আতিয়ার রহমান, মণিরামপুর (যশোর) থেকে: মণিরামপুরের পৌরশহরের মহাদেবপুর জুনিয়র স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, যদি শিক্ষকতার পেশায় না এসে চা বিক্রেতা হতাম তাহলে অন্তত: ঈদে বউ বাচ্চাদের নতুন পোশাক কিনে দিতে পারতাম। গত ২১ বছর শিক্ষকতা করে কিছুই দিতে পারেননি পরিবারের সদস্যদের। এমন আক্ষেপের কথা জানিয়েছেন, সি.টি.কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মলয় কুমার রায়। তার বিদ্যালয়টি স্থাপিত ১৯৯১ সালে। কিন্তু আজও বিদ্যালয়টি এমপিও ভূক্ত হয়নি। তিনি বলেন, গত ২৫ বছর শিক্ষকতা করে চলেছি, কোন দিন স্ত্রী সন্তানদের বলতে পারেননি আজ আমার চাকুরীর বেতন হয়েছে। চার বছর পরেই অবসরে যাবো, কিন্তু বেতন সৌভাগ্যে আছে কিনা তাও বলতে পারি না। শুধু মিজান-মলয় নয়, উপজেলার চারটি কলেজ, আটটি দাখিল মাদ্রাসা এবং আটটি মাধ্যমিক ও জুনিয়র স্কুলের চার শতাধিক শিক্ষক বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন দীর্ঘদিন যাবত।
খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমানের বিদ্যালয় মহাদেবপুর জুনিয়র স্কুলটি ২০০০ সালে স্থাপিত হয়। এ বিদ্যালয়টিতে সাতজন শিক্ষক কর্মচারী এমনই বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ৩৩ বছর এমপিওভুক্ত না হওয়া বড় চেৎলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিতাই বসু জানানা, ১৯৯৭ সালে বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়টি পূর্ণাঙ্গ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১৭জন শিক্ষক-কর্মচারী দীর্ঘদিন কর্মরত আছি। খুব শিঘ্রই আমি প্রধান শিক্ষক নিতাই বসু এবং কৃষি শিক্ষক গোবিন্দ চন্দ্র অবসরে যাচ্ছি। কিন্তু বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে গত ৩৩টি বছর বেতন হিসেবে সরকারের একটি টাকাও ভাগ্যে জোটেনি। আর জোটবে কিনা তাও অনিশ্চিত। তবে বেতন না পেয়ে যেমন কষ্টের মধ্যে শিক্ষক পরিবারগুলো রয়েছেন তা কেবলমাত্র ভুক্তভোগীরা ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারবেন না।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বিকাশ চন্দ্র সরকার বলেন, মণিরামপুরের ২১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত না হওয়ায় সেখানে কর্মরত শিক্ষক কর্মচারীরা বছরের পর বছর অর্থাভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ঢাকুরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ তাপস কুমার কুন্ডু জানিয়েছেন, ১৯৯৯ সালে কলেজটি স্থাপিত হয়েছে। কলেজটি আজও পর্যন্ত এমপিও ভূক্ত হয়নি। যার ফলে ২৯জন শিক্ষক-কর্মচারী অর্থাভাবে চরম কষ্টের মধ্যে রয়েছেন। এরই মধ্যে কলেজের সরকারী দেওয়া তিন তলা বিশিষ্ট ভবনও করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কি বা আসে যায় শিক্ষক-কর্মচারীদের। চিনাটোলা কলেজের অধ্যক্ষ সাজ্জাদ হোসেন জানান, ২০০২ সাল থেকে কলেজে ৩২জন শিক্ষক কর্মচারী বেতন না পেয়ে অর্থাভাবে চরম কষ্টে দিন কাটাতে হচ্ছে। বহু চেষ্টা করেও আজও পর্যন্ত এমপিও ভূক্ত করা সম্ভব হয়নি।
এ আর মুক্তিযোদ্ধা মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মিলন কুমার ঘোষাল জানালেন, বেতন না পেয়ে এখন শিক্ষক কর্মচারীদের মাঝে অনিহা সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষক কর্মচারীদের ধারনা প্রতিষ্ঠান মনে হয় আদৌ এমপিওভূক্ত হবে না। বেতন না পাওয়া এ তালিকায় রয়েছেন মাতৃভাষা কলেজ এবং সবুজ পল্লী কলেজও। এরমধ্যে মাতৃভাষা কলেজে অবকাঠামো দৃশ্যমান রাখতে সরকার কোটি টাকার ভবন করে দিয়েছেন। যে কারণে অনেকেই কর্মক্ষেত্রে অনিহা দেখা দিয়েছে।
মহাদেবপুর জয়নগর দাখিল মাদ্রাসার সুপার মাওলানা জসিম উদ্দীন একই কষ্টের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ১৭জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়ে সেই গত ২০০০ সাল থেকে বিনা বেতনে চাকুরী করে যাচ্ছি। কবে সরকারের মর্জি হবে তাও বলা মুশকিল। এহেন অবস্থায় শিক্ষক কর্মচারীদের অর্থাভাবে চরম কষ্টে দিন কাটছে। তিনি জানান, বড় কষ্টের দিন হচ্ছে প্রতি বছরের দুটি ঈদ উৎসবের সময়। এ সময় শিক্ষকরা ইচ্ছা করলেই তাদের সন্তানদের চাহিদা মেটাতে পারেন না। পারেন না অন্য কোন উপায়ে অর্থ উপার্জন করতে। ফলে নিধারন কষ্টের দিন কাটাতে হচ্ছে সকলের। নেহালপুর দাখিল মাদ্রাসার সুপার মাওলানা আজিজুর রহমানও একই কষ্টের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বয়সের যে পর্যায়ে পৌছুয়েছি তা শিক্ষকতা ছেড়ে এখন অন্য কিছু করাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে চরম কষ্টে কাটাতে হচ্ছে বছরের পর বছর। মদিনাতুল উলুম মহিলা দাখিল মাদ্রাসার সুপার গোলাম রব্বানী জানান, এভাবে আর জীবন চলে না। অর্থ নষ্ট করে প্রতিষ্ঠান গড়ে বছরের পর বছর বেতন না পেয়ে শিক্ষক কর্মচারীরা এখন চরম কষ্টের মধ্যে দিনাতি পাত করছেন। লক্ষণপুর আদর্শ মহিলা মাদ্রাসা, পাড়দিয়া মহিলা দাখিল মাদ্রাসা, দিঘীরপাড় মহিলা দাখিল মাদ্রাসা এবং ইত্যা সুইচগেট দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক কর্মচারীদের অবস্থা একই। এ মাদ্রাসার সুপার রুহুল আমিন জানান, রোজা থেকেও পয়সার অভাবে অন্যের ক্ষেতে মজুরী খাটছে শিক্ষক কর্মচারীদের কেউ কেউ। এছাড়া কয়দিন বাদে ঈদুল ফিতর। বউ বাচ্ছাদের হাতে কিছু দিতে এখন অনেকেই অন্যের জমিতে শ্রম বিক্রি করছেন। এর বাইরেও উপজেলার পৌরসভা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, চাঁদপুর-মাঝিয়ালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম-দশম শ্রেণিতে নিয়োগকৃত শিক্ষকরাও বছরের পর বছর বেতন পাননা। এ তালিকায় আরও রয়েছে গোপালপুর স্কুল এন্ড কলেজ, নেংগুড়াহাট কলেজিয়েট এবং রাজগঞ্জ মহিলা আলিম মাদ্রাস একাদশ শ্রেণির জন্য কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীরাও সরকারী বেতনভাতা পাননি আজও। এসব শিক্ষক-কর্মচারীদের অধিকাংশই অপেক্ষার পর অপেক্ষা করে বয়সের শেষ প্রান্তে পৌছে যেতে বসেছে। এ অবস্থায় তাদের সংসার জীবনও থমকে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য ভুক্তভোগী শিক্ষক-কর্মচারীবৃন্দ বেতন পাওয়ার ব্যবস্থা করতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।