গাজী ফারহাদ: বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরা দীর্ঘদিন ধরেই অবহেলিত। শিক্ষা ও মানবসম্পদে এই জেলার যথেষ্ট অগ্রগতি থাকলেও অবকাঠামো উন্নয়নে সাতক্ষীরা পিছিয়ে রয়েছে ভয়াবহভাবে। বিশেষ করে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশা মানুষের জীবনযাত্রা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হয় দক্ষিণাঞ্চলের শেষ জেলা সাতক্ষীরার উপকূলীয় জনপদ শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নে। ইউনিয়নের আয়তন ৩৩ বর্গ কিলোমিটার। এর কোথাও নেই পাকা সড়ক। দু’একটি ইটের সড়ক ছিল। সেগুলোর ইট উঠে গেছে। সেতু-কালভার্ট নেই। ইউনিয়নের ১৫ গ্রামে যাতায়াতের সব রাস্তা মাটির।
সাতক্ষীরার সড়ক ব্যবস্থার বাস্তব চিত্র:
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, সাতক্ষীরায় মোট ৫,৭৮৮টি সড়ক রয়েছে, যার দৈর্ঘ্য ১১,০০২.৪৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে পাকা সড়কের দৈর্ঘ্য মাত্র ২,২৩০.৩১ কিলোমিটার (২০.২৭%)। অপরদিকে কাঁচা সড়কের দৈর্ঘ্য ৮,৭৭২.১৫ কিলোমিটার (৭৯.৭৩%)। অর্থাৎ জেলার চার ভাগের তিন ভাগ সড়ক এখনো কাঁচা।
বর্তমান সরকার যে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করেছে, তাতেও মাত্র ১,৩১০.২২ কিলোমিটার সড়ক পাকা করার পরিকল্পনা আছে। কাজ শেষ হলেও সাতক্ষীরার ৬৬% সড়ক কাঁচা থেকে যাবে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে যেখানে এখনো ৮০% সড়ক কাঁচা, সেখানে “মেরামত” শব্দ ব্যবহার করে সংবাদ প্রকাশ করা কতটা বাস্তবসম্মত?
সংবাদ নিয়ে প্রশ্ন:
সম্প্রতি একটি দৈনিকে সাতক্ষীরার সড়ক উন্নয়ন নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে। দুঃখজনকভাবে সেখানে উপস্থাপিত তথ্য যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর। যেমন:
• সাতক্ষীরার সড়কের দৈর্ঘ্য বলা হয়েছে ৯,২৯৪ কিলোমিটার, অথচ প্রকৃত দৈর্ঘ্য ১১,০০২.৪৬ কিলোমিটার।
• পাকা সড়কের পরিমাণ বলা হয়েছে ৩,৩৩৯ কিলোমিটার, অথচ বাস্তবে আছে ২,২৩০.৩১ কিলোমিটার।
•সংস্কারকাজ চলছে বলা হয়েছে ১,০৫০ কিলোমিটার, অথচ বাস্তব সংখ্যা মাত্র ১৯.২৭ কিলোমিটার।
এ ধরনের উপস্থাপনা সাতক্ষীরার মানুষকে কেবল ভুল তথ্যই দেয় না, বরং জেলার ন্যায্য উন্নয়ন দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
বাজেট বঞ্চনার চিত্র:
সাতক্ষীরা দীর্ঘদিন ধরে বাজেট বঞ্চনার শিকার। উদাহরণস্বরূপ
• ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০৬.৪৬ কোটি টাকার চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয় মাত্র ৪১.৪৩ কোটি টাকা (৩৯.০৫%)।
• ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ১৪৩.৯৭ কোটি টাকার বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মাত্র ৪০.৫১ কোটি টাকা (২৮.১৪%)।
এমন বঞ্চনা জেলার উন্নয়নকে আটকে রেখেছে বছরের পর বছর।
যে কারণে সাতক্ষীরায় বরাদ্দ হওয়া উচিত:
আমি বরাদ্দ নিয়ে এলজিইডি কর্মকর্তা ও জেলা অর্থনৈতিক বিশ্লেশক দের সাথে কথা বলেছি। তাদের মতে সমিকরণ করে যদি সাতক্ষীরা জেলায় বরাদ্দ চিন্তা করতে হয় তাহলে জেলায় যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এর তিন গুন বেশি বরাদ্দ দিতে হয়। দেশের সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরা শুধু ভৌগোলিকভাবে নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রতিবছর এ জেলা থেকে হাজার কোটি টাকার চিংড়ি ও মাছ রপ্তানি হয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। লবণাক্ততা-সহিষ্ণু কৃষি প্রযুক্তি ও উৎপাদন পদ্ধতিও কৃষিখাতে উদ্ভাবনী দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। পাশাপাশি সুন্দরবন ঘেঁষা এ অঞ্চল পর্যটনের সম্ভাবনাময় কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত। এখানকার বিপুল সংখ্যক মানুষ বিদেশে কর্মরত থেকে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে।
তবে নানা সম্ভাবনার পাশাপাশি সাতক্ষীরার উন্নয়ন চ্যালেঞ্জও কম নয়। জেলার সাতটি উপজেলায় অবকাঠামোগত দুর্বলতা, জলাবদ্ধতা, নদীভাঙন, কর্মসংস্থানের অভাব ও লবণাক্ততার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে কৃষি ও মৎস্য খাত বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই বাস্তবতায় আলাদা উন্নয়ন প্যাকেজ ঘোষণার করা উচিত।
জনপ্রতিনিধি ও নীতিনির্ধারকদের দায়:
দুঃখজনক হলেও সত্য, সাতক্ষীরার জনপ্রতিনিধিরা জেলার উন্নয়ন দাবিকে যথাযথভাবে জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরতে পারেননি। রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব ও শক্তিশালী নেতৃত্বের সংকটে সাতক্ষীরা বারবার পিছিয়ে পড়ছে।
আমি মনে করি, সাতক্ষীরার উন্নয়ন প্রশ্নে কোনো ধরনের অপপ্রচার বরদাশত করা যায় না। একটি দায়িত্বশীল দৈনিকের উচিত ছিল জেলার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা। ভুল বা বিকৃত তথ্য দিয়ে উন্নয়ন দাবিকে ছোট করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
সাতক্ষীরার উন্নয়ন একটি জাতীয় দায়। তাই সরকারের প্রতি আহ্বান এই জেলার রাস্তা-ঘাট ও অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ নিশ্চিত করা হোক। আর সংবাদমাধ্যমের প্রতি অনুরোধ অবহেলিত জনপদের ন্যায্য দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে সঠিক তথ্য জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হোক।
লেখক: সংবাদ কর্মী, সাতক্ষীরা।