তালা প্রতিনিধি: আসছে শীতকাল। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক খেজুর গাছ তোলা ও খেজুরের রস সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত তালা চাষীরা ৷
শীতের শুরুতেই তাই যেন বসে নেই সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চল দক্ষিণ জনপদের তালা উপজেলা গাছিরাও, প্রতিটি মুহূর্তে রস সংগ্রহের কাজে ব্যাস্ত সময় পার করছেন তারা ।
বর্তমানে সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলা মাছে সমৃদ্ধশালী। ফসলী জমির সিংহভাগ এখন মাছ চাষীদের দখলে। এক সময় এ অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ খেজুর গাছ থাকলেও, বর্তমানে কৃত্রিম সংকট তৈরী করে খেজুর গাছকে ইট ভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। ফসলী জমির একটা মোটা অংশ মৎস্যঘের হওয়ায় বর্তমানে কালের বিবর্তনে অনেকটা আজ হারাতে বসেছে, তার পরেও যে একেবারে কম তা সঠিক নয়। যে গাছগুলো রয়েছে তা থেকে রস সংগ্রহের নিয়মিত পরিচর্যা করতেই যেন হিমশিম খাচ্ছেন গাছিরা। যারা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজ করে তাদের বলা হয় গাছি। খেজুর গাছের অগ্রভাগের একটি নির্দিষ্ট অংশ চিরে, বাশের বিশেষ অংশ যাকে বলা হয় খিল, সেটা গাছে পুতে, বিশেষ ব্যবস্থায় ছোট মাটির পাত্র (কলসি, ভাঁড়) বাঁধা হয়। ফোঁটায় ফোঁটায় রসে পূর্ণ হয় সে কলসি বা ভাঁড়। বর্তমানে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহে গাছ তোলা বা কাটাসহ বিভিন্ন রকমের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন গাছিরা। তাহাছাড়া কলসি বা ভাড় গাছে পাতার আগে, ধানের পল বা পাতা দিয়ে পুড়িয়ে কলসি বা ভাড় শুকনো করে গাছে লাগাতে হয়। ছোট ও বড় বিভিন্ন রকমের খেজুর গাছে অত্যান্ত ঝুঁকি থাকে। যেমন কাঁটা ও বিষাক্ত পোকামাকড এর ভয়কে জয় করে রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করা হয় গাছটি। কোমরে মোটা রশি বেঁধে গাছে ঝুলে, ধারালো গাঁছো দা দিয়ে গাছ তোলার কাজ করতে হয়। আগের মতো তেমন মাঠ নেই, নেই সারি সারি খেজুর গাছ। তারপরেও কালের স্বাক্ষী হয়ে গ্রামের মাঠে, আর গ্রাম্য মেঠো পথের ধারে দাঁড়িয়ে আছে অনেক গাছ। গাছ থেকে প্রথমে যে রস বের হয় তাকে বলা হয় চাচের রস, সেই রস খাওয়ার জন্য অনেক সময় সন্ধার সময় গাছ থেকে পাড়া হয়। তাহাছাড়া রসের পায়েস খাওয়ার জন্য গাছিকে আগে থেকেই সিরিয়াল দিতে হয়। বর্তমানে এক ভাড় রসের মুল্য ১২০ টাকা হতে ১৫০ টাকা পর্যন্ত হয়।
আমাদের গ্রাম বাংলায় অতীতে খেজুর রসের যে সুখ্যাতি ছিল পর্যাপ্ত খেজুর গাছ না থাকায় তা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। খেজুরের রস শীতের সকালে বসে মুড়ি মিশিয়ে গøাসে ভরে খেতে বেশ মজা লাগে। সন্ধ্যা রস আরো মজাদার। বেশ লোভণীয় নলেন পাটালি ও গুড়। খেজুর গুড় বাঙালীর সংস্কৃতির একটা অংশ। ক’দিন পরেই প্রতিটি ঘরে খেজুরের রস দিয়ে পিঠা পুলি পায়েস তৈরীর ধূম পড়বে। ঢেঁকি ঘরে চাল কুটার ধুম পড়ে যাবে, শোনা যাবে ঢেকির ঢক ঢক শব্দ। মুড়ি, চিড়া, পিঠা খাওয়া কৃষক পরিবার থেকে শুরু করে সবার কাছে বেশ প্রিয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শতশত গাছির সারা বছরের আয় নির্ভর করে এ পেশার উপর।
উপজেলার খেশরা ইউনিয়নের শুভংকর কাটি গ্রামের শহিদুল ইসলামসহ অনেক গাছি জানান, শীতের শুরুতেই আমরা খেজুর গাছ তোলার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করি। সংসারে সারা বৎসরের খাবার ছাড়াও রস সংগ্রহ করে তা জ্বালিয়ে গুড় বানিয়ে বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছলতা আসে আমাদের।
তাই খেজুর গাছ তোলার মৌসুম এলেই গাছিদের মুখে ফুটে ওঠে রসালো হাসি। সংগৃহীত রস নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে বাকিটা বিক্রি করে যে অর্থ পান তা দিয়েই চলে সংসার। এখনো শীত জেঁকে না বসলেও গাছ তোলা, ঠুঙি, দড়ি ও মাটির কলস (ভাড়) প্রস্তুত করার কাজে সময় পার করছেন তারা। আগের মতো আর খেজুর গাছ না থাকলেও ঐতিহ্য ধরে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন গাছিরা ।
খেজুরের রস সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছে গাছিরা
পূর্ববর্তী পোস্ট