
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন: ২
বিশেষ প্রতিনিধি:
বিগত কয়েক মাস ধরে চলা এই অনুসন্ধানে একটি সমস্যা সংগ্রহ করার সময় বেরিয়ে আসতে থাকে নানান জাল-জালিয়াতির চিত্র। যা রীতিমত ভয়াবহ। যে সব বিষয়ে হর-হামেশা আলোচনা চলে কলেজে। কলেজের আয়া,পিয়ন,দারোয়ান, অপিহ স্টাফ,শিক্ষক-কর্মচারির মুখেমুখে এসব অনিয়ম, জাল-জালিয়াতি ও প্রতারনার কাহিনী।
একক নামে চলছে কলেজের ব্যাংক একাউন্ট
নাম না প্রকাশ করার শর্তেএকাধিক সূত্র জানিয়েছেন, অধ্যক্ষের ব্যক্তিগত একক স্বাক্ষরে চলে বেশ কয়েকটি ব্যাংক একাউন্ট। কলেজের প্রতিটি হিসাব পরিচালিত হওয়ার কথা সভাপতি সহ অধ্যক্ষের যৌথ স্বাক্ষরে। কিন্তু জানা গেছে কিছু একাউন্ট ব্যক্তিগত একক নামে পরিচালিত হয়।
যে কারনে যেকোন সময় অকাতরে হরহামেশা টাকা উত্তোলন করা হয়। এমনও অভিযোগ উঠেছে কলেজের এফডিআরও ব্যক্তিগত একক নামে করা হয়েছে। বিষয়টি কলেজের অনেকেই জানেন। আলোচনাও করেন, কিন্তু সরাসরি মুখ খোলেন না কেউ। কলেজের আয় ব্যায়ের হিসাব পরীক্ষা করলে সব বেরিয়ে আসবে। গভর্নিং বডির উচিৎ বিষয়টি খতিয়ে দেখা।
অভ্যন্তরীন আয়-ব্যায়ে অনিয়ম
কলেজের অভ্যন্তরীন পরীক্ষা,ছাত্র/ছাত্রীদের কাছ থেকে নেয়া প্রশ্নপত্র ফিস, ফরম পূরন সহ ছোট খাট আয়ের টাকা যা সাধারনত কলেজের সকল ষ্টাফ পেয়ে থাকেন। সেটা কাউকে না দিয়ে বা সামান্য অংশ দিয়ে অধ্যক্ষ নিজেই পকেটস্থ করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু কোন ফল আসেনি। প্রতিবছর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোচিং এর নামে, জরিমানা ও লেট ফির নামে আদায়কৃত টাকা, যার কোন ডকুমেন্ট রাখা হয় না, তা অকাতরে নিজের পকেটে ঢ়ুকান। চলতি উচ্চ মাধ্যমিক পরিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোচিং এর নামে চার লক্ষাধিক টাকা আদায় করা হয়। কিন্তু যারা কোচিং এর ক্লাস নিয়েছিলেন,তাদেরকেও কোন টাকা না দিয়ে সম্পূর্ণ টাকা লুটপাট করেছেন অধ্যক্ষ নিজেই। একটি সূত্র জানিয়েছে, এখান থেকে না-কি কলেজের একজন প্রভাবশালী শিক্ষককে এক লক্ষ টাকা দিয়েছেন।
এছাড়া কলেজের অভ্যন্তরীন পরীক্ষার খাতা সহ অব্যবহৃত কাগজপত্র ও অব্যবহুত দ্রব্য সামগ্রী বিক্রয় করে ফান্ডে জমা না দিয়ে নিজেই পকেটস্থ করেন।
অভিনব কায়দায় ডোনেশন আদায়
নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ও এমপিও ভুক্ত শিক্ষকদের কাছ থেকে ১০ থেকে ২০ লক্ষ টাকা আদায় করা হয়। যিনি তাৎক্ষনিক টাকা দিতে পারেন না,তাকে রুপালী ব্যাংকে অগ্রিম একাউন্ট খুলিয়ে অধ্যক্ষ নিজ উদ্যোগে সার্ভিস লোনের ব্যবস্থা করেন। লোনের টাকা ঘুষ বাবদ নিয়ে নেন। এবংতার কাছ থেকে চেকের পাতাও নেন। নতুন এমপিও ভুক্ত শিক্ষকদের অনেকে এ ব্যাপারে মুখ খুলতে চাননা। তিনি বলেন,আমার চেকের পাতা দেওয়া আছে। ডোনেশনের টাকা শোধ না হওয়া পর্যন্ত কোন কথা বলা যাবে না।
কলেজের উন্নয়নে টাকা সংগ্রহের নামে ভ্রমন
কলেজের গর্ভনিং বডির স্বনামধন্য ১জন সদস্য, বিশিষ্ট সমাজসেবক, ব্যবসায়ীর কাছ থেকে জমি নিবেন বলে, তার মাছের ঘেরে ভ্রমন করেন। এসময় তিনি মাইক্রোবাস ভাড়াকরে কয়েকজন শিক্ষককে নিয়ে (পঞ্চ-পান্ডব নামে খ্যাত) ওই সদস্যদের ঘেরে যান। এসময় যাতায়াত ও অন্যান্য খরচ বাবদ অফিস থেকে ৫০ হাজারটাকা তুলে নেন। কিন্তু সেখান থেকে কোন জমি পাওয়া যায়নি। এভাবে বিভিন্ন সময়ে নানান ওছিলা করে ফান্ডের টাকা নয়-ছয় করা হয়।
সব কারনেই টাকা
কলেজে ঢুকলেই টাকার কথা ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। যখন তখন বলা হয়, অমুক উর্দ্ধতন কর্মকর্তাকে টাকা দিতে হবে বলে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কাছ থেকে, এমপিও ভুক্ত শিক্ষকদের কাছ থেকে, এমন কি উচ্চতর স্কেল প্রাপ্তীয় সময়েও নানা অযুহাতে টাকা সংগ্রহ করা হয়।
কোথায় পুরাতন রেজুলেশন ও শিক্ষক হাজিরা খাতা?
একজন অধস্তন কর্মচারী জানান, কলেজের পুরাতন রেজুলেশন খাতার কোন খবর নেই। এমন কি হাজিরা খাতাও। সাম্প্রতিক ১৪/১৫ জন শিক্ষকের এমপিও ভুক্ত করার সময় তাদের ব্যাক ডেটে নিয়োগ দেখাতে হয়। এসব শিক্ষকের প্রকৃত নিয়োগ ২০১২ সালের পর। কিন্তু নতুন এসব শিক্ষকের নিয়োগ দেখাতে হয়েছে ২০১০ সালের আগে। সে সময় কলেজের অধ্যক্ষ ও সভাপতি সহ গভর্নিং বডির সদস্যের অধিকাংশ বর্তমান কমিটিতে নেই। ফলে জাল-জালিয়াতি করার জন্য ওই দুটো খাতা সামনে আনা হয় না। সেটা আসলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।
সার্টিফিকেটেও জালিয়াতি
নতুনভাবে এমপিও ভুক্ত করার সময় বয়সসীমা ঠিক রাখার জন্য অনেক শিক্ষকের নিবন্ধন সার্টিফিকেট স্ক্যান করে সাল তারিখ বদলে দেয়া হয়। এসব নিয়োগে রেজুলেশন তৈরি,ফরওয়াডিং,নিয়োগপত্র তৈরিতে তদানিন্তন সভাপতি-অধ্যক্ষের স্বাক্ষর প্রয়োজন। অভিযোগ উঠেছে ঐসব স্বাক্ষরেও জালিয়াতি ও প্রতারনার আশ্রয় নেযা হয়েছে। এমনকি সাম্প্রতিক সময়েও স্বয়ং সভাপতির স্বাক্ষর জালিয়াতের অভিযোগ পাওয়া গেছে জেলা শিক্ষা অফিস হতে।
একক কর্তৃত্বে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিনত প্রতিষ্ঠানটি
সাতক্ষীরা দিবা-নৈশ কলেজটি গড়ে উঠেছে কয়েকজন উদ্দমী শিক্ষিত যুবকদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায়। যারা নিজেদের অর্থ ও শ্রম দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন প্রয়াত আব্দুল মোতালিবের নেতৃত্বে। সেসব শিক্ষকের মধ্যে অনেকেই অবসরে গেছেন। অনেকে ২/৩ বছরের মধ্যে অবসরে যাবেন। এসব সিনিয়র শিক্ষকদের ভূমিকা অপুরনীয়। কিন্তু বর্তমান অধ্যক্ষ আসার পর থেকে এসব শিক্ষকদের কোন মুল্যায়ন করা হয় না। কোন সিদ্ধান্তের বেলায় একক সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত। এসব সিনিয়র শিক্ষকদের কোন প্রস্তাব আমলে আনা হয় না। তাদের সাথে সব সময় অসৌজন্যমূলক আচরন করেন। গভর্নিং বডিকে পাশ কাটিয়ে আবার নিষ্ক্রিয় ষ্টাফ কাউন্সিলকে এড়িয়ে ব্যাক্তিগত কর্তৃত্বের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে কলেজটি। একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিনত করেছেন কলেজটিকে। সিনিয়র কোন শিক্ষকই এসব বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। কেউ কেউ গভর্নিং বডি যদি নজরদারী না করে, তবে আমাদের কি করার আছে। এমন দৃশ্য দেখে দুঃখ করে একজন সিনিয়র শিক্ষক বলেন, আগে মনে করতাম, চাকুরি শেষে কলেজ ছাড়া থাকবো কিভাবে-আর বর্তমান দৃশ্য দেখে মনে হয় কবে চাকুরি শেষ হবে। এ’কটা বছর কিভাবে যাবে। এ মুহুর্তে সকলের দাবি কলেজটাকে সুষ্ঠুভাবে নিয়ম-নীতির মধ্য দিয়ে চলার ব্যবস্থা করা উচিৎ। এজন্য সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের হস্তক্ষেপ জরুরী।