
হাফিজুর রহমান: আম্পান এবং করোনাকালীন লকডাউনের সময় কর্মহীন হয়ে পড়া উপকূলীয় অঞ্চলে অসহায়, দুস্থ, ক্ষতিগ্রস্থ প্রান্তিক মৎস্য চাষী , ঘের মালিকদের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার লক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব তহবিল হতে উপকূলীয় অঞ্চল কালিগঞ্জ উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকার প্রনোদনার বরাদ্দ দিয়েছেন। দুস্থ, অসহায় মৎস্য ব্যবসায়ী, ঘের মালিকদের টাকার প্রাপ্তিতে যাতে কোনো প্রকার অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারীতা, স্বজনপ্রীতি, দূর্নীতি না হয় সেটা ঠেকাতে সঠিক তালিকা করে প্রত্যেকের ব্যবহৃত নিজিস্ব মোবাইল নাম্বারে বিকাশ একাউন্ট খোলার নির্দেশ দেন। কোনো প্রকার অনিয়ম দূর্নীতির হাত থেকে বাঁচতে সরাসরি যাতে মৎস্য চাষী, ঘের মালিকদের বিকাশ একাউন্টে টাকা পৌছে যায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রনোদনার তালিকা তৈরি এবং বিকাশ একাউন্ট খোলা এবং টাকা প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘুষ বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারীতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। কালিগঞ্জ উপজেলা জুড়ে ১২টি ইউনিয়নের ৫ হাজার ৩শ ৭২ জনকে তালিকা ভুক্ত করা হয়। ইতোমধ্যে তালিকার প্রায় ৯০ ভাগ মৎস্য চাষী, ঘের মালিকদের বিকাশ নাম্বারের মাধ্যমে টাকা পেলেও অধিকাংশ মৎস্য চাষী ২ থেকে ৫ হাজার টাকার বেশি পাইনি বলে ভুক্তভোগীরা প্রতিনিয়ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদের ভাইচ চেয়াম্যানের নিকট অভিযোগ নিয়ে ভীড় জমাতে দেখা গেছে। প্রনোদনার টাকা ৩টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে যাদের ২ একরের নীচে তাদেরকে ১৩ হাজার, যাদের ২ একরের উর্দ্ধে তারা পাবেন ১৮ থেকে ২৪ টাকা করে। সেই অনুযায়ী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের তালিকা তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তালিকা তৈরির সময় প্রতিটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য এবং মৎস্য অফিস থেকে একজন করে নিয়োগকৃত প্রতিনিধি থাকবে। প্রনোদনার টাকা সরাসরি মৎস্য চাষীরা হাতে পেয়ে কেটে না রাখার সুযোগ থাকলেও উপজেলার গুটি কয়েক শীর্ষ কর্মকতার মাধ্যমে নিয়োগকৃত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সুকৌশলে সুক্ষ্ম দূর্নীতির মাধ্যমে উপজেলা মৎস্য অফিসে দালাল খ্যাত ১২টি ইউনিয়নের ১২জন প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়। এই ১২জন মৎস্য অফিসের দালাল দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে স্ব স্ব ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বর বা ক্ষমতাশীন দলের লোকদের না জানিয়ে নিজেদের ইচ্ছে মত ভাই, বোন, বাবা, মা, আত্বীয়স্বজন, জমি নাই, ঘের নাই, প্রাপ্ত, অপ্রাপ্ত বয়স্ক, ভারতে বসবাসকারী তাদেরকে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে তালিকা তৈরির সময় মোটা অংকের টাকা প্রদানের লোভ দেখিয়ে ঘুষ বাণিজ্যে তালিকায় অন্তর্ভূক্তি করে টাকা হাতিয়ে নেয় বলে ভুক্তভোগীরা জানান। তাছাড়া তালিকায় যাদের নাম দেওয়া হয় তাদের প্রত্যেকের নিকট থেকে ৬০ টাকা করে নিয়ে প্রত্যেকের জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে একটি করে মোবাইল সিম ক্রয় করে বিকাশ একাউন্ট খুলে ইউনিয়নে নিয়োগকৃত মৎস্য অফিসের প্রতিনিধিরা রেখে দেয়। অনুদানের টাকার ম্যাসেজ আসলে তাদের অধিকাংশ তালিকার ব্যক্তিদের কাছ থেকে ২ থেকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে বিদায় দেওয়া হয়। বাকী টাকা দালালরা আত্মসাৎ করে। অধিকাংশ তালিকাভুক্ত মৎস্য চাষী, ঘের মালিকরা জানান তারা জানেও না তাদের বিকাশ একাউন্টে কত টাকা এসেছিলো। এইভাবে এই চক্রটি উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের নিয়োগকৃত মৎস্য অফিসের দালালের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা অর্থ বাণিজ্য করেছে বলে ভুক্তভোগীরা জানান। নিয়োগকৃত মৎস্য অফিসের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের এনজিও নাম ভাঙিয়ে তালিকা তৈরি করে সই নিয়েছে বলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা সাংবাদিকদের জানান। এনজিও’র কথা বলায় তালিকা তৈরির সময় গুরুত্ব না দিলেও টাকা পাওয়ার পরে প্রকৃত মৎস্য চাষী, ঘের মালিকদের রোষানালে বর্তমান চেয়ারম্যানরা। ঘটনা ফাঁসের পর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের দোহাই দিলেও চেয়ারম্যানরা তালিকার ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানান। এই ভাবে ৫ হাজার ৩শ ৭২ জনের নামের তালিকা তৈরি করে ১২টি ইউনিয়ন হতে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তালিকা তৈরির জন্য যারা মৎস্য অফিস থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন তারা হলেন ১নং কৃষ্ণনগরের আবু রায়হান, ২ নং বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের আব্দুর রহমান মোড়ল, ৩নং চাম্পাফুল ইউনিয়নের চান্দুলিয়া গ্রামের শহর আলীর পুত্র রজব আলী, তার নিজস্ব কোনো জমি জমা না থাকলেও সে তার পিতার নামে ১৮ হাজার এবং ভাইয়ের নামে ১৩ হাজার টাকা উত্তোলন করে নিয়েছে। ৪নং দক্ষিনশ্রীপুর ইউনিয়নে এস.এম আমিনুল ইসলাম, ০৫নং কুশুলিয়া ইউনিয়নের জি.এম মনিরুল ইসলাম, ০৬নং নলতা ইউনিয়নে সামছুদ্দীন হক, ০৭নং তারালী ইউনিয়নে বাসুদেব সরকার, ০৮নং ভাড়াশিমলা ইউনিয়নের মোস্তাফিজুর রহমান, ০৯নং মথুরেশপুর ইউনিয়নের গোলাম ফারুক, ১০নং ধলবাড়িয়া ইউনিয়নের মোস্তফা আলম, ১১নং রতনপুর ইউনিয়নের আব্দুর রফিক গাজী, ১২নং মৌতলা ইউনিয়নের রায়হান। এসমস্ত দালালরা প্রকৃত মৎস্যজীবি, ঘের মালিকদের নাম না দিয়ে স্বজনপ্রীতি, দূর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে তালিকা তৈরি করে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কাজ করলেও তারাও তাদের প্রশ্রয়দানকারী কর্মকর্তারা রয়েছে ধরা ছোয়ার বাইরে। তবে কারা এই কোটি কোটি টাকার দূর্নীতির নেপথ্যে সে প্রশ্ন এখন উপজেলাবাসীর। বিষয়টি ফাঁস হলে গত ৩১ শে ফেব্রুয়ারী উপজেলা চত্বরে মৎস্য চাষীদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচীর পর হতে এ পর্যন্ত জেলা, উপজেলা সহ বিভিন্ন দপ্তরে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। বিষয়টি উপজেলাবাসী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে তদন্ত করে এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে। বর্তমান উপজেলা জুড়ে মৎস্য চাষী ও ঘের মালিকদের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। ঘটনার সত্যতা জানার জন্য উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নিকট জিজ্ঞাসা করলে তারালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও থানা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হোসেন ছোটো, চাম্পাফুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক গাইন সহ একাধিক চেয়ারম্যান সাতনদীকে জানান, করোনাকালীন লকডাউনের সময় বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতার জন্য জনগনের কাছে একাধিকবার পরিচয়পত্র চাওয়া হয়। এতে করে সাহায্য পাওয়া, না পাওয়া নিয়ে জনগন বিরক্ত হয়। পরবর্তীতে কয়েক মাস আগে এনজিও পরিচয়ে মাছের ঘেরের তালিকার নামে আমাদের নিকট থেকে সই করিয়ে নিয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর প্রনোদনার টাকা সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না বলে জানান। উপজেলা মৎস্য অফিসের নিয়োগকৃত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তালিকা করে হয়েছে বলে জানান। এব্যাপারে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সফিকুল ইসলামের নিকট জিজ্ঞাসা করলে তিনি সাতনদীকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রনোদনার টাকা আসার খবরে উপজেলায় মিটিং করে প্রত্যেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদেরকে বলা হয় স্ব স্ব ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেম্বররা তালিকা তৈরি এবং সহি করে সম্পাদন করলে সে মোতাবেক প্রনোদনার টাকা পায়। অনিয়ম, ঘুষ, দূর্নীতি বিষয়ে তিনি অস্বীকার করেন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদীর নিকট জিজ্ঞাসা করলে তিনি সাতনদীকে জানান, এখান থেকে কয়েক মাস আগে প্রধানমন্ত্রী প্রনোদনার টাকা ঘোষনা দিলে প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নিয়ে সভা করে তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়। তাদের দেওয়া এবং স্বাক্ষরিত তালিকায় প্রনোদনার টাকা দেওয়া হয়েছে। এব্যাপারে কোনো স্বজনপ্রীতি ও দূর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়নি। এমন কোনো ঘটনা ঘটলে তা তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উপজেলা পরিষদের ভাইচ চেয়ারম্যান নাজমুল ইসলাম সাতনদীকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রনোদনার টাকা প্রসঙ্গে কিছু জানেন না বলে জানান। মৎস্য অফিসের নিয়োগকৃত দালালদের মাধ্যমে মনগড়া তালিকা তৈরি করে প্রকৃত মৎস্য চাষীদের বাদ দিয়ে তালিকা তৈরি এবং প্রত্যেকের নিকট হতে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে মোবাইলের সিম কেনা এবং বিকাশ একাউন্ট খুলে নিজেদের কাছে রেখে টাকা আসলে ২ থেকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে ফেরৎ দেওয়ার অনেক প্রমান, অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি খুব দুঃখ জনক। উপজেলা পরিষদের কোনো কাজে কোনো ধরনের দূর্নীতির সাথে আপোষ করা হবে না। প্রয়োজন হলে জনগনের কাতারে যেয়ে দূর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশু হস্তক্ষেপ ও তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী জানান।