
নিজস্ব প্রতিবেদক: সাতক্ষীরা জেলাব্যাপী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভয়ঙ্কর গ্রুপ কথিত ‘বেস্ট টিম সাতক্ষীরা’। আর এই বেস্ট টিম সাতক্ষীরার দুই কান্ডারি সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট শাহনেওয়াজ পারভিন মিলি ও তার স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান। তারা দুইজন জেলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে বাল্যবিবাহ বন্ধের নামে অর্থবাণিজ্য করে বেড়াচ্ছে এমন অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিন। এই টিমে মোস্তাফিজুর রহমান তার মোটর সাইকেলের পিছনে বয়ে নিয়ে বেড়ান কয়েকজন সুন্দরী নারীকে। এই চক্র সর্বশেষ অপকর্ম করতে যেয়ে গত ২৮ আগস্ট ২০২০ শুক্রবার জনরোষে পড়ে পালিয়ে ফিরেছে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার পরানদহা গ্রামের দরিদ্র আলম হোসেনের বাড়ি থেকে। এ ঘটনায় সাতক্ষীরা সদর থানায় মামলা হয়েছে। সাতক্ষীরা সদর থানার মামলা নং-৭৮/৬৩৯, তারিখ- ৩১/০৮/২০২০।
এ ঘটনায় সোমবার সকাল ১০টায় সদর উপজেলার পরানদহ বাজারে ‘শিবপুর ইউনিয়নবাসী’র ব্যানারে অ্যাডভোকেট শাহনেওয়াজ পারভিন মিলি ও বেস্ট টিম সাতক্ষীরার অ্যাডমিন মোস্তাফিজুর রহমানের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হলে গত আড়াই মাস আগে পারনদহ গ্রামের ট্রলি চালক আলমগীরের স্ত্রী মাছুরা তার বাপের বাড়ি দেবহাটা উপজেলার কুলিয়া গাজীপাড়ায় চলে যায়। এরপর আলমগীর গত ২৫ আগষ্ট স্ত্রীর নামে তালাকনামা পাঠায়। খবর পেয়ে মাছুরা স্বামীর বাড়িতে এলে তাকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। একপর্যায়ে ২৮ আগষ্ট সকালে এ নিয়ে পরানদহ মোড়ে শালিসি বৈঠকে বিষয়টি মীমাংসা হয়নি। ওইদিন দুপুর আড়াইটার দিকে মাছুরা, তার ভাগ্নে আবুল হোসেন, কুলিয়া ইউপি সদস্য মোশাররফ হোসেনসহ কয়েকজনকে নিয়ে বেষ্ট টিমের কর্মকর্তা পরিচয়ে কুলিয়া গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমান ও তার স্ত্রী শাহানাজ পারভিন মিলি পরানদহ গ্রামে এসে আলমগীরের ঘরের তালা ভেঙে ফেলে। ঘরের মধ্যে ঢুকে তারা শো কেসের ড্রয়ার ভেঙে নগদ ১৫ হাজার ১০০ টাকা, সোনার গহনা, আড়াই বিঘা জমির বন্দকী দলিল, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ও ব্যবহৃত জিনিসপত্র লুটপাট করে নিয়ে চলে যায়। সন্ধ্যায় অভিযোগ দিতে গেলে মিলি ও মোস্তাফিজুর থানার মধ্যে আলমগীরকে হুমকি ধামকি দেয়। উল্টে মাছুরাকে দিয়ে থানায় মিথ্যা অভিযোগ করানো হয়। ২৯ আগষ্ট আলমগীর থানায় একটি অভিযোগ দিলেও পুলিশ এখনও কোন ব্যবস্থা নেননি।
বক্তারা আরো বলেন, বেস্ট টিমের সদস্যরা কখনও মানবাধিকার কর্মী, কখনও সাংবাদিক, কখনও জেলা পরিষদের কর্মকর্তা, কখনও আইনজীবী পরিচয়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করছে। প্রশাসন সব কিছু জেনেও কেন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। বক্তারা এ সময় বেষ্ট টিমের কর্মকর্তা পরিচয়দানকারি মোস্তাফিজুর ও তার স্ত্রী শাহানাজ পারভিন মিলিসহ এ হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের জোর দাবি জানান।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য দেন, শিবপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুর রহমান মানি, সাংগঠণিক সম্পাদক সাঈদুর রহমান, পরানদহ বাজার কমিটির সভাপতি ইয়াছিন আলী পলাশ, সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুর রহমান, বেষ্ট টিমের শিবপুর ইউনয়ন লিডার রায়হ্না হোসেন, ক্ষতিগ্রস্ত ট্রলি চালক আলমগীর হোসেন প্রমুখ।
অভিযোগে জানা গেছে। ফেসবুক ভিডিওতে লাইভ দিয়ে জেলার বিভিন্ন জায়গায় পারিবারিক ঝগড়া (স্বামী-স্ত্রী দাম্পত্য কলহ), জমি দখল, বাল্যবিবাহ বন্ধ, সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের গাছ বিক্রিসহ নানা কাজে তারা ব্যস্ত থাকেন সারাদিন।
সদর উপজেলার পরানদহা গ্রামের মৃত আবদুল খালেক সরদারের ছেলে আলমগীর হোসেন (৩৫) জানান, তিনি দেবহাটা উপজেলার কুলিয়া গ্রামের মৃত নুর আলী সরদারের মেয়ে মারুফা খাতুনের সাথে বিগত ১৭ বছর আগে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। তাদের পারিবারিক জীবনে নবম শ্রেণিতে পড়–য়া এক ছেলে ও এক চার বছর মেয়ে। সম্প্রতি এক মাস আগে তার ছেলে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে দেবহাটার সখিপুর হাসপাতালে মৃত্যু হয়। তার ছেলের করোনা রোগে মৃত্যু হয়েছে বলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে দিয়ে নিজের ছেলের কবর খুড়ে স্ত্রীর বাবার বাড়িতে দাফন করে। আলম ছেলের মৃতদেহ পরানদহে নিজ বাড়িতে নিয়ে দাফন করতে চাইলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন বাঁধা দেয়।
এদিকে, তার ছেলের মৃত্যুর পর আলমের স্ত্রী মারুফা খাতুন তার সংসারে ফিরে আসতে অস্বীকৃতি জানান। বিষয়টি নিয়ে কুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের একাধিকবার শালিস মিমাংসা হয়। সেখানে কোন সমাধান না হওয়ায় মারুফা তার বাবার বাড়িতে থেকে যায়। এক পর্যায়ে গত ২৫ আগস্ট ২০২০ তারিখে আলম হোসেন আদালতের মাধ্যমে স্ত্রী মারুফা খাতুনকে তালাক দেয়।
এ ঘটনার পর ঘটনার দিন ২৮ আগস্ট ২০২০ শুক্রবার দুপুর ১টার দিকে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট শাহনেওয়াজ পারভিন মিলি, তার স্বামী মাদকাসক্ত মোস্তাফিজুর রহমান, আলমের প্রাক্তন স্ত্রী মারুফা খাতুন ও দেবহাটার কুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের প্রাক্তন ইউপি সদস্য মোশারফ হোসেন পরানদহ গ্রামে আলমের বাড়িতে অনধিকার প্রবেশ করে ঘরে রক্ষিত জমির দলিল, বন্ধক নেওয়া জমির চুক্তিপত্র, সোনার গহনা, নগদ ১৫ হাজার টাকা ও মূল্যবান কাগজপত্র এবং জিনিসপত্র নিয়ে যায়। এ সময় অ্যাডভোকেট শাহনেওয়াজ পারভিন মিলি চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আমি মিলি আইনজীবী ও জেলা পরিষদের সদস্য, মানবাধিকারকর্মী তোমাদের ঘরে থাকা কোটি টাকা নিয়ে গেলাম, পারলে যা পারেন করেন। যার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী শিবপুর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুর রহমান, আলমের স্বজন গৃহবধূ আসমা খাতুন, ইউসুফ আলী বলেন, শাহনেওয়াজ পারভিন মিলি নিজ হাতে অসহায় আলমের ঘরের তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকে ঘরে রক্ষিত জমির দলিল, বন্ধক নেওয়া জমির চুক্তিপত্র, সোনার গহনা, নগদ ১৫ হাজার টাকা ও মূল্যবান কাগজপত্র এবং জিনিসপত্র নিয়ে যায়। এ সময় এলাকার পুরুষরা মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে যান। বাড়িতে নারী থাকায় তারা বাধা দিলে মিলি ও তার স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান নারীদেরকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং থানা-পুলিশের ভয় দেখিয়ে হুমকি-ধামকি দিতে থাকেন।
এ ঘটনায় গত শনিবার ক্ষতিগ্রস্ত আলম হোসেন বাদি হয়ে সাতক্ষীরা সদর থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন।
এ ব্যাপারে অ্যাডভোকেট শাহনেওয়াজ পারভিন মিলির সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ওই এলাকার জনপ্রতিনধি। ঘটনার সময়ে আমি বাইরে ছিলাম। খবর পেয়ে সেখানে যেয়ে আলম ও মারুফা খাতুনের সংসার জোড়া লাগাতে কথা বলি। মারুফা এখন তালাকে কাগজ হাতে পাইনি সে কারণে তাকে সেখানে তার স্বামীর ঘরে তুলে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করেছি মাত্র। আমি কোনো জিনিসপত্র তছনছ করিনি। এবং আলমের ঘরের তালাও ভাঙিনি।
বেস্ট টিম সাতক্ষীরার অ্যাডমিন মোস্তাফিজুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করলেও তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ আসাদুজ্জামান জানান, আলম হোসেন থানায় অভিযোগ করেছেন। একজন উপ-পরিদর্শকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় সাতক্ষীরা সদর থানায় মামলা হয়েছে।
অভিযোগের তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর থানার উপ-পরিদর্শক হাফিজুর রহমান জানান, ‘আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি ও অভিযোগকারী এবং এলাকাবাসীর সাথে ঘটনার বিস্তারিত শুনেছি। তদন্ত অব্যাহত আছে। এ ঘটনায় সাতক্ষীরা সদর থানায় মামলা হয়েছে।