অনলাইন ডেস্ক: গ্রাহকের কাছে মনেই হবে এটা কোনও কাস্টমার কেয়ারের নম্বর। হুবহু ডিজিট। অপর প্রান্তের ব্যক্তিকে বিশ্বাস করে গ্রাহক দিয়ে দিচ্ছেন তার মোবাইল ব্যাংকিং কিংবা ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডেও গোপন সব তথ্য। পরে প্রতারকরা হাতিয়ে নিচ্ছে গ্রাহকের সকল অর্থ। তবে র্যাব বলছে, নম্বর এক হলেও প্রতারকদের কলের ক্ষেত্রে সাধারণত নম্বরের আগে ‘প্লাস চিহ্ন’ থাকে।
সম্প্রতি কিছু অভিযোগের তদন্তে এমনটাই বেড়িয়ে এসেছে। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে রাজধানী এবং ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকা থেকে র্যাব-২ এবং র্যাব-৮ এর যৌথ অভিযানে এই চক্রের ১৩ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন,র্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম।
রবিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সারওয়ার বিন কাশেম জানান, গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে ১৪ লাখ ৮৩ হাজার ৪৬২ টাকা, ৩১টি মোবাইল ফোন, দুটি ল্যাপটপ, দুটি ট্যাব, ১২০টি সিম, একটি রাউটার এবং একটি টিভি কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা হলো, নাজমুল জমাদ্দার (১৯), হাসান মীর (১৮), ইব্রাহিম মীর (১৮), তৌহিদ হাওলাদার (২৩), মোহন শিকদার (৩০), পারভেজ মীর (১৮), সোহেল মোল্যা (২৬), দেলোয়ার হোসেন (৩৫), সৈয়দ হাওলাদার (২০), রাকিব হোসেন (২৪), মোহাম্মদ আলী মিয়া (২৬), পলাশ তালুকদার (৩৪), ইমন (২৫)।
লে. কর্নেল সারওয়ার বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে মানুষের বাইরে যাওয়া এড়াতে মোবাইল ব্যাংকিং কিংবা ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন বেড়েছে। আর এ সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে প্রতারক চক্র। বেশকিছু অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত সাপেক্ষে এই চক্রের ১৩ সদস্যকে আটক করা হয়, যারা প্রত্যেকেই প্রাথমিকভাবে এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।
একজন মাস্টারমাইন্ডের অধীনে ৩০-৩৫ জন সদস্য কাজ করেন জানিয়ে তিনি বলেন, সাধারণত ৫ টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে এ কার্যক্রম সম্পন্ন করে থাকে চক্রটি। প্রথমত, চক্রের ‘হান্টার টিমের’ সদস্যরা মাঠপর্যায়ে গ্রাহকদের তথ্য সরবরাহ করে থাকে। তারা বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা, মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের নম্বর সংগ্রহ করে মাস্টারমাইন্ডদের সরবরাহ করে।
দ্বিতীয় ধাপে ‘স্পুফিং টিমের’ সদস্যরা কাস্টমার কেয়ার নম্বর কিংবা ব্যাংক কর্মকর্তার নম্বর ক্লোন করে। এর ফলে প্রতারকরা যখন গ্রাহকদের টার্গেট করে ফোন দেয়, তখন হুবহুম সংশ্লিষ্ট নম্বরটি দেখতে পায়। এতে গ্রাহকরা সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে অনেক উচ্চশিক্ষিতরাও ফাঁদে পা দিচ্ছেন। প্রতিটি নম্বর স্পুফিং বা ক্লোন করতে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা পায় এই টিমের সদস্যরা।
তৃতীয় ধাপে সবচেয়ে প্রধান কাজটি করে থাকে ‘কাস্টমার কেয়ার’ টিমের সদস্যরা। তারা ১৫-২০ জন একসঙ্গে একটি রুমে বসে কথাবার্তা বলে একটি সত্যিকারের কাস্টমার কেয়ার সেন্টারের আবহ তৈরি করে। গ্রাহককে ফোন দিলে আশে-পাশের নয়েজের মাধ্যমে তাকে বিভ্রান্ত করা হয়।
চক্রের মাস্টারমাইন্ড নিজেই দলটি পরিচালনা করেন। তারা কাস্টমার কেয়ার কর্মকর্তা সেজে কৌশলে গ্রাহকের কাছ থেকে গোপন পাসওয়ার্ড কিংবা ভেরিফিকেশন কোডসহ বিভিন্ন তথ্য নিয়ে থাকেন। সঙ্গে থাকা অন্যকেউ অ্যাপসের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করে অর্থ হাতিয়ে নেয়। এজন্য তারা নির্জন কোন চর বা গাছপালা ঘেরা নিরাপদ জায়গা বেছে নেয়।
চতুর্থ ধাপে ‘টাকা উত্তোলন’ টিমের সদস্যরা গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ ট্রান্সফারের পর পর দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা এজেন্টদের মাধ্যমে নগদ টাকা উঠিয়ে নেয়। যেসব ব্যালেন্স উত্তোলন করা সম্ভব হয় না, সেসব দিয়ে বিভিন্ন কেনাকাটা করে নেয় তারা।
শেষ ধাপে ‘ওয়াচম্যান’ টিমের সদস্যরা স্থানীয়ভাবে ছোটখাট দোকান চালানোর কাজে সম্পৃক্ত। যারা এলাকায় নতুন কোন আগন্তুক কিংবা সন্দেহভাজন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সন্দেহ হলে মাস্টারমাইন্ডকে খবর দেন। তারা ঘণ্টাভিত্তিক বা চুক্তিভিত্তিক কাজ করে থাকেন।
প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দলের মাস্টারমাইন্ড নিজের জন্য ৫০ ভাগ, সহযোগীদের জন্য ৩০ ভাগ, হান্টার টিমকে ২০ ভাগ এবং স্পুফিং টিমকে নম্বরপ্রতি এক-দেড় হাজার টাকা কিংবা কথা বলার সময়ের ভিত্তিতে টাকা প্রদান করে থাকে। এছাড়া, লটারি জেতার কথা বলেও সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলো তারা।
আটকদের মধ্যে ৯ জনই মাস্টারমাইন্ড উল্লেখ করে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, আটক মোহন গত ২ মাসে প্রায় এক কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে উপার্জন করেছে বলে জানতে পেরেছি। একটি গ্রুপকে আমরা ধরতে পেরেছি। সারা দেশে এমন ৪-৫ টি গ্রুপ সক্রিয় থাকতে পারে, যাদেরকে গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
গ্রাহকদের নম্বর হাতিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এই চক্রের সঙ্গে মোবাইল ব্যাংকিং কিংবা ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা জড়িত কি-না খতিয়ে দেখা হবে বলেও জানান তিনি।
সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, নম্বর স্পুফিং বা ক্লোন করায় গ্রাহকরা হুবহু সংশ্লিষ্ট নম্বর থেকেই ফোন পাবেন। ফোন করে অ্যাকাউন্ট বাতিল, স্থগিত বা সিস্টেম আপগ্রেডের কথা বলে তথ্য, পিন বা ভেরিফিকেশন কোড জেনে নিয়ে অ্যাকাউন্ট নিয়ন্ত্রণে নেয়। কিন্তু প্রতারকদের স্পুফিং নম্বরের আগে সাধারণত ‘প্লাস চিহ্ন’ থাকে। উদাহরণস্বরূপ কোন কাস্টমার কেয়ারের নম্বর যদি ‘১২২১’ হয়, তাহলে প্রতারকদের দেওয়া ফোন কলে নাম্বার হবে ‘+১২২১’। সূত্র: ইত্তেফাক