
পর্ব -এক
জেলার অধীকাংশ ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নীতিমালা উপেক্ষিত
জহুরুল কবীর: সরকারি নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে সদর হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে অসংখ্য বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই গুনগতমান প্রশ্নবিদ্ধ। বিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় চাহিদার ন্য‚নতমও বিদ্যমান নেই এসব প্রতিষ্ঠানে। শুধু তাই নয়, সরকারি হাসপাতাল থেকে নির্দিষ্ট দ‚রত্ব বজায় রেখে বেসরকারি চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের যে নিয়ম রয়েছে, তার কোনো নজির খুজে পাওয়া যাবে না সাতক্ষীরা শহরে। বর্তমান সাতক্ষীরা এখন ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের শহরে রূপ নিয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, সদর হাসপাতাল থেকে দালালের মাধ্যমে রোগী ভাগিয়ে এনে তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয় খরচের পাহাড়। একজন ম‚মুর্ষ রোগীর একদিনে খরচ হয়, বেড (জরুরী কেবিন) ভাড়া তিন’শ থেকে দুই হাজার টাকা, অক্সিজেন এক’শ পঞ্চাশ থেকে ছয়শত টাকাসহ ইসিজি জরুরী ডাক্তার (প্রতিকল) ফিস, এক্স-রে ইত্যাদি ল্যাব টেস্ট খরচ বাবদ ১৫ থেকে ৪০ হাজার টাকার বিল ভাউচার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সাধারণ রোগীদের আর্থিক বিপদের সম্মুখিন করা হয়। যেন চিকিৎসার নামে ব্যবসার আড়ৎ। সাতক্ষিরা সদর হাসপাতালের সন্নিকটে গড়ে ওঠা এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কারোরই নেই হালনাগাৎ নিবন্ধন। এবিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের ভুমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। অভিযোগ আছে কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর মদতে এসমন্ত প্রতিষ্ঠানে অপরাধ অনিয়ম হয়েই চলেছে। অনুমোদন পেয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান।
খোদ সিভিল সার্জনের নাকের ডগায় বিধিবহির্ভ‚ত ও নিন্মমানের এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। কিন্তু এগুলোর তদারকি বা মান নিয়ন্ত্রণে নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। ফলে চিকিৎসা পাওয়ার বদলে প্রতারিত হচ্ছে চিকিৎসা প্রার্থীগণ।
প্রাপ্ততথ্যে জানা যায়, সরকারি হাসপাতাল থেকে এক কিলোমিটার বা বিশেষ ক্ষেত্রে আধা কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপনের সুযোগ নেই। কিন্তু সদর হাসপাতালের চারপাশে আধা কিলোমিটারের মধ্যেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
বিশেষ করে সদর হাসপাতালের প‚র্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশে গড়ে উঠেছে প্রায় ২০টির মতো ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এছাড়া কদমতলা থেকে সামেক হাসপাতাল পর্যন্ত ছোট-বড় প্রায় অর্ধশতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে।
এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই প্রয়োজনীয় ভৌত (কক্ষ) সুবিধা নেই। নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। নেই ডিউটি ডাক্তার, ডিপ্লোমা নার্স, টেকনিশিয়ান, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ প্রয়োজনীয় জনবল। ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিকের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশও নেই এসব প্রতিষ্ঠানে। বলতে গেলে প্রয়োজনীয় চাহিদার ন‚্যনতম সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান নেই এসব বেসরকারি ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। তার পরও এসব প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য বিভাগের নিবন্ধন পেয়েছে, নবায়নও হচ্ছে। আর এর সুবাদে উন্নত চিকিৎসাসেবার নামে মানুষ ঠকানোর ব্যবসা করছে এসব মানহীন প্রতিষ্ঠান।
স্বাস্থ্য বিভাগ স‚ত্রে জানা গেছে, বেসরকারি ক্লিনিকের নিবন্ধন পেতে প্রয়োজনীয় ভৌত সুবিধা, সার্বক্ষণিক ডাক্তার, ডিপ্লোমা নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়া, ক্লিনারসহ প্রয়োজনীয় জনবল, যন্ত্রপাতি, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ থাকা আবশ্যক। স‚ত্রমতে, ১০ বেডের একটি ক্লিনিকের অনুমোদনের ক্ষেত্রে শুধু রোগীর ওয়ার্ডের জন্য প্রতি বেডে ৮০ বর্গফুট করে মোট ৮০০ বর্গফুট জায়গা লাগবে। সেই সঙ্গে ওটি রুম, পোস্ট ওপারেটিভ রুম, ওয়াস রুম, ইনস্ট্রুমেন্ট রুম, লেবার রুম, ডক্টরস ডিউটি রুম, নার্সেস ডিউটি রুম, অপেক্ষমাণ কক্ষ, অভ্যর্থনাকক্ষ, অফিস কক্ষ, চেইনঞ্জিং রুম, স্টেরিলাইজার রুম, ভান্ডার রুমসহ সামঞ্জস্যপ‚র্ণ অন্তত ১৩টি রুম থাকতে হবে।
এছাড়া পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা প্রয়োজনীয়সংখ্যক টয়লেট, প্রশস্ত সিঁড়ি, জেনারেটরসহ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে (বিল্ডিং তিনতলার অধিক হলে) লিফটের ব্যবস্থা থাকতে হবে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ওপারেশন থিয়েটার, ওপারেশন টেবিল, ওপারেশন থিয়েটারে পর্যাপ্ত আলোর ব্যাবস্থা, সাকার মেশিন, অ্যানেসথেসিয়া মেশিন, ডায়াথারমি মেশিন, জরুরি ওষধসম‚হের ট্রে, রানিং ওয়াটার, অক্সিজেন, আইপিএসের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এছাড়া কোভিটসহ জরুরী রোগীদের জন্য সেন্টাল অক্সিজেন লাইনের ব্যাবস্থা থাকাটা জরুরী। সাধারণ বর্জ্য, ধারালো বর্জ্য, জীবাণুযুক্ত বর্জ্য, তরল বর্জ্যসহ সব ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও থাকা অণ্যাবশ্যকীয়। জনবলকাঠামোতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, তিন জন ডিউটি ডাক্তার, ছয় জন ডিপ্লোমা নার্স, প্রয়োজনীয় অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী, ওয়ার্ডবয়, আয়া, ক্লিনার থাকতে হবে। কিন্তু হাতে গোনা পাঁচ-সাতটি ছাড়া অধিকাংশ হাসপাতাল, ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এসব নিয়ম-নীতি উক্ষেত ।
এসব প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে। স্বাস্থ্য বিভাগের মদতে গড়ে ওঠা মানহীন এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারি হাসপাতাল, বাস স্ট্যান্ড থেকে পরিবহন চালকের ছদ্দবেশী দালালের মাধ্যমে রোগী ধরে এনে চিকিৎসাসেবার নামে প্রতারণা করছে প্রতিনিয়ত। পাড়া মহল্লার ‘গ্রাম ডাক্তার’গণ এসব প্রতিষ্ঠানের কমিশন এজেন্ট হিসেবে কাজ করে থাকেন।
সাতক্ষীরা বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান রাসেল বলেন, তাদের সমিতিভুক্ত ১৪০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সমিতির বাইরেও কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেছেন।
উপরোক্ত বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন ডাক্তার হোসেন সাফায়াত জানান, যেসমস্ত প্রতিষ্ঠানে নীতিমালা উপেক্ষিত সেসব প্রতিষ্ঠানের এরটিরও নিবন্ধন হালনাগাত নেই।