করোনা দুর্যোগের মধ্যেই আঘাত হানলো ‘আমফান’ ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস। নি:স্ব বহু মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে গেল। এতসব দুর্যোগ-মহাদুর্যোগে ঈদ আলাদাভাবে আর আনন্দ-উচ্ছ্বাস বয়ে আনছে না। কেবলমাত্র লকডাউনের মধ্যে আরো টানা ছয়টি দিন বেকারদশায় কাটানোর সুযোগ করে দিয়েছে ঈদ। পুরোপুরি কর্মহীন এ সময়টায় ভিন্ন একটা কিছু ভেবে দেখার জন্য উত্থাপন করছি।
করোনা দুর্যোগ নিয়ে বিগত ১৫ মার্চ থেকেই সরকার কিছুটা চিন্তিত হলেও কার্যকর পদক্ষেপ শুরু করা হয় ২৫ মার্চ থেকে। ২৬ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত প্রথম ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয় দফায় সে লকডাউন বাড়িয়ে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ঘোষণা করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। ধারাবাহিক এসব লকডাউনেরই সুযোগ নিতে থাকে একশ্রেণীর পত্রিকা মালিক কর্তৃপক্ষ। তারা সব অচলের অজুহাত তুলে সাংবাদিকদের বেতনভাতা প্রদান করা থেকে বিরত থাকেন। ফলে এপ্রিলের ৫/৬ তারিখ থেকেই বেশিরভাগ সাংবাদিকের ঘরে অভাব হানা দেয়, সঙ্কটাপন্ন হয় পকেটের অবস্থাও। মোটামুটি ১০ এপ্রিল থেকেই সাংবাদিকদের জন্য সাহায্যের আর্তি নিয়ে আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতারা দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকেন। সেই আবেদন নিবেদন যে কতোটা গুরুত্ব পেয়েছে তা বোধকরি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর প্রয়োজন নেই।
কেউবা লিখেন: গত তিন দিন যাবত ঘরে বাজার নেই কথাটা অমুক ভাইকে জানানো মাত্র আমার বাসায় পাঁচ কেজি চাল, ডাল, পেঁয়াজ, আলু, তেল, সাবান পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু নেতাদের ভোট এজেন্টরা স্ট্যাটাস দেয়ার আগে একবারও ভাবেন না যে, তার দয়াল দরদী নেতা সাংবাদিকদের জন্য কোনরকম সরকারি বেসরকারি সহায়তা জোটাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই নিজের পকেটের টাকা খরচ করে সেই ব্যর্থতা ধামাচাপা দিচ্ছেন!
আমাদের সাংবাদিক নেতারা সাহায্য সহযোগিতা জোটানোর জন্য যে চেষ্টা করেননি তা নয়। হয়তো তথ্যমন্ত্রীর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে চেষ্টা তদবির করায় তাদের ঘাম ঝরতে দেখিনি, কিন্তু মেধা বুদ্ধি, রাজনৈতিক পরিচয়ের দাপট, পত্রিকার প্রভাব খাটানো থেকে শুরু করে নরমে গরমে নানাভাবেই তাদের চেষ্টা চলেছে। এমনকি নিদেনপক্ষে টিসিবির ন্যয্যমূল্যের পণ্যও সাংবাদিকদের জন্য পাওয়ার ব্যাপারে যার পর নাই চেষ্টা চালিয়েছেন প্রাণপ্রিয় নেতারা।
একবার ভেবে দেখলেন কী? সারাদেশের আপামর জনতা যত্রতত্র টিসিবির ন্যায্যমূল্যর পণ্য কিনতে পারবেন-শুধু সাংবাদিকরা সে পণ্য কিনতে চাইলে সরকারের বিশেষ অনুমতির দরকার পড়লো কেন?
এমন প্রশ্ন তুলে আমাদের নেতাদের বিব্রত করার কোনো দরকার আছে বলে মনে করি না, আমি বলতে চাই ভিন্ন কথা। এই যে টানা দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকদের বিপন্নদশার কথা নানাভাবে প্রকাশ হচ্ছে, আমাদের নেতাদের এতসব চেষ্টা চলছে- সেসব ব্যাপারে কারো কী সমর্থন জুটলো?
সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আঁতেল বা বিনা আঁতেলের বুদ্ধিজীবী পর্যন্ত কেউ সাংবাদিকদের সহায়তা প্রয়োজন থাকার কথাটি মনেও করলেন না? এই যে দীর্ঘ সাংবাদিকতায় শত শত সংগঠনের নানা অনুরোধ পালন করে তাদের বিভিন্ন কর্মসূচি, বিবৃতি, আন্দোলন, সুখ-দু:খের কত শত সংবাদ ছেপেছি।
আজও কত নেতা বিছানায় শুয়ে শুয়ে লিখে পাঠান-অমুক সংগ্রাম পরিষদের সভাপতির নেতৃত্বে আজ সকাল ১১ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। এসময় দাবি দাওয়ার সমর্থনে নানা স্লোগান দেয়া হয়। হাইকোর্টের মোড়ে পুলিশ বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে সংগ্রাম পরিষদের নেতা কর্মিদের সঙ্গে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ বাধে। আমরা কারো উপস্থিতি না দেখেও, বুঝে শুনেও নেতার বিবৃতিতে গুরুত্ব দিয়ে ঢাউশ আকারের খবর প্রকাশ করি নির্দ্ধিধায়। তাদের প্রতি অমলিন মমত্ব দেখিয়ে আসছি ৩০/৩২ বছর ধরেই। কিন্তু এতসব সংগঠন এতো এতো নেতাদের কেউ নিছক বিবৃতি দিয়েও সাংবাদিকদের সমর্থনে দুটো কথা বললেন না।
কেউ দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বললেন না-সাংবাদিকদের প্রতি সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ ঠিক হচ্ছে না, তাদের ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক। করোনার অগ্রযোদ্ধা সাংবাদিকরা অসুস্থ ও মৃত্যুর শিকার হলে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। মাঝেমধ্যে বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ রাজনৈতিক বিরোধীতার সূত্রে সাংবাদিকদের সহায়তা নিয়ে বক্তৃতা বিবৃতি দিলেও তা কোনো সুফল বয়ে আনেনি। বরং সরকার ঘনিষ্ঠরা ভেবে নিয়েছেন-ইদানিং সাংবাদিকরা বেশিরভাগই কী বিএনপি ঘেষা হয়ে গেল?
তাহলে তাদের জন্য কিছু করাটাই বৃথা। অতএব দলীয় নেতা নেত্রীদের বক্তৃতা, বিবৃতি, ভূমিকা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না, আমি বলতে চাই সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, নির্দলীয় ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবীদের বিষয়ে। তারা সাংবাদিকদের সহায়তা করার পক্ষে এক লাইন বিবৃতি দেয়া থেকে কেন বিরত রইলেন? তবে কি বৃহত্তর সমাজ ও জনগোষ্ঠী থেকে সাংবাদিকরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন?
দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীও কী সাংবাদিকদের সমাজচ্যুত প্রাণী হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন? আসলেই কী আমরা ক্রমেই বিচ্ছিন্ন দল-উপদলের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়েছি? সম্ভবত এসব কারণেই ঘন ঘন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হলেও সার্বজনীন কোনো প্রতিবাদ হয় না। সাংবাদিক নির্যাতন এমনকি হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল বের করলেও সেখানে সাধারন মানুষজনের অংশগ্রহণ থাকে না। আমার ধারনা- বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মানুষ অতি প্রয়োজনে শুধু এগিয়ে আসে এবং কাজ হাসিল করেই সটকে পড়ে, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলে। নিরাপদ দূরত্বে না থেকেই বা করবেটা কী?
ভূয়াদের শেকড় জাতীয় পর্যায়ে!!
খোদ রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যায়েও যত শ্রেণীর সাংবাদিক আছেন-তাদের বেশিরভাগই তান্ডব সৃষ্টিকারী। ভূয়া সাংবাদিক, ফেসবুক সাংবাদিক, সোর্স সাংবাদিক, দলবাজ সাংবাদিক, টোয়েন্টিফোর ডটকম মার্কার সাংবাদিক-সম্পাদক, আইপি টিভি, ফেসবুক লাইভ সাংবাদিক আরো কত শত পদ পদবীর সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্যে জনজীবন অতিষ্ঠ।
জনস্বার্থ, সামাজিক দায়বদ্ধতা, রাষ্ট্রীয় কল্যাণ নিয়ে এসব সাংবাদিকের চিন্তা ভাবনার সুযোগটা কোথায়? দিনরাত উন্মাদের মতো ছোটাছুটির মধ্যেই অবিরাম তাদের ধান্ধাবাজি চালাতে হয়। তাদের যাঁতায় বৃহত্তর সমাজ, প্রশাসন, বুদ্ধিজীবী, সমাজ সংগঠক সবাই পিস্ট হন প্রতিনিয়ত। বুদ্ধিমান, সম্মানীতরা এ শ্রেণী থেকে পালিয়ে থাকাটাই নিরাপদ ভাবে। কে আসল, কে নকল, কে ভূয়া তা নিয়ে যাচাই বাছাই করার মতো পন্ডশ্রম দেয়ার সময় তাদের নেই। তারা মাঝে মধ্যে বিণয়ের সঙ্গে প্রশ্ন তোলেন: র্যাবের হাতে ভূয়া র্যাব ধরা পড়ে, ডিবির হাত থেকে ভূয়া ডিবির গ্রুপও নিস্তার পায় না। কিন্তু ভূয়া সাংবাদিক, সোর্স সাংবাদিক, প্রতারক সাংবাদিক দমনে জাতীয় পর্যায়ের সাংবাদিক সংগঠনগুলোর ভূমিকাটা কি? তবে কী গ্রাম পর্যায়ে চষে বেড়ানো ভূয়াটার শেঁকড়ও জাতীয় পর্যায়ে মজবুত ভাবে প্রোথিত?
গণমাধ্যম না কি প্রচারমাধ্যম?
এ তো গেল সাংবাদিকদের ব্যাপার! এবার সংবাদপত্রের বিষয়ও একটু ভেবে দেখা যেতে পারে। দেশে মূলত: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যম ও প্রচার মাধ্যম- এই তিন ধরনের সংবাদ সরবরাহকারী মাধ্যম দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এরমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউব এবং যার যেমন খুশি তেমনভাবে তৈরি করা টোয়েন্টিফোর ডটকম যুক্ত রঙ বেরঙের কথিত নিউজ পোর্টালগুলো রীতিমত ভয়ঙ্কর রুপে আবির্ভূত হয়েছে। এ ক্ষেত্রটিতে যেন ইরি ধানের মতোই বিপ্লব ঘটে চলেছে।
‘ওয়ান ম্যান ওয়ান পোর্টাল-প্রত্যেকেই এডিটর’ এমন স্লোগানকে আদর্শ বানিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়াড় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কেন্দ্রিক নিউজ পোর্টালগুলো সবার কাছেই আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলোতে সকালে একজনের সম্মান ক্ষুন্ন করা হয়তো দুপুরেই অন্যজনের সম্ভ্রমহানি ঘটানো হয়, আবার সন্ধ্যা না পেরোতেই চিহ্নিত সিঁধেল চোরাকে বানিয়ে দেয়া হয় সাদা মনের মানুষ। কোনো কোনো পোর্টাল প্রতিষ্ঠাতা প্রতিদিন তার রাজনৈতিক বক্তৃতা দিয়ে প্রধান স্টোরি বানালেও তার স্ত্রী তুলে ধরেন নিজের বিউটি পার্লারের হরেক গুণাগুণের কাহিনী।
অন্যদিকে কলেজ পড়ুয়া মেয়েটির নতুন প্রেমে পড়ার ধকলযুক্ত ছড়া-কবিতায় আধা পাতা পূর্ণ করা হয়। আর ফেসবুক স্ট্যাটাসের নামে যেসব জঘণ্য মূর্খতার ছড়াছড়ি চলে তা দেখলেই ঘৃণায় শরীর রি রি করে উঠে।
এছাড়া বাজারে চলমান পত্রিকা ও দর্শকদের কাছে উপস্থাপন করা বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো দেখে শুনে বারবারই পাঠক, দর্শক- শ্রোতারা হকচকিয়ে উঠেন। কোনটা যে প্রচার মাধ্যম আর কোনটা যে গণমাধ্যম তা বুঝে ওঠাও কষ্টকর। তবে ধনপতি কারখানা মালিকদের স্বার্থবিরোধী কোনো কর্মকান্ড ঘটলেই তাদের প্রতিষ্ঠিত মিডিয়াগুলো যে কী ধরনের ‘প্রচার মাধ্যম’ তা টের পাওয়া যায়। রাজনীতিবিদ এবং সরকারগুলো বরাবরই যেমন জনগণের দোহাই দিয়ে গণবিরোধী অপকর্ম চালিয়ে থাকে-তার চেয়েও জঘণ্যতায় চলে গণমাধ্যম নামের প্রচার মাধ্যমগুলো।
মনে রাখা দরকার প্রচার মাধ্যমের লিফলেট আর ভিডিওগুলোতে গণমানুষের ঠাঁই নেই- সেখানে থাকে নিজের ও সমমনা কারখানাসহ ব্যবসা বাণিজ্যের ‘বিজ্ঞাপনী নিউজ।’ অথচ সাধারণ জনগণের কথা লিখতে গিয়ে প্রকৃত গণমাধ্যম নানা ধকলে নি:স্ব হয়, তালা ঝুলে সদর দরজায়। দৈনিক অধিবেশনের প্রেসসহ বিক্রি করে ঝিনাইদহ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয় আলী কদর পলাশদের। নারায়নগঞ্জের জনতার মুখপত্র যুগেরবাণীর প্রিন্ট করা নিষিদ্ধ করার পর অনলাইন এডিশনও বন্ধে বাধ্য করা হয়। আমার হবিগঞ্জ পত্রিকার সম্পাদক সুশান্তকে জেলে ঢুকিয়েও সাংবাদিক পোশাকধারী দালালচক্র স্বস্তি পায় না, পত্রিকাটির অনুমোদনপত্র বাতিলের জন্যও নানা কাঠখড় পোড়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠে। আরো কত কী….
অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষীণ আর্তনাদ
সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে নিজেদের পেশা, দায়িত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি নতুন করে বিশ্লেষণের দাবি রাখে বৈ কি! সামাজিক দায়বদ্ধতা রক্ষার ক্ষেত্রে সাংবাদিক হিসেবে আসলেই আমরা কতটুকু দায়িত্ববোধের পরিচয় দিচ্ছি। নিজেদের পেশার শুদ্ধতা বজায় রাখতে কতটুকু ভূমিকা রাখছি আমরা? পেশার মান সমুন্নত রাখার অঙ্গিকার নিয়েই সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব গ্রহণকারী প্রাণপ্রিয় শ্রদ্ধাভাজনরা একটু নজর দিন-এটাই আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষীণ আর্তনাদ।