সচ্চিদানন্দ দে সদয়: রাস সনাতন ধর্মে নানা দেব-দেবীর আরাধনা করা হয়। তেমনি কার্তিক পূর্ণিমায় পালিত হয় হিন্দু ধর্মের অন্যতম উৎসব রাস উৎসব। গোপিনীবৃন্দ সহযোগে এদিন রাধাকৃষ্ণের পূজা করা হয়। বহুবিধ নিয়ম মেনে কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে রাস পূজা করা হয়।হিন্দুদের কাছে রাস অন্যতম বড় উৎসব। শ্রীকৃষ্ণের ব্রজলীলার অনুকরণে বৈষ্ণবীর ভাবধারার এই উৎসব। কথিত আছে রাস কথাটি এসেছে ‘রস’ থেকে। ‘রস’ মানে আনন্দ, দিব্য অনুভূতি, দিব্য প্রেম বা সার, নির্যাস, আনন্দ, আহ্লাদ, অমৃত ও ব্রহ্ম। ‘তৈত্তিরীয়’ উপনিষদে (২/৭) ‘রস’ সম্পর্কে বলা হয়েছে “রসো বৈ সঃ। অর্থাৎ ‘রস’ ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নয়।ভগবান শ্রীকৃষ্ণের তাত্ত্বিক রসে সমৃদ্ধ আধ্যাত্মিকতার সুখানুভূতি এই উৎসবের বিষয়বস্তু। যা শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাধা ও গোপিনীদের মধ্যেকার লীলা খেলা। ‘তৈত্তিরীয়’ উপনিষদে (২/৭) রাস সম্পর্কে বলা হয়েছে “রসো বৈ সঃ। অর্থাৎ ব্রহ্ম রস ছাড়া আরকিছুই নন। বৈষ্ণব দর্শনে এই রস বলতে মধুর রসকেই বোঝানো হয়েছে। আর পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ হলেন মধুর রসের ঘনীভূত আধার। তাঁকে ঘিরেই রাস। রাস কথাটির আভিধানিক অর্থ হল নারী-পুরুষের হাত ধরাধরি করে মণ্ডলাকারেনৃত্য। যাকে বলা হয় ‘হল্লীবক” নৃত্য। কিন্তু বৈষ্ণবদের কাছে রাস কথাটির ভিন্ন অর্থ বহন করে। শ্রীকৃষ্ণ শারদপূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনের যমুনাতটে গোপিনীদের আহ্বান করেন এবং তাদের অহং বর্জিত বিশ্বাস ভক্তি ভাবে তুষ্ট হয়ে সঙ্গদান করেন। তাই বৈষ্ণবদের কাছে রাস আসলে ভক্ত এবং ভগবানের মিলনউৎসব। জানা যায়,নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালে (১৭২৮-৮২) রাসের বাড় বাড়ন্ত শুরু হয়েছিল। রাজা হওয়ার পর থেকে ১৭৫০ পর্যন্ত কৃষ্ণচন্দ্র নানা সমস্যায় জর্জরিত থাকতেন।তার পর থেকে তিনি মঠমন্দির স্থাপন, মেলা উৎসবের সূচনা বা বহু জনকল্যঠু মূলক কাজে মনোনিবেশন করেন। ১৭৫৩-৫৬-রমধ্যে তিনি জগদ্ধাত্রীপুজো, বারোদোলের সূচনা করেন। মনে করা হয় ওই একই সময়ে তিনি নবদ্বীপে বৈষ্ণবদের রাস উৎসবের ভিন্নতা দেন। রাজানুগ্রহে অচিরেই সেই উৎসব ছাপিয়ে যায় বৈষ্ণবীয় রাসকে। দূর্গা পূজার পর লক্ষ্মীপূজো কালীপুজো ভাইফোঁটা জগদ্ধাত্রী পূজার মতো একে একে উৎসব হওয়ার পর পালিত হচ্ছে রাস পূর্ণিমা। আজকের দিনে শ্রীকৃষ্ণ ও রাধারানীর পূজা করলে তাদের আরাধনা করলে পাওয়া যায় তাদের বিশেষ কৃপা।কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমাকে বলা হয় কার্তিক পূর্ণিমা, যা এ বছরের ২৬ নভেম্বর রবিবার। তাই এই পূর্ণিমাকে কার্তিক পূর্ণিমাও বলে। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, এই পূর্ণিমায় উপবাস করলে একজন ব্যক্তি শত অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান ফল লাভ করেন। এই দিনে সূর্যোদয়ের আগে ব্রহ্ম মুহূর্তে স্নান করা শুভ বলে মনে করা হয়। এই পূর্ণিমার তাৎপযর্ হিন্দু ধর্মে এই পূর্ণিমাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, এই দিনে ভগবান শিব ত্রিপুরাসুর রাক্ষসকে বধ করেছিলেন। তাই এই পূর্ণিমা ত্রিপুরী বা ত্রিপুরারি পূর্ণিমা নামেও পরিচিত। অন্য একটি কিংবদন্তি অনুসারে, এই দিনে ভগবান শ্রী হরি বিষ্ণু মৎস্য অবতার গ্রহণ করেছিলেন। তাই এই দিনটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের সুমধুর বংশীধ্বনিতে মুগ্ধ হয়ে গোপিনীবৃন্দ আপনাপন কর্তব্যকর্ম বিসর্জন দিয়ে সংসারের সকল মোহ পরিত্যাগ করে বৃন্দাবনে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিজেদের সমর্পন করেছিলেন। প্রথমে শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের স্ব-গৃহে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন; বলেন, তাদের সংসার-ধর্ম পালন করা উচিত। কিন্তু গোপিনীরা নিজেদের মতে দৃঢ় ছিলেন। ভগবান ভক্তের অধীন। শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের দৃঢ়ভক্তি দেখে তাদের মনোকামনা পূরণার্থে রাসলীলা আরম্ভ করেন। কিন্তু যখনই শ্রীকৃষ্ণ তাদের অধীন বলে ভেবে গোপিনীদের মন গর্ব-অহংকারে পূর্ণ হল, তখনই শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের মধ্য থেকে অন্তর্ধান হয়ে গেলেন। শ্রীকৃষ্ণ যখন রাধাকে নিয়ে উধাও হলেন, তখন গোপিনীবৃন্দ নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন। ভগবানকে ‘একমাত্র আমার’ বলে ভেবে অহংকারের ফলে শ্রীকৃষ্ণকে তারা হারিয়ে ফেলেছিলেন। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ ত্রিজগতের পতি, তাই তাকে কোনো মায়া-বন্ধনে বেঁধে রাখা যায় না। তখন গোপিনীবৃন্দ একাগ্রচিত্তে শ্রীকৃষ্ণের স্তুতি করতে শুরু করেন। ভক্তের ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান গোপিনীদের মানব জীবনের পরমার্থ বুঝিয়ে দিয়ে তাদের অন্তর পরিশুদ্ধ করেন। গোপিনীদের ইচ্ছাকে তিনি সম্মান জানিয়ে ‘যতজন গোপিনী, ততজন কৃষ্ণ’ হয়ে গোপিনীদের মনের অভিলাষ পূর্ণ করেছিলেন আর গোপীবৃন্দও জাগতিক ক্লেশ থেকে মুক্তিলাভ করেছিলেন। এইভাবে জগতে রাসোৎসবের প্রচলন ঘটে। সুন্দরবনে শুরু হয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রাস উৎসব। ঐহিত্যবাহী এই উৎসবে যোগ দিতে ইতোমধ্যে দুবলার চরের আলোর কোলে সমাবেত হয়েছেন হাজারো পুণ্যার্থী। পূজা অর্চনার মধ্য দিয়ে শনিবার (২৫ নভেম্বর) সন্ধ্যায় শুরু হয় তিন দিনব্যাপী এ উৎসবের। সোমবার সকালে পূর্ণ স্নানের মধ্য দিয়ে শেষ হবে উৎসব। সাথে এই ৩ দিন বনের ভিতরে নির্ভয়ে চলাফেরা করে মেলায় আগত মানুষ। শত শত নৌকা-ট্রলার ও লঞ্চের সমাগমে স্থানটি সজ্জিত হয়ে ওঠে আলোর ঝলকে। সন্তানহীন ধর্মনুরাগী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা দুবলার মেলায় মানত করেন এবং মেলায় এসে মানতকারীরা আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করে থাকেন। মেলায় বাদ্য, নৃত্য, গীত ও বিবিধ প্রকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে। পসার বসে কুটির শিল্পের দোকান ছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, ফল-ফলাদি, মিষ্টান্ন, মনোহারির সামগ্রীর। দুবলার রাস মেলায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও আসেন ভারত, আমেরিকা, মিয়ানমারসহ আশপাশ দেশের বিদেশি পর্যটক। অর্ধ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর এ উৎসবে অংশ নেন। বিভিন্ন রকম হস্তশিল্প সামগ্রীর সমাগম ঘটে এ মেলায়। হিন্দুদের নানান পূজার্চনার ফাঁকে সন্ধ্যায় ওড়ানো হয় ফানুস। মেলার মূল প্রার্থনা শুরু হয় ভোরের প্রথম জোয়ারে পুণ্য স্নানের মধ্য দিয়ে। এইদিন সূর্য ওঠার আগেই সমুদ্রের বেলাভূমিতে প্রার্থণায় বসেন পুণ্যার্থীরা। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রেও জোয়ার শুরু হয়। জোয়ারের পানি পুণ্যার্থীদের ছুঁলেই স্নানে নামেন তারা। দীর্ঘ বিরতির পর সুন্দরবনে মাছ ধরার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় রাস মেলার এই প্রার্থনার মধ্য দিয়ে। তাই জেলেরা এই দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে থাকে। কারন মাছ ধরেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। দুবলার চরে কয়েক হাজার জেলের বসবাস। সমুদ্র থেকে মাছ ধরে এসব জেলেরা এখানে সাধারণত শুঁটকি তৈরি করেন। এ জায়গায় তাই দেখা যাবে জেলেদের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা। এছাড়া জেলেদের মাছ ধরার নানান দৃশ্য আর কলাকৌশলও দেখা যাবে দুবলার চরে।
রাস, ভক্ত এবং ভগবানের মিলন উৎসব
পূর্ববর্তী পোস্ট