অনলাইন ডেস্ক :
বৈশ্বিক করোনায় দেশে আটকে পড়া সৌদি প্রবাসীদের কর্মস্থলে ফেরা নিয়ে অচলাবস্থা কাটছে না। দিন যত যাচ্ছে ক্রমেই বাড়ছে সংকট। গত তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে তারা গ্রাম থেকে রাজধানীতে এসে সমস্যা নিরসনের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন। গতকালও টিকিট-টোকেন ও চাকরি বাঁচানোর দাবিতে সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের সামনে জমায়েতকালে পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হন প্রবাসীরা। এসময় নারী প্রবাসীসহ আহত হন অনেকে।
টিকিট-টোকেন নিতে ভেতরে ঢুকতে না পেরে হোটেল সোনারগাঁওয়ের গেট ভাঙচুর করেন প্রবাসীরা। পরে বিকাল পর্যন্ত অবরোধ করেন তারা। নানা আশ্বাস দিয়েও মানানো যাচ্ছে না কারওয়ান বাজারে সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের ও মতিঝিলের বিমানের টিকিটের জন্য অপেক্ষারত প্রবাসীদের। সচিবালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়, ঢাকায় সৌদি দূতাবাসের সামনেও বিক্ষোভ করেছেন তারা। তাদের সকলের চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
জানা গেছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত ইকামা ও ছুটির মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলা হলেও সৌদি আরবে ভিসা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত এজেন্সি ও বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র বলছে, আনুষ্ঠানিকভাবে এখন পর্যন্ত নতুন করে ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। সরকারিভাবে মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলা হলেও তা আসলে মুখে মুখে। সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে কারও মেয়াদ বাড়েনি এবার।
সবাইকে আলাদা করে কফিলের সঙ্গে যোগাযোগ করে মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে হবে। কিন্তু সৌদি কর্তৃপক্ষ নবায়নের মাধ্যমে ভিসা ও ইকামার মেয়াদ বৃদ্ধিতে কঠিন শর্ত জুড়ে দিয়েছে। যা পূরণ করে একজন বাংলাদেশির পক্ষে নির্ধারিত সময়ে কাজে ফেরা প্রায় অসম্ভব। আবার অনেকের সব কিছু ঠিক থাকার পরও টিকিট পাচ্ছেন না। এতে তাদের যাত্রা নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বলেছেন, ‘সে দেশের কফিল (নিয়োগকর্তা) না চাইলে ভিসা ও ইকামার মেয়াদ বৃদ্ধি করবে না সৌদি কর্তৃপক্ষ। কারণ সেখানে ফিরে তো তাদের কফিলের সঙ্গে কাজ করতে হবে। কফিল যাদের চাচ্ছেন না, শুধু তারা যেতে পারবেন না, বাকিরা তো যাচ্ছেন।
’ এরই মধ্যে ইকামা ও ছুটির মেয়াদ বাড়ানোর নামে অনেক সৌদি মালিকের বিরুদ্ধে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ তুলছেন সৌদি ফেরত প্রবাসীরা। আবার টাকা নিয়েও অনেক সৌদি মালিক ছুটি ও ইকামার মেয়াদ বাড়ায়নি, এমন অভিযোগ প্রবাসীদের। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিসার মেয়াদ না বাড়ায় সৌদি কফিলদের ওপরই নির্ভর করছে সৌদিফেরত এসব প্রবাসীদের পুনরায় কাজে যোগ দেওয়ার বিষয়টি।
প্রবাসীরা বলছেন, সবার কফিল ভালো নয়। তাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে না বাড়ালে সবার মেয়াদ বাড়বে না। ইকামার জন্য সৌদি সরকারের বিভিন্ন ফি আছে। আবার অনেক প্রবাসী টাকার বিনিময়ে কফিলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকেন। এক বছরের ইকামার জন্য অনেক প্রবাসী কফিলকে ৫ থেকে ৬ হাজার রিয়াল (১ লাখ টাকার বেশি) দিয়ে থাকেন। তাই কর্মীর অনুপস্থিতিতে ইকামার মেয়াদ বাড়ানোর ঝুঁকি নিতে চাইবেন না কফিলরা।
৩০ সেপ্টেম্বর ইকামার মেয়াদ শেষ হওয়া নারায়ণগঞ্জের ভূইঁগড়ের আবদুল আলিম এবং তার চাচাতো ভাই রমিজ উদ্দিন ভুঁইয়া তাদের কফিলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তবে কফিল তাদের কাছে তিন হাজার রিয়াল চেয়েছেন। আবদুল আলিম ইত্তেফাককে বলেন, ‘করোনায় সাত মাস ধরে দেশে বসে আছি। সংসার চালাতে হচ্ছে ধার দেনা করে।
এর মধ্যে এত টাকা কোথায় পাবো?’ একই কথা বললেন নরসিংদী শিবপুরের তাকাসুর রহমান, খুলনার টুটপাড়ার মো.সেলিম। তারা বলেন, সৌদি মালিকরা ইচ্ছামতো অর্থ চাচ্ছেন। করোনা মহামারির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সরকার যদি সৌদি সরকারকে বুঝিয়ে কোন একটি ব্যবস্থা না করে তবে আমাদের পথে বসতে হবে। সমস্যা সমাধানে আবারও সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, নতুন সিদ্ধান্তের বিষয়টি হালনাগাদ করে সমস্যা সমাধানের জন্য ঢাকায় সৌদি দূতাবাস ও রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাস সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলছে। বায়রার একজন কর্মকর্তা জানান, ভিসা নবায়নের সুযোগ দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। তবে শর্ত কঠিন। সৌদি দূতাবাসের নিবন্ধিত রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে আবেদন করতে হবে।
আমরা ভিসা নবায়নের জন্য সৌদি দূতাবাসে আবেদন করলে তারা কফিলের কাগজ চাচ্ছে। কফিল যদি সেখানকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সত্যায়িত কাগজ না পাঠান তাহলে ভিসা নবায়ন করবে না তারা। ছুটি ও ইকামার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য সৌদি কফিলদের অনেকেই বাড়তি টাকা দাবি করছেন। সৌদি আরব বলছে, ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত তারা ইকামার মেয়াদ বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু ছুটির মেয়াদ বাড়াতে হলে কর্মীদের তাঁর কফিলকে রাজি করাতে হবে।
এদিকে ভিসা, ইকামা ও ফ্লাইটের টিকিটসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে দেশে অবস্থান করা প্রবাসী কর্মীদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এ জন্য শিগগিরই গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে। এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে অবস্থান করা সৌদিসহ মধ্যেপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের প্রবাসী কর্মীদের কার কী সমস্যা তার সঠিক তথ্য মন্ত্রণালয়ে নেই।
সৌদি প্রবাসীদের ওপর লাঠিচার্জ:রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ের সামনে টাকেন নিতে গিয়ে লাঠিপেটার শিকার হলেন সৌদি প্রবাসীরা। প্রতিদিনের মতো গতকাল রবিবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের সামনে ভিড় করেন তারা। এ সময় টোকেন নিতে ভেতরে ঢুকতে না পেরে হোটেল সোনারগাঁওয়ের গেট ভাঙচুর করেন সৌদিগামীরা।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। জানা যায়, গতকাল ৪৫০ জনকে টোকেন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ১০ হাজারের বেশি লোকসমাগম হয়। তাদের ফরম দেওয়া হয়। সবাই ভিসার মেয়াদ, পাসপোর্ট নম্বর ও মোবাইল নম্বর লেখেন। পরে দুপুর দেড়টার দিকে ভিসার মেয়াদ বিবেচনায় দেড় হাজার টোকেন দেওয়ার কথা জানায় সাউদিয়া এয়ারলাইন্স।
সূত্র-ইত্তেফাক