
আহাদুর রহমান (জনি): সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের মালিকানাধীন গাছ বিক্রীর টেন্ডারে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। গাছের মূল্য কম দেখিয়ে, টেন্ডার আটকে ও রেট ফাঁস করে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট সোয়া ৩ কোটি টাকার গাছ মাত্র ৬০লাখ টাকায় ক্রয় করেছে।
সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের তালা উপজেলার তালা-ইসলামকাটি-সুজনশাহা-পাটকেলঘাটা সড়কের দু’ধারের ৯৫৪টি দানবীয় আকারের গাছ বিক্রির জন্য টেন্ডার আহ্বান করলে সাতটি প্যাকেজে ৩৬টি ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের কাছে ২০৪টি দরপত্র বিক্রি করে। প্রথম দফায় সবকটি প্যাকেজে মোট ১৪টি দরপত্র জমা পড়ে। জেলা পরিষদ স‚ত্রে জানা গেছে, সাতটি প্যাকেজের মোট টেন্ডার ম‚ল্য ৫৯ লাখ ৩১ হাজার ৯৪৫ টাকা। সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে সাতটি প্যাকেজের গাছ টেন্ডার মূল্য থেকে ৩০ হাজার বেশি দেখিয়ে বিক্রির টেন্ডার পায় সাতক্ষীরা পৌরসভার পলাশপোল গ্রামের মেহের আলী মোড়লের ছেলে আবুল হাসেম।
সরজমিনে পরিদর্শনে যা দেখা যায়:
তালা উপজেলার তালা-ইসলামকাটি-সুজনশাহা-পাটকেলঘাটা সড়কের দু’ধারের গাছগুলো ২৪-২৬ বছরের পুরনো। টেন্ডারে উল্লেখিত ৯৫৪টি গাছের মধ্যে ৩১৮টি মেহগনি ও রোড শিরিষ গাছ আছে। বাকি ৬৩৬টি গাছই শিশু বা রেইনট্রি গাছ। যার মধ্যে ৫০ শতাংশ গাছই দানবাকৃতির। এই গাছ গুলো মধ্যে ৬০টিরও বেশি গাছ আছে যে গুলোর বাজার মূল্য ১লাখ থেকে ১লাখ ৬০ হাজার টাকা। ৫৭৬টি গাছে মধ্যে অর্ধ শতাধিক গাছ মৃত। বাকি ৫০০টি গাছের মধ্যে আরও ৫০টি ছোট গাছ। এর মধ্যে ৪৫০টি গাছ দানবাকৃতির না হলেও বৃহদাকৃতির। যার প্রত্যেকটির মূল্য বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী ৫০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা। সে অনুযায়ী এই ৯৫৪টি গাছের দাম প্রায় সোয় ৩ কোটি টাকা। এ মূল্য সাতনদী থেকে একাধীক গাছ ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ করে ও স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গাছের এ দাম নিশ্চিত হওয়া যায়। একটি এনজিও পরিচালকও যা নিশ্চিত করেছেন।
গাছগুলোর আছে মালিকানা:
জেলা পরিষদের গাছ নিলাম বিক্রয়ের টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর দিশারী এনজিও’র প্যাডে শেখ আহছাফুর রহমানের স্বাক্ষরিত একটি পত্রে গাছ গুলোর মালিকানা দাবি করে টেন্ডার মূল্যের ৬০ ভাগ অর্থ দাবী করা হয়। ওই পত্রে আরও উল্লেখ করা হয় যে, ২০ বছর পূর্বে এনজিওটি গাছ গুলো লাগিয়েছিলো। কিন্তু তাদের দাবির স্বপক্ষে কোন চুক্তিপত্র বা অনুমোদন দেখাতে না পারার কারণে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদ আবেদনটি নাকচ করে দেয়। তবে এই দাবীর পত্রে একাধীক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সিল ও সই দেখতে পাওয়া যায়।
এ নিয়ে সাতনদী’র অনুসন্ধানে স্থানীয় একটি সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে তৎকালীন তালা উপজেলার শিরাশুনিতে অবস্থিত ‘সেতু বাংলাদেশ’ নামক এনজিও কর্তৃক গাছ গুলো লাগানো হয়। ‘সেতু বাংলাদেশ’ এর পরিচালক এস এম আবুল হোসেনের গাছের রোপন ও মালিকানার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সাতনদীকে বিস্তারিত তথ্য দেন। মি. হোসেন বলেন, একটি মহল দীর্ঘদিন ধরে গাছ গুলো আত্মসাতের অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। তবে গাছ গুলো যে নিলাম হয়েছে যা তিনি জানতেন না।
মি. হোসেন সাতনদীকে আরও জানান জেলা পরিষদের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মশিউর রহমানের একটি এনজিও’র মাধ্যমে অনুমতি ও অনুমোদন সহ যাবতীয় আইনী প্রক্রীয়া সম্পন্ন করে গাছ গুলো লাগান। ওই গাছ গুলোর প্রকৃত মালিক তিনি। কারণ ওই সময়ে গাছ গুলো লাগানোর জন্য তিনি আমার সহায়তা চান। আমি এ সংক্রান্ত বৈধ কাগজপত্র দেখতে চাইলে তখন তিনি আমাকে তার সকল বৈধ কাগজপত্র দেখান। তবে তিনি মারা যাওয়ায় তার এনজিওর কার্যক্রম চলমান আছে কিনা তা আমার জানা নাই। অনেক বছর পূর্বের ঘটনা এনজিওটির নামও আমি মনে করতে পারছিনা। মশিউর রহমানের বাড়ি যশোর জেলায়। এনজিওটির পরিচালক আরও জানান, আমরা গাছ নিয়ে কাজ করি। ওই সড়কের গাছগুলোর দাম কমপক্ষে ২ কোটি টাকা।
যা বললেন মূল্য নির্ধারনকারী ফরেস্টার:
তালা-ইসলামকাটি-সুজনশাহা-পাটকেলঘাটা সড়কের বৃক্ষের মূল্য নির্ধারনকারী তালা উপজেলা ফরেস্টার ইউনুস আলী সাতনদীকে জানান, ইউনুস আলীর আগের অফিসার এ বিষয়ে বিস্তারিত কাজ করেছেন। তার অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করেন তিনি। এ ক্ষেত্রে সকল রেইনট্রি বা শিশু গাছের সরকারি রেট হলো সেফটি বা ঘনফুট ৩৪০টাকা এবং মেহগনি ৩৬০টাকা করে। এ হিসেবে ৯৫৪টি গাছের দর নির্ধারন করা হয় ৫৯ লাখ ৩১ হাজার ৯৪৫ টাকা। এর সাথে ভ্যাট ও ইনকাম ট্যাক্স যোগ হবে। এই রেট কম কিনা এ প্রশ্নের জবাবে মি. ইউনুস সাতনদীকে জানান, সরকার নির্ধারিত গাছের ঘনফুটের মূল্য এটি। এ ছাড়া গাছের গুড়িই মোটা বাকি অংশের দামতো আরও কম।
কীভাবে হল এমন কারসাজি:
মূলত ফরেস্টারদের কারসাজিতেই এমন অবস্থা হয় সব ধরনের গাছের টেন্ডারের। সরকারি গাছের মূল্য নির্ধারনে কারসাজি করেন ফরেস্টাররা। এ সুযোগকেই পুঁজি করে এত কম দামে টেন্ডার ইস্যু করা হয়। ফলে বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে বাংলাদেশ সরকার।
অভিযোগ আছে টেন্ডারবাজির:
অন্যদিকে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের তালা উপজেলার তালা-ইসলামকাটি-সুজনশাহা-পাটকেলঘাটা সড়কের দু’ধারের ৯৫৪টি দানবীয় আকারের গাছ বিক্রির জন্য টেন্ডার জমা দেওয়ার শেষ দিনে আরও একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। জেলা পরিষদের কিছু সদস্যদের প্রভাব খাটানোর অভিযোগ আছে। প্রভাবশালী ওই নেতাদের ইন্ধনে জেলার কিছু নেতা-কর্মীদের জড়ো করা হয় জেলা পরিষদ চত্ত¡রে। এসময় অন্যান্য ঠিকাদারদের টেন্ডার ড্রপে বাধা প্রদান করে তারা। সে জন্য ওই নেতা-কর্মীদের ১২ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান তারা বাঁধার মুখে টেন্ডার ড্রপ করতে পারেনি।
প্রশ্নবিদ্ধ এ টেন্ডার প্রক্রিয়া সাতটি লটে ৩৬টি ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান মোট ২০৪টি টেন্ডার ক্রয় করলেও ১৪টি টেন্ডার জমা পড়ে। যার মধ্যে ৭টি লটের ৭টিই পেয়ে যান পলাশপোলের আবুল হাসেম। অভিযোগ আছে যে ১৪টি টেন্ডার জমা পড়েছে তার সবকটিই হাসেমের জমাকৃত। টেন্ডার নিশ্চিতে প্রভাবশালী চক্রটি এসব টেন্ডারের রেট ফাঁসও করে।
যা বললেন আবুল হাসেম:
আবুল হাসেমের কাছে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় কোন রকম প্রভাব খাটানো হয়নি। আমিও কাউকে ১২ লাখ টাকাও দেই নি। এই গাছ গুলো কিনে বরং আমার লস হয়েছে।