সচ্চিদানন্দ দে সদয়: দশমীতে মা দুর্গা কৈলাসে ফিরে গেছেন তাই আকাশে বাতাসে আজ বিষাদের সুর। চারিদিকে কিছুটা হলেও মন খারাপের পরিবেশ। কিন্তু হিন্দুদের তো বারো মাসে তেরো পার্বণ একটা শেষ হতে না হতেই আর একটা পার্বণ শুরু। একইভাবে পরপর আসে, মহালয়া, দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজার শেষ হতে না হতেই এসে যায় কোজাগরী লক্ষী পূজা। তাই বিষাদ ভরা মন নিয়ে মা দুর্গা কে বিদায় জানালেও কয়েকদিনের মধ্যেই মা লক্ষ্মী সেই বিষাদ দূর করে মনে প্রাণে আনন্দের দোলা লাগিয়ে বাঙালির ঘরে ঘরে অধিষ্ঠিত হন। ঘরে ঘরে শুরু হয় দেবী লক্ষ্মীর আরাধনার তোড়জোড়। আশ্বিন মাসের শেষে পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার দিন। বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে এবছরের কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর তিথি পডছে ১২ কার্ত্তিক শনিবার, ১৪৩০। কথিত আছে, কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমে আসেন দেবী লক্ষ্মী। এই কারণে বলা হয় এই শরৎ পূর্ণিমায় কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো সন্ধ্যার সময় করাই শুভ। শাস্ত্র পুরাণে লক্ষ্মীদেবীকে আদিশক্তি ভগবতী দেবী রূপে মানা হয়েছে। লক্ষ্মী ধন-দৌলত, অর্থের দেবী। তাঁর কৃপাতেই মানুষ ধন-দৌলত-সুখ-স্বাচ্ছন্দ-যশ-মান প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তাঁর দয়া মমতা মহাসাগরের মতো। তিনি কখনও কারও প্রতি কঠোর হোন না। যে কোনও মানুষ যদি ভক্তি ভরে ব্যাকুলভাবে তাঁর আরাধনা করেন তাহলে দুর্ভাগ্য দূর হয়ে, সৌভাগ্য আসে এবং ধনলাভ ঘটে। তাই হিন্দু গৃহস্থরা সারাবছর ধরেই প্রতি বৃহস্পতি বার মা লক্ষীর পূজা করে থাকেন। কেউ কেউ আবার কালীপুজোর দিনেও লক্ষ্মী পূজা করে থাকেন। এছাড়াও মা লক্ষ্মী সম্পদদায়িনীর বলে ভাদ্র সংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তি ও চৈত্র সংক্রান্তিতে এবং আশ্বিন শেষ পূর্ণিমাতে, দীপাবলীতেও লক্ষ্মীর পুজো হয়। তবে আশ্বিন মাসের শেষ পূর্ণিমায় যে লক্ষ্মী পূজা হয় তা হল কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা। দেবী লক্ষ্মীর বন্দনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, গভীর রাতে ভক্তিভরে কে জাগে আজ, কে জাগে।/ সপ্ত ভুবন আলো করে লক্ষ্মী আসেন, কে জাগে।/ ষোলো কলায় পূর্ণ শশী, নিশার আঁধার গেছে খসি/ একলা ঘরের দুয়ার পরে কে জাগে আজ, কে জাগে।’- এই গান। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, কোজাগরী পূর্ণিমার দিন দেবী লক্ষ্মী নিশিথ রাতে প্রতিটি মানুষের গৃহে বলে থাকেন- ‘কে আছো জেগে?’ এই দিনেই দেবী লক্ষ্মীর বন্দনা করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। ‘কোজাগরী’ কথাটির অর্থ ‘কে জেগে আছ?’ হিন্দু পুরাণ মতে, আশ্বিনের এই পূর্ণিমার রাতে দেবী লক্ষ্মী এসে ঘরে ঘরে খোঁজ নিয়ে যান, কে জেগে আছে। এই রাতে যে ব্যক্তি জেগে দেবীর আরাধনা করেন তাঁর ঘরেই প্রবেশ করেন দেবী লক্ষ্মী। প্রাচীন রীতি অনুযায়ী গোলাঘরকে লক্ষ্মীর প্রতীক বলা হয়। ধানক্ষেতের আশেপাশে ইঁদুর বা মূষিকের বাস এবং এরা ধানের ক্ষতি করে থাকে। পেঁচক বা পেঁচার আহার হল এই ইঁদুর। সেই কারণ হেতু পেঁচা দেবীর বাহন। অনেকেই সারা বছর প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর পুজো করে থাকেন। তবে মনে করা হয় কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মীকে পুজো করে ঘরে আনলে গৃহে ধন-সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়, সৌভাগ্য ফিরে আসে ও ভক্তদের অপার আশীর্বাদ প্রদান করেন। অন্যান্য পূজা আর কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার আলপনাতে বেশ কিছু পার্থক্য থাকে। এই পূজাতে মূল আল্পনার সঙ্গে বাড়তি আঁকা হয় ধানের ছড়াা, মুদ্রা, আর মা লক্ষ্মীর পায়ের ছাপের ছবি। এই প্রতীকগুলি পূজার মহত্ত্ব যেমন ব্যাখ্যা করে, তেমনই পূজার আচারের একটা অংশ হয়ে উঠেছে এই বিশেষ ধরনের আলপনা। বেতের ছোট আড়িতে ধান ভর্তি করে তার ওপর দুটি কাঠের লম্বা সিঁদুর কৌটো লালচেলি দিয়ে মুড়ে দেবীর রূপ দেওয়া হয়। কাজাগরী লক্ষ্মীপূজার ভোগে অনেক বাড়িতেই জোড়া ইলিশ রাখা হয়। তবে ভোগ হিসাবে খিচুড়ি থাকা আবশ্যিক। সঙ্গে প্রসাদে ফলমূল তো থাকেই, থাকে নারকেলের নাড়ুু, তিলের নাড়ু, ভুশের নাড়ু। এছাড়াও লুচি, পায়েস, মিষ্টির নানা আয়োজন। আবার অনেক জায়গায় এই দিন পুরো নিরামিষ খাওয়া দাওয়া করা হয়। এবং চালের কোনো রান্না করা হয় না। ধান হল লক্ষ্মীর প্রতীক। চাল, অন্ন, খাদ্যশস্য হল লক্ষ্মীর প্রতীক। তাই যারা খাদ্য অপচয় করেন, তাদের ওপর দেবী লক্ষ্মী কখনোই তুষ্ট হন না। ধানক্ষেতের আশেপাশে ইঁদুর বা মূষিকের বাস এবং এরা ধানের ক্ষতি করে থাকে। পেঁচক বা পেঁচার আহার হল এই ইঁদুর। গোলাঘরকে লক্ষ্মীর প্রতীক বলা হয়। গোলাঘরের আশেপাশে ইঁদুরের বসবাস। পেঁচা এই ইঁদুরকে খেয়ে খাদ্যশস্য রক্ষা করে।লক্ষ্মীর মূর্তি পূজা ছাড়াও নানান ভাবে লক্ষ্মীদেবীকে কল্পনা করে এদিন তাঁকে পূজা করা হয়। যেমন- আড়ি লক্ষ্মী। আবার কলার পেটোর তৈরি নৌকা (সপ্ততরী) লক্ষ্মী আরাধনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাণিজ্যিক নৌকার প্রতীক এই সপ্ততরী। অনেকেই পূজার সময় এই সপ্ততরীতে টাকা, শস্য, হরিতকি, কড়িতে, হলুদ রাখেন। কেউ কেউ আবার সরায় পটচিত্রের সাহায্যেও লক্ষ্মীপূজা করেন। যেমন- ঢাকাই সরা, ফরিদপুরি সরা, সুরেশ্বরী সরা ও শান্তিপুরি সরা। সরায় পাঁচ, সাতটি দেব দেবীর ছবি আঁকা হয়। যেমন লক্ষ্মী, জয়া ও বিজয়া, রাধাকৃষ্ণ, সপরিবারে দুর্গা ইত্যাদি। সুরেশ্বরী সরায় মহিষাসুরমর্দিনী আঁকা থাকেন আর এই সরার নীচের দিকে থাকেন সবাহন লক্ষ্মী। প্রাচীনকাল থেকেই রাজা-মহারাজা, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি বাঙালি হিন্দুর ঘরে লক্ষ্মীপূজা করা হয়। এ উপলক্ষে হিন্দু নারীরা উপবাস ব্রত পালন করেন। মন্দিরের চেয়ে ঘরোয়া পরিবেশে পূজার আনুষ্ঠানিকতা বেশি করা হয়। পূজা-অর্চনার পাশাপাশি ঘরবাড়ির আঙিনায় আঁকা হবে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপের আল্পনা। সন্ধ্যায় ঘরে ঘরে প্রদীপ প্রজ্বলন করা হয়। বাঙালি বিশ্বাসে লক্ষ্মীদেবী দ্বিভূজা ও তার বাহন পেঁচা এবং হাতে থাকে শস্যের ভান্ডার। তবে বাংলার বাইরে লক্ষ্মীর চতুর্ভূজা কমলে-কামিনী মূর্তিই বেশি দেখা যায়। কোজাগরী লক্ষ্মীর প্রতি আচার নিবেদনের সাথে একটি লৌকিক বিশ্বাস জড়িয়ে আছে। পুজোর সময় মোট ১৪টি পাত্রে উপাচার রাখা হয়। তারপর পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে জলদানের একটি রীতি রয়েছে। কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোয় কাঠের জলচৌকির ওপর লক্ষ্মীর সরাটিকে স্থাপন করা হয়। এইদিন কলাপাতার মধ্যে টাকা, স্বর্ণমুদ্রা, ধান, পান, কড়ি, হলুদ ও হরিতকি দিয়ে সাজানো হয়। পুজোর স্থানটিকে। বৈদিক শাস্ত্র ও বিভিন্ন পুরাণ অনুসারে পূজিতা দেবী লক্ষ্মী বাঙালির ঘরের দেবী। দুর্গাপুজো যেখানে বারোয়ারি পুজো, সেখানে প্রতি ঘরে ঘরে মেয়ে-বৌমারা মিলেই লক্ষ্মী দেবীর ঘট পেতে পুজো করে ফেলেন অনায়াসে। আসলে দেবী লক্ষ্মী চঞ্চলা হলেও ক্রোধ সম্পন্না দেবী নন, তাই তার পুজো করার আগে কোন সাতপাঁচ ভাবনায় পড়তে হয়না মানুষকে। লক্ষ্মী বারে সামান্য ফুল, বাতাসা আর পিঁড়ি ধুয়ে চাল পিটুলির আলপনা এঁকেই মায়ের যে পুজো করার রীতি আছে, কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার রাতে সেই পুজোটিকেই একটু বড় আকারে করা হয়। (সংকলিত)
আজ কোজাগরি লক্ষ্মী পুজা
পূর্ববর্তী পোস্ট