হাবিবের ‘অঙ্গিকার’ সাতনদীর ‘দায়বদ্ধতা’
সাঈদুর রহমান রিমন: এখন চলছে ধ্বংসযজ্ঞের সাংবাদিকতা। টিকটক মার্কার ফালতুমি কর্মকান্ড আর গ্রাম্য চাতাল নারীদের মতো পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে কুটনামি করাটাই এখন সাংবাদিকতার প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠেছে। সারাদেশের কৃষক সমাজ সার, কীটনাশকের অভাবে যখন কপাল চাপড়িয়ে কাঁদেন, আমরা তখন পরীমনির মাদক কান্ডকে লিড স্টোরি হিসেবে প্রকাশ করে বিকৃত আনন্দে মেতে উঠি। রিপোর্টিং বিভাগ, নিউজ ডেস্ক, তারও উপরে থাকা নীতি নির্ধারক পর্যায়ের কর্তা ব্যক্তিরাও এখন টিকটকারদের মতো শুধু লাইক, কমেন্ট, শেয়ার খুঁজেন। দেশ, দেশের মানুষ কিংবা ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠী এখন কী গণমাধ্যমের কাছে কাঙ্খিত সাড়া পাচ্ছেন? নাকি সমাজ ও মানুষের জন্য কোনরকম ম্যাসেজ না দিয়েও শুধু বিকৃত অঙ্গভঙ্গি দেখিয়ে, গণ্ডমূর্খতা ছড়িয়ে হিরো আলম, প্রবাস ফেরত মানিক মিয়া, পরীমনি কিংবা ঘৃণ্য অশ্লীলতা ছড়িয়ে বেড়ানো একশ্রেণীর টিকটকাররাই মিডিয়ার কাছে অতিমাত্রায় গুরুত্ব পাচ্ছে? বাইরের দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সুপরিচিত হয়ে ওঠা ব্যক্তিরা মাত্র দুই, তিন মিনিটের মানসম্পন্ন ক্ষুদে ভিডিও পাবলিকলী পোস্ট করে থাকেন। তাদের প্রতিটি ক্ষুদে ভিডিওতেই যেমন হাসি আনন্দ থাকে, তেমনই সমাজ ও জীবনের জন্য কোনো না কোনো বার্তা থাকে। সচেতনতা সৃষ্টির চমৎকার উদ্যোগও সেসব ভিডিওতে লক্ষ্যনীয়। কিন্তু তার বিপরীতে এদেশে টিকটকের চলমান নর্দমার জোয়ারে কী দেখছি আমরা? দেখছি, বস্তা পঁচা অতি নিম্নমানের তামাশা আর অশ্লীলতার ছড়াছড়ি। কাতুকুতু মার্কা অশ্লীলতা মিশ্রিত ক্ষুদে ভিডিওতে লাইক, শেয়ারেরও অভাব নেই। কারা লাইক দেন, কারা শেয়ার করেন? তাদের প্রোফাইলে একবারের জন্য ক্লিক করলেই তা সহজে অনুমেয়।
হাবিবের অঙ্গিকার সাতনদী’র দায়বদ্ধতা: তবে সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে আমার প্রিয় ভাই বন্ধু হাবিবুর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত সাতনদী পত্রিকাটি লাইক, কমেন্ট, শেয়ারের জোয়ারে ভেসে যায়নি। নিজ জেলা জনপদের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে কোনরকম ছাড় দিচ্ছেন না তিনি। স্থানীয় পত্রিকায় দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, চোরাচালানি কিংবা ত্রাণের চাল, টিন আত্মসাৎকারী জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে ছয় কলামে লিড নিউজ প্রকাশ করা সাধারণ কোনো বিষয় নয়। এটা পেশাদারিত্ব আর সামাজিক দায়বদ্ধতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তই বটে। সমাজ, জেলা, দেশের প্রতি ‘মঙ্গল নিশ্চিতকরণের’ অঙ্গিকারবদ্ধতা না থাকলে বর্তমান সময়ে কেউ কিছুর জন্য ঝুঁকি নিতে পা বাড়ায় না। বাস্তবেই হাবিবের ‘অঙ্গিকার’ দৈনিক সাতনদীকে ‘দায়বদ্ধ’ করে তুলেছে। এসব কারণে বন্ধু হাবিবুর রহমানকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই আমি।
সাতনদী’র সম্পাদক, প্রকাশক হাবিবুর রহমানের সামাজিক অঙ্গিকারবদ্ধতা নতুন কোনো বিষয় নয়। সেই ১৯৯৮ সালে তখন আমি দেশের প্রভাবশালী দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টার। হাবিব ছিলেন পত্রিকাটির সাতক্ষীরার জেলা প্রতিনিধি। ওই সময়ই মূলত সুন্দরবনের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলছিল। হাবিব ঢাকায় পত্রিকা অফিসে গিয়ে রীতিমত দাবি দাওয়া জানিয়ে বার্তা সম্পাদকের কাছ থেকে আমাকে ‘রিকুইজিশনে’ নিয়ে যান সাতক্ষীরায়। টানা ছয় দিন সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবকিছুর বাস্তবতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে থাকেন। একের পর এক নোট খাতা ফুরোতে থাকে আমার, পাল্টাতে হয় ক্যামেরার বেশ কয়েকটি ফিল্মও। ৭ম দিবসে ঢাকায় ফিরেই শুরু করেছিলাম সিরিজ প্রতিবেদন, শিরোনাম ছিল : সুন্দরবনের কান্না। সাত কিস্তির এ প্রতিবেদনের ২য় দিনে তৎকালীন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী সাজেদা চৌধুরী তার মন্ত্রনালয়ে বিশেষ সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য হন। তৃতীয় দিনেই মন্ত্রনালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির পাঁচ সদস্যের একটি টিম সরাসরি সুন্দরবন পৌঁছে সরেজমিন তদন্ত শুরু করেন। ৪র্থ দিনে সুন্দরবনের ষ্টেশন অফিসার থেকে শুরু করে ডিএফও পর্যন্ত ৪৭ জন কর্মকর্তাকে একযোগে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
রিপোর্ট প্রকাশের ৬ষ্ঠ দিন থেকে পাল্টা আক্রোশ মেটাতে থাকে বনদস্যু, জলদস্যুরা। আমাদের তথ্য দেয়ার অপরাধে ওই সময়ের দুই জন ইউপি চেয়ারম্যানসহ ৭/৮ জনকে বেধড়ক পিটিয়ে হাড়গোর ভেঙ্গে দেয়া হয়। কয়েকজন স্থানীয় সাংবাদিককেও তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে তারা। ওই অবস্থায় হাবিবের অবস্থা কী দাঁড়াতে পারে? অফিস থেকে বার্তা সম্পাদক মোক্তাদীর ভাই নিজে ফোন করে হাবিবকে সাতক্ষীরা ছেড়ে ঢাকায় আসার নির্দেশ দিলেন। এরও তিন দিন পর হাবিব সাতক্ষীরা ছেড়ে ঢাকায় যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবুও তার ইচ্ছা ছিল যে, হুমকি ধমকি যাই হোক সুন্দরবনকে তো বাঁচাতে হবে। এজন্য কাউকে না কাউকে ঝুঁকি নিতে হবে। দীর্ঘ ২৫ বছর পর এখনও হাবিব ভাই’র অভিন্ন মানসিকতা দেখতে পাচ্ছি, এটা দেখছি তার সাতনদী’র ভূমিকার মধ্যে।
দুর্নাম চর্চা কী সাংবাদিকতা?
দুর্নাম চর্চা, ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস, অপপ্রচার মোটেও সাংবাদিকতা হতে পারে না, বড়জোর তা অপসাংবাদিকতা হতে পারে। যা ফেসবুকের পাতায় পাতায় অহরহ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। নিজের আইডিতে স্ট্যাটাস দেয়ার নামে, গ্রুপে কিংবা পেইজে নিউজের আদলে এগুলো বেশি প্রকাশ করা হয়। আবার কেউ কেউ আগাম হুমকি দেয়ার স্টাইলেও অপসাংবাদিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে থাকেন।
গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা আরো সুন্দরভাবে হয়তো বিষয়টি উপস্থাপন করতে পারবেন, তবে আমি মনে করি: যে কোনো মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ও কর্মকান্ড ততক্ষণ পর্যন্ত নিরাপদ ও সংরক্ষিত থাকা উচিত যতক্ষণ তা দ্বারা অন্য কেউ ক্ষয়ক্ষতির শিকার না হন। ধরা যাক, এক দম্পত্তি প্রতি রাতে নিজ বাসায় দরজা জানালা বন্ধ করে সারারাত মদ পান করেন, ড্যান্স করেন, গান বাজনায় মত্ত থাকেন। এমন কাজ যদি অন্য কারোর জন্য ডিস্টার্বের কারণ না হয় তাহলে সে বিষয়ে কারো হস্তক্ষেপ কাম্য হতে পারে না। আইনগত ভাবে এ অধিকারও নেই।
অথচ আপনি সাংবাদিক হিসেবে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান শুরু করলেন, ড্রোন বা স্পাইক্যাম ব্যবহার করে তার ঘরের দৃশ্যাবলী ভিডিও করলেন, সে কোথা থেকে মদ কিনে আনে তার রিসিট জোগাড় করলেন, সেসব প্রচারের উদ্যোগ নিলেন; এসবই আপনার অনৈতিকতা এবং অপরের প্রাইভেসী ভঙ্গের অপকর্ম। শুধুই কুটনামি আর বদনাম চর্চা কখনোই সাংবাদিকতা নয়। যে খবর সমাজ, রাষ্ট্র, জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো প্রভাব ফেলে না তা কখনই সংবাদ হতে পারে না, সেসব নিয়ে সংবাদ প্রস্তুত বা প্রচার প্রকাশ করাটাও সাংবাদিকতা হতে পারে না।
নারীতেই নিউজ খায়, সংকট কাটে আইডিয়ার?
কয়েক দিনের মিডিয়া চিত্র দেখে আবারো বলতে হচ্ছে, দেশের সাংবাদিকতা নিউজ আইডিয়ার ক্ষেত্রে সক্ষমতা হারাচ্ছে। আমাদের সব অনুসন্ধানের কেন্দ্রবিন্দু কেবলই নারীকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। নেপথ্যের তথ্য উদঘাটন মানে পরীমনি, বুবলি নয়তো শাকিব খানের বিয়ে বহির্ভূত সন্তান আবিষ্কারের বাহাদুরি থাকা। কিন্তু হঠাৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত কেন? কেন মিয়ানমার যুদ্ধ বাধানোর চেষ্টায় ব্যস্ত? ইডেনের মতো আর কতগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কত ছাত্রী জিম্মি থাকে? সাংবাদিক হিসেবে এ সব নিয়ে অনুসন্ধানের কোনো প্রয়োজবোধই করছি না, অথবা তা ভাবতে পারার যোগ্যতাও হারিয়ে ফেলেছি।
আগে রূপালী জগতের নানা কান্ডকীর্তি বড়জোর ভেতরের পাতায় ঠাঁই পেতো। এখন মানসম্পন্ন নিউজ ফেলে দিয়ে হলেও হালকা টাইপের গসিপ মার্কা নিউজগুলোই লিড, সেকেন্ড লিড হিসেবে জায়গা পাচ্ছে। সমাজকে বিকৃত আনন্দের যোগান দেয়ার ক্ষেত্রে নিউজগুলো নাকি টনিক হিসেবে ভালোই ভূমিকা রাখছে। এ কারণেই হয়তো কোনো কোনো নিউজের ভাষা ও বর্ণনা নোংরা চটিকেও হার মানিয়ে দেয়। এখন অর্থনৈতিক বিট, অপরাধ বিট, রাজনৈতিক বিটের সাংবাদিকরা কেউ কেউ নিউজের প্রাধান্য পেতে নারী খুঁজেন, খুঁজতে বাধ্য হন। নারী উপাদান যোগ করা গেলেই নাকি সে নিউজ পাবলিকে খায় বেশি! কি সাংঘাতিক অবস্থা ভেবে দেখুন তো?
দেশের চলমান অবস্থায় সত্যিই কি নিউজ আইডিয়ার সঙ্কট? নানা ক্ষেত্রে অস্থিরতা, অনিশ্চিত আগামী, রাজনীতিতেও ধুম্রজাল, লুটেরাদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব, আমলাদের বাধাহীন খবরদারিত্ব, ব্যাঙ্ক বীমার ধ্বস-তবু নিউজ এর ঘাটতি মানেই হলো: ‘চোখে পড়েছি কাঠের চশমা, কানে দিয়েছি তুলা, লিখবো না আসল খবর, কারণ লেখাটাই জ্বালা।’ কয়েক বছর আগেও সাংবাদিক হিসেবে আমরা একেকটি নিউজ প্রকাশ করতেই নেটিজেনরা তা ভাইরাল করতে ব্যস্ত হয়ে উঠতো। আর ৭/৮ বছরের ব্যবধানে এখন অনেক সাংবাদিকই ফেসবুকের ভাইরাল পোস্টের পেছনে ছুটতে থাকি তার ভিত্তিতে বিশেষ কোনো প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে। এটাই হলো সাংবাদিকের উত্তরণ, সাংবাদিকতার অগ্রগতি (!)
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক দেশবাংলা।