমত পাস পেতে ঝক্কি-ঝামেলা এবং বন বিভাগের কড়াকড়ি আরোপ। দ্বিতীয়ত, সুন্দরবনের সম্পদ কমে যাওয়া। এ কারণে দিন দিন সুন্দরবনের সম্পদ আহরণে বনজীবীদের আগ্রহ কমছে।
কাদির বলেন, তাছাড়া একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন তাদের রক্ষা করায় এক প্রকার সচেতনতা তৈরি হয়েছে। সংরক্ষিত এই বনের কোনো সম্পদেরই ক্ষতি চান না তারা।
সরকার সুন্দরবনের বনজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় কিছু বনজীব অন্য পেশায় যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।
গবাদিপশু ও হাঁসমুরগি পালন, মাছ চাষ, সবজি চাষসহ বিভিন্ন পেশায় তাদের ফেরানোর চেষ্টা চলছে।
বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার জয়মনি গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ আবু ছায়েদ বলেন, তিনি বনের নদী-খালে মাছ শিকার করে জীবিকা চালাতেন।
“আমার বাড়ির পাশে যে এলাকায় মাছ শিকার করতাম সে এলাকাটি ডলফিনের অভয়ারণ্য। ওই এলাকায় সরকার মাছ শিকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। বনবিভাগ আমাকে ৪০ হাজার টাকা নগদ অর্থ সাহায্য করায় আমি মাছ শিকার ছেড়ে এখন একটি ছোট মুদি দোকান দিয়েছি। আমি এখন আপাতত মাছ শিকার বন্ধ রেখছি।”
ওই এলাকার ফজলু হাওলাদারও (৫৫) এই প্রকল্পের আওতায় সহায়তা পেয়েছেন বলে জানান।
তিনি বলেন, “সরকার আমাকে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছে। আমি সেই টাকার সঙ্গে আরও কিছু লাগিয়ে নসিমন কিনে গ্রামের রাস্তায় চালাই।”
মোংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও চাঁদপাই রেঞ্জের সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য মো. অলিয়ার রহমান বলেন, ২০১০ সালে এই প্রকল্প চালুর পর থেকে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল জেলে, বাওয়ালি, মৌয়ালসহ নানা পেশাজীবীর তালিকা তৈরি করে। সেই তালিকা ধরে অসংখ্য সচেতনতামূলক সভা করা হয়েছে।
“তাদের বোঝানো হয় যে, সুন্দরবন আমাদের সুরক্ষা দেয়। সুন্দরবন না থাকলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে আমাদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। সুন্দরবনের ক্ষতি হয় এমন কোনো কর্মকাণ্ডে তারা জড়িত হবে না বলে অঙ্গীকার করে। সচেতনতামূলক সভা ছাড়াও সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীলদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য গবাদিপশু, হাঁসমুরগি পালন, মাছ চাষ, সবজি চাষ, সেলাই মেশিন, ব্যাটারি ও ইঞ্জিন চালিত যান চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে অনেককে তা বিতরণ করা হয়েছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়।
বিকল্প পেশা চান সুন্দরবনের বনজীবীরা
পূর্ববর্তী পোস্ট