
সাতক্ষীরা দিবা-নৈশ কলেজ কোটি টাকার খেল: অতঃপর!
নিয়োগ নিয়ে অধ্যক্ষের বে-সামাল কারবার
বিশেষ প্রতিবেদক:
শুধুমাত্র ২০১৮ সালেই দিবা নৈশ কলেজের নিয়োগ বাণিজ্যে আয় কোটি টাকার উপরে। নিয়োগ না বলে বিনিয়োগ বলাই শ্রেয়। হঠাৎ ২০১৮ ও ২০১৯ সালের একটি প্রজ্ঞাপণ জারি; তার পর হৈ হৈ কান্ড। আসতে থাকে টাকা। ২০১২ সালে অনার্স চালু হলে ২০১৭ পর্যন্ত একে একে ১২টি বিভাগ চালু হয় এই কলেজে এবং নিয়োগ দেয়া হয় বিভাগ প্রতি গড় ৪/৫ জন করে শিক্ষক। শুধুমাত্র অনার্সের জন্য। সরকার ঘোষিত প্রজ্ঞাপণকে পুঁজি করে অধ্যক্ষ ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অনার্সে নিয়োগকৃত শিক্ষকদের বিপুল অংকের অর্থের বিনিময়ে প্রদান করেন ২০১০ সালের পূর্বের নিয়োগপত্র। কীভাবে? এ প্রশ্ন অবান্তর। এ অসম্ভবটা সম্ভব হলো কি করে তা উৎঘাটনে তাদের স্মরনাপন্ন হই। যারা নিয়োগ পান অনার্সে,অথচ এমপিও ভুক্ত হন ডিগ্রী পর্যায়ে।
দৃশ্যপট ১ঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ-প্রভাষক শাহিনা আক্তারের কাছে জানতে চাই নিয়োগ কবে? অনার্সে নিয়োগ কিনা? এমপিও ভুক্তির সাথে সাথে রূপালি ব্যাংকে লোন নিয়েছেন কিনা? ১ম উত্তর ২৫নভেম্বর ২০১৪ সাল। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর এলামেলো ভাবে হ্যাঁ আবার না। তৃতীয় উত্তর হ্যাঁ। প্রকৃতপক্ষে তার নিয়োগ ২০১২ সালে এবং শুধুমাত্র অনার্সে। বর্তমান নিয়োগ ২০১২ সালে এবং শুধুমাত্র অনার্সে। বর্তমান বিভাগীয় প্রধান তাহাছিনা বেগম ও অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান মাংগীলাল সরকারও তাই বলেন। ২০০৪ সালে নিয়োগ হয়ে থাকলে সে সময় ২ জন এমপিওভুক্ত শিক্ষকের পর ৩ জন কোন বুনিয়াদে ছিলেন। আবার সে সময়কার হাজিরা খাতা খতিয়ে দেখা দরকার। প্রশ্ন হলো এমপিও ভুক্তির সাথে সাথে রূপালী ব্যাংকে লোন নেয়া কেন? টাকাটা কে নিল? সদুত্তর নেই।
রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ২য় জন ফারুক হোসেন। একই প্রশ্ন: উত্তরে নিয়োগের প্রকৃত তারিখ। তবে অনার্সের নিয়োগে কোন শক্তিবলে শূন্যপদে নিয়োগ পেলেন? ২০১২ সালের অক্টোবরে তো অনার্সের নিয়োগ দেয়া হয়। যার লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ৫ অক্টোবর ২০১২ শুক্রবার। রাতারাতি কি করে ডিগ্রী পর্যায়ের শিক্ষকে পরিনত হলেন? এটা ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপনের সুষ্পষ্ট লংঘন নয় কি? বিভাগীয় প্রধানদের উত্তর পূর্বের মত।
দৃশ্যপট ২: সমাজকর্ম বিভাগ: চম্পা রানী বিশ্বাস। প্রশ্ন একই। জবাবে জানান ২০১৬ সালে নিয়োগ। প্রকৃতপক্ষে সে সময় নিয়োগ ছিল অনার্সের, তদুপরি চম্পারাণীর দরখাস্ত ঐ তালিকায় ছিল না। কারন তার প্রকৃত আগমন ২০১৮ সালের মার্চ মাসে। তাও কোন সার্কুলার বোর্ড ছাড়া। ২০১৬ সালে নিয়োগ হলে সেসময়কার বিভাগীয় প্রধানের নাম জানার কথা। হাজিরা খাতায় নাম থাকবে বা বিভাগীয় বেতনের খাতায় নাম থাকবে? এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, প্রিন্সিপ্যাল স্যার জানেন। এই বলে ফোন বিচ্ছিন্ন করেন। বর্তমান বিভাগের প্রধানের বক্তব্যেও ঐ একই বক্তব্য। আর ২০১৭ সালের অব্যাহতি নেয়া তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান এবং বর্তমান হাজী কেয়ামদ্দীন মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আবুল কালাম এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ২০১৭ সালে অব্যাহতি নেওয়ার সময় দিবা-নৈশ কলেজে আমার বিভাগে শিক্ষক ছিলেন রফিউদ্দীন এবং আশরাফ। অর্থাৎ ২০১৭ সালের পূর্বে চম্পা রানীর নিয়োগ হয়নি। তাছাড়া এমপিও ভুক্তির সাথে সাথে রূপালী ব্যাংকের লোন নেয়া প্রশ্নের জন্ম দেয়।
দৃশ্যপট ৩: ভ‚গোল বিভাগ: পরোজিত বিশ্বাস। ২০০৪ সালে নিয়োগ দেখিয়ে এমপিও ভুক্ত করা হয়। অবাক ব্যাপার ঐ সময় তাহলে ডিপার্টমেন্টে কি ৪জন শিক্ষক ছিলেন? কারণ সাবেক বিভাগীয় প্রধান ২০১৭ সালে অবসরে গেছেন। সে সময় এমপিও ভুক্ত শিক্ষক ছিলেন ৩ জন। পরোজিত সহ ৪ জন? প্রকৃত পক্ষে তিনিও অনার্সের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। ব্যাংক লোনের মাধ্যমে ব্যাক ডেটে চলে গেলেন।
দৃশ্যপট ৪: অর্থনীতি বিভাগ: রিনাত রুবাইয়া। ফোন ধরেই সরাসরি বল্লেন এমপিও ভুিক্তর সাথে সাথে ৫ লক্ষ টাকা লোন নিয়েছেন রূপালী ব্যাংক থেকে। নিয়োগ পেয়েছেন ১৩অগাস্ট ২০১৬। কিন্তু বর্তমান বিভাগীয় প্রধান গণেষ চন্দ্র শূন্য পদে নিয়োগ পান ১০ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে। পরে শূন্য পদে নিয়োগ পেয়ে বিভাগীয় প্রধান আর আগে নিয়োগ পেয়ে ২০১৮ সালে এমপিও। বিশ্বাস যোগ্য? এ বিষয়ে জানতে চাইলে সরাসরি উত্তর এখন সময় নেই পরে কথা হবে।
দৃশ্যপট ৫: ইংরেজী বিভাগ-রোজীনা আক্তার। মাষ্টার্স শেষ হলো ২০১২ সালে। নিয়োগ দেখানো ২০১০ সালে ৯ অক্টোবর। বিভাগীয় প্রধান প্রদ্যুৎ বিশ্বাস কিছুই জানেন না। এসব নিয়ে কোন প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই বলে সাফ জানিয়ে দেন তিনি। প্রকৃতপক্ষে ২০১৯-২০ সেশনে প্রথম ইংরেজী ছাত্র ছাত্রী ভর্তি শরু হয়। ঐ সময়ই রোজিনার নিয়োগ। এমপিও ভুক্তির সাথে সাথে লোন নেন বেতনের বিপরীতে।
দৃশ্যপট ৬: দিবানৈশ কলেজের অনার্স কোর্স শুরুর জন্য প্রথম নিয়োগ বোর্ড সমাজবিজ্ঞানের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষ ১ম ছাত্র ভর্তি হয়। অথচ নিয়োগ দেখান হয় প্রভাতী রাণীর ২০১০ সালে। সাথে সাথে চাকুরির বিপরীতে লোনও নেন রূপালী ব্যাংক হতে।
দৃশ্যপট ৭: ম্যানেজমেন্ট- কানিজ আনজুম। চটপট উত্তর নিয়োগ পেয়েছি ২০০৯ সালে। কিন্তু একপর্যায়ে ইতস্তত করে ফোন কেটে দেন। বিভাগীয় প্রধান মারফৎ জানা যায়, তার প্রকৃত নিয়োগ অনার্সের শিক্ষক হিসেবে ২০১২ সালে। এমপিওর সময়েই লোন নিয়েছেন।
দৃশ্যপট ৮: মার্কেটিং -শাহজাহান আনছারি। প্রকৃত নিয়োগ ২০১৩ সালে হলেও এমপিওভুক্ত হওয়ার স্বার্থে নিয়োগ দেখানো হয় ২৮ডিসেম্বর ২০০২ সালে। অথচ তার সিনিয়র ২য় ব্যাক্তি হিসেবে বিভাগে আছেন আরিজুল ইসলাম। তার নিয়োগ ৩১ডিসেম্বর২০০২। মাত্র ৩ দিন পর নিয়োগ পেয়ে আরিজুল ইসলাম প্রথম থেকেই এমপিও ভুক্ত। বিভাগীয় প্রধানের বক্তব্যে মূলত শাহজাহান আনছারির নিয়োগ ২০১৩ সালে অনার্সের শিক্ষক হিসেবে।
দৃশ্যপট ৯: বাংলা-মহিনুর রহমান। বর্তমান ২য় ব্যাক্তি হিসেবে ২০১১ সালে নিয়োগ পান নন্দা দেবনাথ। অথচ মহিনুর রহমানের নিয়োগ দেখানো ২০০৭ সালে। তাহলে ঐ সময় কি ৩ জন শিক্ষক ছিলেন? আর নন্দার এত আগে নিয়োগ পেয়ে এত পরে এমপিও ভুক্ত হলেন। অবাক ব্যাপার লোন নেয়াটা আরো অবাক কান্ড। বিভাগীয় প্রধানের বক্তব্যে তার নিয়োগ ২০১৬ সালের দিকে।
দৃশ্যপট ১০: ইসলামের ইতিহাস-গোলাম মোস্তফা। অন্তত ৫ জন শিক্ষক (অনার্সের) তার ব্যপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। প্রথমত তার নিবন্ধন সার্টিফিকেট সন্দেহজনক বা কেউ বলছেন দেখানো হয়নি। আবার কেউ বলছেন তার এসএসসির সার্টিফিকেটে জন্ম তারিখ টেম্পারিং করা। তার দাপট বেশি। অধ্যক্ষের প্রিয়ভাজন। ঢাকায় অধ্যক্ষের ফøাটের ফার্নিচার দাতা তিনি বিভাগীয় প্রধানের প্রিয়জন, তার নিয়োগ অনার্সের শিক্ষক হিসেবে। অনার্স খোলার সময়।
দৃশ্যপট ১২: সংস্কৃত- শূন্য পদেই নিয়োগ। সুন্দর পরিবেশে নিয়োগ দেয়া যেত। কিন্তু খরচ বাচাতে এবং আখের গোছাতে প্রকৃত প্রসেস অনুসরন না করে বৈধ একটা নিয়োগকে অবৈধ করা হয়েছে।
এসব নিয়োগের সবটাই বৈধ ছিল। কিন্তু এমপিও করার স্বার্থে অবৈধ করা হয়েছে। ২/১জন বাদে বাকী সবাই এমপিও আসার সাথে সাথে বেতনের বিপরীতে রূপালী ব্যাংক লোন করোনো হয়েছে। গড় যদি ৮লাখ হয় তবে ৯৬ লক্ষ টাকার বেশি। কেউ জানেনা, এমনকি গভর্নিং বডিও নয়। যার বিভাগের শিক্ষক সেই বিভাগের বিভাগীয় প্রধানও না। অবাক হয়ে সবাই তাই বলছে কোটি টাকার খেল: তারপর!
পুনশ্চ: আইনগত দিক বুঝতে প্রতিবেদন তৈরিতে দেরি হল। তথ্যের যাচাই বাছাই ও আইনগত ব্যাখ্যা বুঝতে ১ জন প্রাক্তন অধ্যক্ষ আমাকে সহায়তা করেছেন। অফিস থেকে তথ্য দিয়ে, ডকুমেন্ট দিয়ে সহায়তা করেছেন। এজন্য তাদেরকে ধন্যবাদ। ফোনে যারা সহায়তা করেছেন তাদেরকেও ধন্যবাদ। এ প্রতিবেদনের লক্ষ্য এমপিও ভুক্ত শিক্ষকদের চাকরির ব্যাপারে নয় বরং মুল বিষয় দুর্নীতির মাত্রা, সিস্টেম সম্পর্কে প্রশাসনকে অবহিত করা।