
নিজস্ব প্রতিবেদক: জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে দেশের সর্ব দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জনপদ সাতক্ষীরার উপকূলীয় মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মূখে। উপকূলীয় উপজেলা আশাশুনি, দেবহাটা, কালিগঞ্জ ও শ্যামনগরের কৃষি, জীববৈচিত্র, পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ্য হচ্ছে। গত কয়েক দশক ধরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে নিম্নাঞ্চল নিমজ্জ্বিত ও লবণাক্ত পানি বৃদ্ধিসহ প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ¡াসের আঘাতে এ অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্থ্য হচ্ছে। ফলে এখানকার মানবসম্পদ ও অর্থনীতি আজ হুমকির মূখে। নদী ও প্রকৃতির সাথে লড়াই করে টিকতে না পেরে হাজার হাজার উপকূলবাসী বাপ-দাদার ভিটামাটি ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করছে।
জানা গেছে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ ও ২ এর অধীনে জেলায় উপকূলীয় বেড়িবাঁধ রয়েছে ৬৮০ কিলোমিটার। এর মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডে-১ এর আওতায় রয়েছে সাতক্ষীরা সদর (আংশিক), দেবহাটা, কালিগঞ্জ এবং শ্যামনগর (আংশিক) ৩৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর আওতায় তালা, কলারোয়া, সাতক্ষীরা সদর (আংশিক), আশাশুনি ও শ্যামনগর (আংশিক) উপজেলায় ৩০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। ৬০ এর দশকে নির্মিত ওয়াপদার এই বাঁধ এখন উপকূলের মানুষের জন্য নিরাপদ নয়। এসব বেড়িবাঁধের মধ্যে শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার ৫৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ও কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়াসহ বিভিন্ন নদ-নদীর উচ্চ জোয়ারের চাপে বেড়িবাঁধ ভেঙে আবারও প্লাবিত হওয়ার শংকায় রয়েছে। প্রলয়ংকারি ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রায় চার মাস অতিবাহিত হলেও সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের শ্রীপুর, কুড়িকাহুনিয়া, কল্যাণপুর, নাকনা, সনাতনকাটি, প্রতাপনগর পশ্চিম ও পূর্বর্ প্রতাপনগর এলাকার ২৫ হাজার মানুষ এখনো লোনা পানির জোয়ার ভাটার মধ্যে বসবাস করছে। কপোতাক্ষ নদ এবং খোলপেটুয়া নদীর নোনা পানি প্রতানগরের বন্যতলা এবং কুড়িকাউনিয়া বাঁধ দিয়ে প্রবশ করে পুরো এলাকা জোয়ার ভাটা চলছে। ইউনিয়নের রাস্তা ঘাট, ঘরবাড়ির আঙ্গিনা পানিতে ডুবে আছে। চরম দূর্ভোগ নিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে ভূক্তভোগীদের। এসব বানভাসি মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে বাড়ি থেকে বের হতে হয় বাঁশ ও কাঠের ভেলা অথবা নৌকায়। এখানকার ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেনের দাবি ৪০ ভাগ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে অবস্থান নিয়েছেন অন্যত্র। আর ২০ ভাগ মানুষ বসবাস করছে জেগে থাকা বেঁড়িবাধের উপর টংঘর বেঁধে। আর বাকীরা নদীর জোয়ার ভাটার পানির মধ্যে বসবাস করছে চরম দূর্ভোগ আর কষ্টে।
প্রতাপনগর ইউনিয়নের কল্যানপুর ৮নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ৮২ বছরের বৃদ্ব আজিবর গাজী বলেন, প্রতাপনগরের এত ভয়াবহ খারাপ অবস্থা আগে কখনো দেখিনি। গত ৮ অক্টোবর শুক্রবার প্রবল জোয়ারে খোলপেটুয়া নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় প্রতাপনগর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী হাওলাদার বাড়ি বায়তুন নাজাত জামে মসজিদটি। এলাকায় কেউ অসুস্থ হলে নৌকা করে অনেক কষ্টে নিয়ে যেতে হয় উপজেলা হাসপাতালে। মৃত্যু হলে মাটি দেওয়ার মতো কোন উচু জায়গা নেই। সব পানিতে তলিয়ে আছে। চারিদিকে পানি আর পানি। নোনা পানির কারনে ফসল ফলে না। তাই কর্মহীন মানুষ। কাজ নেই, খাদ্য ও খাবার পানি সংকট। অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। অনেকে সাইক্লোন সেন্টার এবং ওয়াপদার বেড়িবাঁধের উপর আশ্রয় নিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছে। অনেকে এখনও বাড়ি ফিরতে পারেনি। আমরা ত্রাণ চাই না, আমাদের একটাই দাবী টেকসই বেঁড়িবাধ।
আশাশুনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অসিম বরণ চক্রবর্তী জানান, সাতক্ষীরার উপকূলে প্রায় ২৫ শতাংশ স্থানে বেড়িবাঁধের চিহ্ন বিলিন হয়েগেছে। ৫০ ভাগ বেড়িবাঁধ কম-বেশি বিধ্বস্ত ও জরাজীর্ণ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একশ্রেণির অসৎ প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী-ঠিকাদার মিলে সংঘবদ্ধ চক্র বেড়িবাঁধ নির্মাণের নামে নয়-ছয় করেই সারাবছর করেন সংস্কারের কাজ। পাউবো কর্মকর্তাদের যোগসাজসে নামমাত্র কাজ করেই বিল মোটা অঙ্কের টাকা উত্তোলন করেন ঠিকাদাররা। ফলে ভাঙাচোরা বেড়িবাঁধ উপকূলবাসীর মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। বেড়িবাঁধ সংস্কার, জোড়াতালি মেরামত কাজের মান নিয়ে উপযুক্ত তদারকি, যাচাই, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার কোন সুষ্ট ব্যবস্থা নেই। যার ফলে মানসম্মত কাজ না হওয়ায় বেড়িবাঁধ টিকছে না। এসকল দায়সারা গোছের কাজের কারনে বিপন্ন উপকূল বাসির জীবন জীবিকা।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, আম্ফানের আঘাতে সাতক্ষীরায় ১৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। ৮৩ হাজার ৪৩১টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্থ হয় ও ৮১ কিলোমিটার রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া সাড়ে ৫৬ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৭৬ কোটি ৩ লাখ টাকা মৎস্য খাতে ও কৃষিতে মোট ১৩৭ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং প্রাণিসম্পদে ৯৫ লাখ ৩৮ হাজার ৬১৬ টাকার ক্ষতি হয়।
এর আগে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় বুলবুল এর আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় উপকূলীয় অঞ্চল। হাজার হাজার বিঘা ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়। ঘরবাড়ি, গবাদি পশু, গাছপালা ইত্যাদি ক্ষতির পাশাপাশি ১৮ জনের প্রাণহানি ঘটে।
একই বছরের ১২ মে উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ফণী। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে ৫৩৬ কোটি ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষয় ক্ষতি হয়। চলতি বছরের ২৬মে ঘূণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ¡াসে আবারও রিং বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়।