
আতিয়ার রহমান, মণিরামপুর থেকে: যশোরের মণিরামপুরের ঝাঁপা ইউপি চেয়ারম্যান সামছুল হক মন্টু ও তার দোসরদের বিরুদ্ধে সরকারি ঘর পাইয়ে দেওয়ার নাম করে অর্ধ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ করা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে চেয়ারম্যান মন্টু তার সংরক্ষিত দুই নারী ইউপি সদস্য লাকী খাতুন ও শাহিনারা খাতুন, দুই ইউপি সদস্য ইউছোপ আলী ও আব্দুর রশিদসহ কয়েকজন অনুসারীকে দিয়ে ইউনিয়নের দুস্থ, অসহায় ও ফকিরসহ প্রায় চার শতাধিক লোকের কাছ থেকে ঘরের লোভ দেখিয়ে জনপ্রতি পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা করে নিয়েছেন। চেয়ারম্যান নিজেও ভিক্ষুক ও অসহায় নারীদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ। টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ ছাড়েননি ওই ইউনিয়ের নারী উদ্যোক্তা ডলি খাতুনও। যদিও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইউপি সদস্যর দাবি ঘরের জন্য টাকা দেওয়া ভুক্তভোগীর সংখ্যা এক থেকে দেড় হাজার।
শনিবার দিনভর সরেজমিন অন্তত: ৫০জন ভুক্তভোগীর সাথে কথা হয়েছে। তারা সবাই টাকা দেওয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন। যার ভিডিও অডিও স্বাক্ষাতকার সংরক্ষিত।
যদিও চেয়ারম্যান সামছুল হক মন্টু দাবি করছেন রাজনৈতিকভাবে তাকে হেয় করতে এসব মিথ্যে অভিযোগ আনছেন প্রতিপক্ষ। আড়াই বছর আগে ঝাঁপা ইউনিয়নে ‘জমি আছে ঘর নাই’ আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় একলাখ টাকার ১০৩টি ঘর আসে। ওই ১০৩টি ঘরকে পুঁজি করে শুরু হয় চেয়ারম্যান মেম্বরদের অর্থ বাণিজ্য। নতুন ঘর দেখে বঞ্চিতরা ভিড়তে থাকেন চেয়ারম্যান মেম্বরদের কাছে। তখনই ঘরপ্রতি ১০ হাজার টাকা দাবি করেন জনপ্রতিনিধিরা। টাকা ছাড়া ঘর মিলবে না ভেবে ধার দেনা বা সুদি করে অসহায় দুস্থরা চেয়ারম্যান মেম্বরদের হাতে টাকা তুলে দেন।
তবে গরিবের কোটি টাকা পকেটস্থ হলেও গত আড়াই বছরে কাউকে একটি ঘর দিতে পারেননি মন্টু চেয়ারম্যান। ঘর কিংবা টাকা ফেরত কোনটা না পেয়ে বারবার চেয়ারম্যান মেম্বরদের পিছু হেঁটে লাভ পাচ্ছেননা ভুক্তভোগীরা। ঘরের আশায় এবং ভয়ে মন্টু চেয়ারম্যান ও তার দোসরদের বিরুদ্ধে এতদিন কেউ মুখ না খুললেও বিপত্তি ঘটে দুই-তিনদিন আগে। গত বুধবার ভুক্তভোগী চার নারী উপজেলার রাজগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী আবুল বাসারের শরণাপন্ন হন। তখন তাদের একটি ছবি নিজের ফেসবুকে ছাড়েন আবুল বাসার। এই নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে পরের দিন চার নারীর মধ্যে তিন জনকে ডেকে দশ হাজার করে ৩০ হাজার টাকা ফেরত দেন ঝাঁপা ইউপির উদ্যোক্তা ডলি খাতুন। তিনি ওই তিন জনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন। তিন জনের টাকা ফেরতের বিষয়টি প্রচার হলে ইউনিয়ের বিভিন্ন এলাকা থেকে ভুক্তভোগী নারী পুরুষ মুখ খুলতে শুরু করেন। যার মধ্যে ৭০-৮০ জনের একটি তালিকা এসেছে গণমাধ্যম কর্মীদের হাতে।
ঝাঁপা উত্তর পাড়ার ভিক্ষুক রাশিদা বলেন, আমার মা ও আমি ভিক্ষা করে খাই। থাকার ঘর নেই। আমাদের গ্রামের আব্দুল আজিজ নামে একজন সরকারি ঘর পাইছে। তাই দেখে আমি চেয়ারম্যানের কাছে যাই। তিনি ঘর বাবদ ১০ হাজার টাকা চান। সমিতি থেকে ১০ হাজার টাকা তুলে চেয়ারম্যানের হাতে দিছি। আজও ঘর পাইনি। ওই পাড়ার ফাতিমা নামে এক বিধবা নারী দুই বছর আগে চেয়ারম্যানকে চার হাজার টাকা দিয়েও ঘর পাননি বলে জানিয়েছেন। একই পাড়ার ভিক্ষুক মাজেদা, কুলসুম, রোকেয়া ও রাবেয়া ঘরের আশায় দশ হাজার করে টাকা দিয়েছিলেন উদ্যোক্তা ডলির কাছে। তাদের মধ্যে তিনজনকে টাকা ফেরত দিলেও রাবেয়ার টাকা ফেরত দেননি ডলি। তবে ডলি খাতুন টাকা নেওয়া বা ফেরত দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেননি।
এদিকে হানুয়ার তিনটি ওয়ার্ডের বহু অসহায় নারী পুরুষকে ঘর দেওয়ার কথা বলে টাকা নিয়েছেন নারী ইউপি সদস্য লাকী খাতুন। হানুয়ার কলেজ পাড়ার ফাতেমা, রহিমা, পরিজান ও ফুলি বেগম লাকী মেম্বরকে পাঁচ হাজার এবং বৃদ্ধ হাসান সাড়ে সাত হাজার টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তবে লাকী মেম্বর টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেননি।
দোঁদাড়িয়া গ্রামের ভ্যান চালক মিলন ও মনোয়ারা বেগম জানান, তারা মেম্বর শাহিনারাকে ঘরের আশায় দশ হাজার করে টাকা দিয়েছেন। শুধু মিলন বা মনোয়ারা নয় ওই গ্রামের অন্তত ২০ জন দুস্থ লোক মহিলা মেম্বরকে দশ হাজার করে টাকা দিয়ে বিপাকে আছেন।
ঝাঁপা ইউপির ষোলখাদা গ্রামের অন্তত ২০ জনের কাছ থেকে ইউপি সদস্য শাহিনারা খাতুন, মেম্বর ইউছোপ আলী ও চেয়ারম্যান মন্টুর দোসর সিদ্দিক নামে একব্যক্তি দশ হাজার করে টাকা নিয়ে ঘর দিতে পারেননি। হানুয়ার ৬নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বর আব্দুর রশিদের বিরুদ্ধে একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে একই প্রকল্প দেখিয়ে হাজার হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগ। যার মধ্যে ভুক্তভোগী আবু মুসা সাত হাজার টাকা দেওয়ার বিষয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের জানিয়েছেন। তবে অভিযুক্তদের একাধিকবার মোবাইলে কল করা হলেও তারা ফোন ধরেননি।
জানতে চাইলে চেয়ারম্যান সামছুল হক মন্টু বলেন, কোন বিষয়ে আমি কারও কাছ থেকে একটি টাকা নিইনা। প্রকাশ্যে ইউনিয়ের সবাইকে নিষেধ করেছি, মেম্বররা কোন ব্যাপারে টাকা চাইলে না দিতে। প্রতিপক্ষরা আমার বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে চক্রান্ত করছেন।
মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ জাকির হাসান বলেন, ঘর দেওয়ার কথা বলে ঝাঁপা ইউপির চেয়ারম্যান মেম্বরদের টাকা নেওয়ার ব্যাপারে কেউ অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখা হবে।
চেয়ারম্যান মেম্বরদের ঘরের নামে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে দুদকের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন ভুক্তভোগীসহ ঝাঁপা ইউনিয়নের সচেতন মানুষ।