করোনা দূর্যোগের মধ্যে বোরা ধানের বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে আনন্দমাখা হাসি, পাকা ধান ঘরে তোলার প্রত্যাশায় তারা দিন গুণছিলেন। কিন্তু সে হাসি আজ ম্লান হয়ে গেছে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণের কারণে। মাঠের দিকে দূর থেকে তাকালে মনে হয় ধানগুলো পেকে আছে। কিন্তু না, ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত ধানের ভেতর চাল হওয়ার পরপরই এগুলো হলুদ রঙ ধারণ করেছে। ধানের ভেতরে শুধুই চিটা। প্রকৃতিতে মহামারী করোনা ভাইরাসের অশুভ থাবায় যেন আজ ক্ষতবিক্ষত কৃষকের স্বপ্নের ফসলও।
ফসল ঘরে তোলার পূর্ব মুহূর্তে এই রোগ দেখা দেয়ায় কৃষকেরা এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাদের মুখে হাসির পরিবর্তে ঝড়ছে চোখের জল। মাঠের পর মাঠ ধানের শীষ সাদা হয়ে যাচ্ছে। কৃষক ফসলি জমিতে গিয়ে হতাশা আর কান্নায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ফসলের রোগ সমাধানের জন্য পাগলের মতো ছোটাছুটি করছেন কৃষি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন ওষুধের দোকান গুলেতে। এরপরও হচ্ছে না প্রতিকার।
সাতক্ষীরার তালা ও কলারোয়া, যশোরের সদর ও শার্শা, ময়মনসিংহের ভালুকা ও নান্দাইল, কুড়িগ্রামের চিলমারি, গাজীপুরের শ্রীপুর, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ, কুমিল্লার লাকসাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন হাজার হাজার হেক্টর জমির পুস্ট হয়ে ওঠা ধান ব্লাস্ট রোগে চিটা হয়ে যাচ্ছে। সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছেন কয়েকলাখ কৃষক।
সাতক্ষীরা
সাতক্ষীরায় বোরো ধান পাকতে শুরু করেছে। সারাবছর খরচের পর এখন ফসল ঘরে তোলার সময়। ঠিক এই সময়ে জেলার সদর, তালা ও কলারোয়া উপজেলার বেশ কিছু ধানক্ষেতে নেক ব্লাস্ট (গলাপচা) রোগের আক্রমণ দেখা দিয়েছে। হলুদ হয়ে ধানের শীষগুলো মরে যাচ্ছে। এ রোগের প্রাদুর্ভাবে ক্ষেতের ধানের শীষ আস্তে আস্তে হলুদ হয়ে শুকিয়ে যায়। ধান চিটা হয়ে যায়। এতে করে ফলন কম হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন কৃষকরা। উপজেলা অফিস সূত্রে জানা ,তালা ও কলারোয়া উপজেলায় এ বছর ২৯ হাজার ৪৩০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমিতে ব্লাস্ট রোগের সংক্রমন দেখা দিয়েছে। ধান এখনই কাটা না হলে এই রোগ আরও ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু করোনা দূর্যোগে পুরো জেলায় ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এতে কৃষকের দুশ্চিন্তা বাড়ছে।
যশোর
যশোরের ৮টি উপজেলাতেই ব্লাস্টরোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও সদর ও শার্শা উপজেলায় এর সংক্রমণ তুলনামূলক বেশি। এবার জেলায় বোরো ধানের বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে যে হাসি ফুটেছিল তা এখন মুছে গেছে ফসল পাকার এই সময়ে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেওয়ায়। জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বোরো ধান উৎপাদন হয় যশোরে। জেলায় এবার বোরো ধানের চাষ হয়েছে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৬১৫ হেক্টর জমিতে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর বোরো ধানের বাম্পার ফলনেরও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। আগামী এক সপ্তাহ পর থেকে ধান কাটা শুরু হবে। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রোধে সরকারি নির্দেশে মানুষ ঘরবন্দী থাকায় ধান কাটতে শ্রমিকসংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সময় মতো ধান কাটতে না পারলে ব্লাস্ট রোগে ধান চিটা হয়ে এক তৃতীয়াংশ ফল কমে যেতে পারে।
ময়মনসিংহ
ময়মনসিংহের ভালুকা ও নান্দাইল উপজেলায় বেশ কিছু ইউনিয়নের বোরো ধানে নেক ব্লাস্ট রোগ সংক্রমণ ঘটেছে।এ রোগে ধান ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় এখন কৃষকদের মাথায় হাত। দিশেহারা হচ্ছেন কৃষকরা। ভালুকা উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে ১৮ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে দুই হাজার হেক্টর জমির ধানে ব্লাস্ট রোগ দেখা দিয়েছে। একই জেলার নান্দাইলে কয়েকটি ইউনিয়নে ব্লাস্ট রোগ ছড়িয়ে পরছে। এ রোগের প্রভাবে ক্ষেতের ধানের শীষ আস্তে আস্তে সাদা হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে। বোরো ধানে সবে সোনালী রং ধরতে শুরু করেছে।। এরই মধ্যেই দেখা দিয়েছে চিটা (ব্লাস্ট) রোগ। এরই মধ্যে আক্রান্ত হয়েছে কমপক্ষে ৫০০ হেক্টর জমির ধান।
কুড়িগ্রাম
অভাবী মানুষের জনপদ কুড়িগ্রামের চিলমারির কৃষকদের মুখে একসপ্তাহ আগেও হাসি ছিল। বোরো বাম্পার ফলন তাদের দিয়েছিল পেটভরে খাবার আশ্বাস। কিন্তু ধান ক্ষেতে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেওয়ায় কৃষকের মুখ থেকে হাসি মুছে গিয়ে চোখ পানি ঝরছে।কালবৈশাখী দুই দফা আঘাত হানার পর এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ব্লাস্ট (ধান গাছের গিঁটপচা, শীষের গোড়াপচা) রোগে আক্রান্ত হয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রমনা, থানাহাট, রানীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার হেক্টর কে হেক্টর জমির ধানের শীষ চিটা হওয়ায় শত শত কৃষক হয়ে পড়েছেন। ইতোমধ্যে কিছু এলাকায় ধান কাটা শুরু হলেও এখনও অনেক এলাকায় ধান পাকতে শুরু করেছে। সেগুলো দুই সপ্তাহের মধ্যে কাটার পর্যায়ে যাবে। তবে বেশ কিছু এলাকার ধানের শীষে নেক ব্লাস্ট রোগ হওয়ায় আশানুরূপ ধান ফলন না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গাজীপর
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে শত শত বিঘা ধানের জমিতে ব্লাস্ট রোগ আক্রমণ করেছে। দিশেহারা হয়ে গেছেন ধানচাষিরা। উপজেলার মাওনার ভেরামতলী, জয়নাতলী, বড় বাইদসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত শত শত বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে।কৃষকরা জানান, দু’চোখে এখন অন্ধকার। করোনাভাইরাসের এ দুঃসময়ে অন্তত দুবেলা ক্ষেতের ধানের ভাত খেয়ে বেঁচে থাকা যেত। সেটাও আর হলো না। এ রোগ এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ইরি-বোরো উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না।
কিশোরগঞ্জ
কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে বোরো ধান ব্লাস্ট রোগে চিটা হয়ে যাওয়ায় চাষীরা পড়েছে বিপাকে। হাওর ঘেষা এ এলাকার কৃষক বিশেষ করে প্রান্তিক চাষীদের বোরো ধানের উপরই তাদের সুখ শান্তি নির্ভর করে। বছরের সিংহভাগ সময়ের খাদ্যের প্রধান উৎস্য এ বোরো ধান। স্বাবলম্বি কৃষক বছরের খাদ্য সংরক্ষণ ও উদ্বৃত্ত ধান বিক্রি করে সংসার পরিচালনা করেন। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ১টি পৌর ও ৯টি ইউনিয়নের ১২ হাজার ৮শত হেক্টর জমিতে ৫৪ হাজার ৫৬৭ মে.টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে চলতি মৌসুমে বোরো আবাদ করা হয়েছে। কিন্ত ব্লাস্ট রোগের কারণে এক চতুর্থাংশ ফসল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
রাজবাড়ী
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার কৃষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। তাঁরা বলছেন, সব ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে। কালবৈশাখী দুই দফা আঘাত হানার পর এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।ফসল ঘরে তোলার ঠিক আগ মুহূর্তে রোগটি ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। আগামী একসপ্তাহের মধ্যে ধান কাটা না হলে ব্লাস্ট রোগ আরও ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা।
কুমিল্লা
কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বোরো ধান ক্ষেতে ব্লাস্ট রোগ ছড়িয়ে পড়ায় কৃষকের স্বপ্ন পুড়েছে। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে কৃষকের ফসল পুড়ে নষ্ট হবার উপক্রম। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে লাকসামে ৮ হাজার ৭৫০ হেক্টর বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে চাষ হয়েছে ৮ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। সব এলাকাতেই বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্ত উপজেলার কান্দিরপাড় ও মুদাফরগন্জ ইউনিয়ন এলাকায় শত শত বিঘা জমির ধানে ব্লাস্ট রোগের সংক্রমন দেখা দেওয়ায় কৃষকের স্বপ্ন পুড়েছে। তার প্রত্যাশানুযায়ী ফলন না পাওয়ার দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার বিলঘর ইউনিয়নের পশ্চিম বিলের বিস্তীর্ণ ধান ক্ষেতে দেখা দিয়েছে ব্লাস্ট রোগ। কৃষকদের বাম্পার ফলনের ফসল ঘরে তোলার আশা আর নেই, বরং ধান পুস্ট হয়ে ওঠার আগেই হলুদ হয়ে যাওয়ায় তাদের এখন মাথায় হাত। মহামারী করোনা ভাইরাসের অশুভ থাবায় পাওয়া যাচ্ছে না ফসল কাটার শ্রমিক। এখনই ধান কাটা না হলে কৃষকের স্বপ্নের ফসল মাঠে শেষ হয়ে যাবে।
মৌলভীবাজার
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় বোরো ধানে ব্যাপক আকারে ছত্রাকজনিত খোলপঁচা বা ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ দেখা দিয়েছে। জমির ধান নষ্ট হওয়ায় উপজেলার কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। প্রথম দিকে ব্লাস্টের আক্রমণ অল্প সংখ্যাক পরিলক্ষিত হলেও দিনের ব্যবধানে সমস্ত ক্ষেত জুড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহারেও কোন ভাল ফল পাচ্ছেন না ধান চাষি কৃষকরা। ফলন ভাল থাকায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়ার স্বপ্ন এখন ব্লাস্টের আক্রমণে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। শ্রীমঙ্গল কৃষি অফিস সুত্রে জানা যায় চলতি মৌসুমে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ৩৮ হাজার ৩৮৪ মেট্রিকটন ফসলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ।ফসলের ক্ষেতে ব্লাষ্ট রোগ আক্রমণের ফলে মোট উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশ ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন প্রান্তিক কৃষকরা।
পূর্বপশ্চিম- এনই