
আকরামুল ইসলাম: আধুনিকতার ছোয়া পড়েছে সর্বত্র। সেই ছোয়ায় বদলে গেছে দৃশ্যপট। নিত্যু নতুন ব্যবস্থাপনা হারিয়ে দিয়েছে মাদুর শিল্পকে। এক সময়ে গ্রামাঞ্চল ও শহরে মানুষদের বসার অন্যতম মাধ্যম ছিল মাদুর। অতিথি আপ্যায়নসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে মাদুরের ব্যবহার ছিল লক্ষ্যনীয়। তবে এখন আর খুব বেশী দেখা যায় না মাদুর। অধিকাংশ কারিগররাও ছেড়ে দিয়েছেন এ পেশা। নামমাত্র কিছু সংখ্যক মানুষ পৈত্তিক ব্যবসার কারণে এখনো আকড়ে ধরে আছেন মাদুরকে। মাদুর তৈরীতে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংকট, দাম না পাওয়া ও প্লাস্টিক মাদুরের বেশী চাহিদার কারণে বিলুপ্তির পথে সাতক্ষীরার এ মাদুর শিল্পটি।
দুই দশক আগেও জেলার আশাশুনি ছিল মাদুরের জন্য বিখ্যাত। আশাশুনি উপজেলার কাঁদাকাটি, বড়দল, খাজরা ও প্রতাপনগর এলাকায় মাদুর তৈরী করতো কারিগররা। কাঁদাকাটি ও বড়দল এলাকায় সব থেকে বেশী মাদুর তৈরী হতো। তবে বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকজন এ পেশায় জড়িত রয়েছেন। বাকিরা বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা।
বড়দল এলাকায় এক সময়ের মাদুর তৈরীর কারিগর গোবিন্দ মন্ডল। তবে এখন ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করছেন। লাভ না হওয়া ও চাদিহা কম হওয়ার কারণে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন এ পেশা।
গোবিন্দ মন্ডল জানান, মাদুর তৈরীর মূল উপকরণ হলো মেলে ঘাস। দেড় দশক আগেও এ অঞ্চলে মেলে চাষ করতো অনেকেই। তবে এখন চাহিদা কম হওয়ার কারণে মেলে চাষ কমে গেছে। একটি মাদুর তৈরী করতে সাড়ে চারশো থেকে পাঁচশো টাকা খরচ হয়। বিক্রি হয় ছয়শো টাকায়। একশো টাকা লাভ হয়। এই টাকার মধ্যেই নিজের শ্রমসহ আনুসঙ্গিক খরচ। লাভ কম হওয়া ও বাজারে হাতে তৈরী মাদুরের চাহিদা কম হওয়ার কারণে আমার মত অনেকেই মাদুর তৈরী ছেড়ে দিয়ে ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছেন। আর এসব গরীব মানুষদের সরকারি কোন পৃষ্ঠপোষকতা নেই।
অধিকাংশ কারিগররা যখন মাদুর তৈরী থেকে বিমুখ হয়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন তখন আশাশুনি উপজেলার কাঁদাকাটি গ্রামে নিশিকান্ত অধিকারী ও তার স্ত্রী মালতি অধিকারী আজও মাদুরের মধ্যেই জীবিকার সন্ধান খুঁজে চলেছেন।
নিশিকান্ত অধিকারী জানান, পৈত্তিক ব্যবসা হিসেবেই আমি এখনো মাদুর তৈরী করে হাটে বাজারে বিক্রি করি। তবে এখন আর লাভ হয় না। একটা ছোট আকারের মাদুর তৈরী করতে খরচ হয় ২৫০-৩০০ টাকা। বিক্রি হয় ৩৫০ টাকায়। বড় আকারের একটি মাদুর তৈরী করতে খরচ পড়ে যায় ৪৫০-৫০০ টাকা। বিক্রি হয় ৬০০ টাকায়। লাভ খুব সীমিত। এছাড়া মাদুর তৈরীর প্রধান উপকরণ মেলে ঘাস পাওয়া কষ্টসাধ্য। চাহিদা কম থাকায় চাষীরা এখন মেলে ঘাসের চাষ করতে চায় না। বর্তমানে আমার আশপাশে ৩৫টি পরিবার এখনো মাদুর তৈরীর কাজে নিয়োজিত রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমার স্ত্রী মালতী অধিকারী আমার সঙ্গে মাদুর তৈরীতে সহযোগিতা করেন। যার কারণে আমার বাড়তি শ্রমিক নিতে হয় না। সেক্ষেত্রে আমার বাড়তি খরচটা হয় না। আগে ৭০-৮০ জোড়া মাদুর সপ্তাহে তৈরী করলেও বর্তমানে ৩০-৪০ জোড়া মাদুর তৈরী করছি। বাজারে মাদুরের চাহিদা এখন কম।
আশাশুনি উপজেলার বড়দল ও বুধহাটা বাজার মাদুরের হাটের জন্য বিখ্যাত। প্রতি রোববার বড়দলে, শুক্রবার ও সোমবার বুধহাটা বাজারে বসে মাদুরের হাট। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মাদুর কারিগরা প্রতি সপ্তাহে তাদের তৈরী মাদুর হাটে এনে পাইকারি ও খুচরাভাবে বিক্রি করেন। এরপর সেখান থেকে মাদুর চলে যায় খুলনা, যশোরসহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায়।
মাদুর শিল্পের বিলুপ্তির কারণ হিসেবে আশাশুনির বড়দল গ্রামের মাদুর কারিগর সুব্রত মণ্ডল জানান, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নেই, প্রধান উপকরণ মেলে ঘাসের অভাব, বাজারে চাহিদা কম মূলত এসব কারণেই এখন মাদুর তৈরী করা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় গেছেন বহু কারিগর। যারা এখনো তৈরী করছেন তারা মূলত পৈত্তিক ব্যবসা ছাড়তে না পেরে এখনো এ ব্যবসায় পড়ে আছেন।
সাতক্ষীরা শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি নাসিম ফারুক খান মিঠু বলেন, সাতক্ষীরা ঐতিহ্য ছিল মেলে মাদুর। সাতক্ষীরার মাদুর সরবরাহ হতো দেশের বিভিন্ন এলাকায়। এখন আশঙ্কাজনকভাবে মাদুর তৈরীর কারিগর সংখ্যা কমে গেছে। বর্তমান এ কুঠির শিল্পটি চরম সংকটে পড়েছে। শিল্পটি বাঁচাতে হলে বর্তমানে যারা এ পেশায় রয়েছেন তাদের সহজ শর্তে ঋণদান প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। সেটি না হলে আগামী এক দশক পর সাতক্ষীরায় মাদুর তৈরীর কারিগর খুজে পাওয়া যাবে না।
সাতক্ষীরা বিসিক শিল্প নগরীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ার উল্লাহ্ বলেন, বর্তমানে মাদুর খুব বেশী আর দেখা যায় না। আধুনিকতার ছোয়ায় মাদুর শিল্পটিও বিলুপ্তি হতে চলেছে। বর্তমানে মাদুর তৈরীর মূল কাঁচামাল মেলে ঘাস এখন আর খুববেশী পাওয়া যায় না। কারিগরদের তৈরী খরচ বেশী পড়ে আবার কম দামে বিক্রি করতে হয়। এছাড়া বাজারে প্লাস্টিকের মাদুরের চাহিদা বেশী, দামও কম। যার কারণে মাদুর তৈরীতে বিমুখ হয়ে গেছেন কারিগররা।
তিনি বলেন, মাদুর কারিগরদের নিয়ে আমাদের কোন জরিপ নেই। তবে পূর্বে জেলার আশাশুনি উপজেলায় ২৫০-৩০০টি পরিবার ছিল মাদুর তৈরীর উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ১০০টিতে।
মাদুর শিল্পটি রক্ষায় কোন উদ্যোগ বা কারিগরদের পোষ্ঠপোষকতা করা হয় কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, মাদুর কারিগরদের ব্যাপারে বিসিক শিল্প নগরী সাতক্ষীরার পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এছাড়া কোন কারিগর কখনো সহযোগিতা চেয়ে আমাদের কাছে আসেনি। কেউ সরকারিভাবে সহযোগিতা (লোন) চেয়ে আসলে যাচাই বাছাই করে সহযোগিতা করা হবে।