শরতের স্নিগ্ধ বিকেল থেকে আঁধারের বুক চিরে জোনাকির রূপালী সেলাই সন্ধে পর্যন্ত সুর-ছন্দ আর আলোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিল দৈনিক সাতক্ষীরার সকাল অফিস। বসেছিল কবি, সাহিত্যিক, লেখকদের সাহিত্য আড্ডা। জেলার গৌরবগাঁথা ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে জমে উঠেছিল শারদ সন্ধ্যের আড্ডা। নীল আকাশের সাদা মেঘ নিয়ে আসে কোমল আনন্দের বার্তা রসময়, নির্মল শরৎ প্রকৃতির সাথে সাথে মানুষের মনকেও করে তোলে কাব্যিক রাতের অপূর্ব স্বচ্ছ জোছনায় ভিজে উঠে কবি-মন। সৃষ্টি হয় অসাধারণ সব কবিতা, গান আর সুরের। চর্যাপদের কবি থেকে শুরু করে আধুনিক কবিরাও শরতের নান্দনিকতায় সৃষ্টি করেছেন সাহিত্যের অমিয় সুধা। নানা অগোছালো বিষয়ে কথা চলছে। আড্ডায় যেভাবে কথা হয় ঠিক সেভাবেই জমিয়ে কথা বলছিলেন কবি-সাহিত্যিকরা। জমে গেল আড্ডা। শুরুতেই লেখালেখি নিয়ে। সাতক্ষীরার কবি-সাহিত্যিকদের লেখা ও প্রকাশনা নিয়ে কথা বললেন বরেণ্য গীতিকার ও লেখক মোকাম আলী খান এবং বরেণ্য কবি ও লেখক শুভ্র আহমেদ। কোন পত্র-পত্রিকায় সাহিত্য সংখ্যা প্রকাশিত হয় তা নিয়ে হলো আলোচনা। আলোচনায় কোন কোন বিষয় বেশি প্রাধান্য পায়, কোন ধরণের লেখা ছাপা হয় এবং লেখা কীভাবে সম্পাদনা করা হয় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বলেন দৈনিক সাতনদীর সহকারী সম্পাদক জহুরুল কবীর, দৈনিক হৃদয় বার্তার সাহিত্য সম্পাদক সরদার গিয়াস উদ্দীন, দৈনিক সাতক্ষীরার সকালের সাহিত্য সম্পাদক শেখ সিদ্দিকুর রহমানসহ অন্যরা।
আলোচনার এক পর্যায়ে দৈনিক সাতক্ষীরার সকালের নির্বাহী সম্পাদক আমিরুজ্জামান বাবু প্লেট ভর্তি খাবার নিয়ে হাজির। আলোচনা এ পর্যায়ে কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর মনোযোগ গেল খাবারের দিকে। খাবারের পর এল কফি। কফির আড্ডা শেষে শুরু হলো ফের আলোচনা। এ পর্যায়ে দৈনিক পত্রদূতের বার্তা সম্পাদক এসএম শহীদুল ইসলাম বলেন, জেলার সাহিত্য-সংস্কৃতি অত্যন্ত গর্বের। সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশ যেভাবে হওয়ার কথা সেভাবে হচ্ছে না। সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রগুলো একটি বিশেষ গোষ্ঠী দখল করে নিয়েছে। খেলার মাঠগুলো দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। সেখানে আর আগের মতো সংস্কৃতি চর্চা হয় না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মুক্ত চিন্তার ক্ষেত্রগুলো আজ যান্ত্রিকতায় বন্দি।
আলোচনায় সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক এবং বাংলাদেশ বেতারের কর্মী বিশিষ্ট কবি গাজী মোমিন উদ্দীন বলেন, সাংবাদিকতা সাহিত্যের অংশ। তাদের লেখনি সমাজকে বদলে দিতে পারে। কিন্তু বর্তমানে সাংবাদিকতার যে দৈন্য-দশা তাতে এ পেশার মান-মর্যাদা ধ্বংসের দ্বারে। কোন একটি ঘটনা শোনা মাত্রই একশ্রেণির ব্যক্তি দলবল নিয়ে হাজির হয়। তাদের দাবি পূরণ না হলে সম্মানহানী করা হয়। এ অবস্থা থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে।
দৈনিক পত্রদূতের সাহিত্য সম্পাদক গাজী শাহজাহান সিরাজ বলেন, কবি-সাহিত্যিকরা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখালেখি করেন। যখনই কোন লেখক নিরপেক্ষতা হারিয়ে ফেলেন তখন তাঁর লেখাও হারিয়ে যায়। তাই দেশ ও দেশের জনগণের জন্য কলম ধরতে হবে। কবিতা, গান, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, নাটকসহ সাহিত্যের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে সাতক্ষীরার নাম। সাতক্ষীরার সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব সবার। ঠাকুর মার ঝুলিতে যেমন থাকে সব গল্পের সমাহার আর কবিদের ঝোলাতে হয়ত সব নান্দনিক কবিতার সমাহার। এবার গাজী মোমিন উদ্দীনের কন্ঠে শোনা গেল স্বরচিত কবিতা ‘ধোনোন’। আঞ্চলিক ভাষায় লেখা কবিতাটি আশ্বিনের পড়ন্ত বিকেলে এনে দিয়েছিল প্রশান্তির পরশ। এরপর স্বরচিত কবিতা বৃষ্টি বিলাশ আবৃত্তি করে ইলিশ বন্দনা করেন কবি তামান্না জাবরিন। দৈনিক কালের চিত্রের সাহিত্য সম্পাদক গাজী হাবিবও বসে ছিলেন না। তিনি মাঝে মাঝে ছবি তুলে স্মৃতির ফ্রেমে আটকে রাখছিলেন। কবি ও লেখক শুভ্র আহমেদ বলেন, কবিতা জীবনের কথা বলে। সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে সৃজনশীল মানুষ তৈরি হয়। মানবিক মূল্যবোধের সৃষ্টি হয়। কবিতা ও গানে আমাদের আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখের অনুভূতি প্রকাশ হয়। সমাজকে জাগ্রত করে কবি, সাহিত্যিক ও লেখকরা। দৈনিক সাতক্ষীরার সকাল সবে পথচলা শুরু করেছে। আগামীতে তাদের এ পথচলা আরও সুন্দর হোক-এ কামনা করি। সাবেক জেলা শিক্ষা অফিসার কবি কিশোরী মোহন সরকার বলেন, শারদ বিকেলের এ কাব্যিক আয়োজন অত্যন্ত চমৎকার। সাতক্ষীরা থেকে প্রকাশিত সব পত্রিকায় জেলার সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে লেখালেখি করলে অবশ্যই বিকশিত হবে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মহান ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে ধারণ করতে হবে। আগামী প্রজন্মকেও সেভাবে গড়ে তুলতে হবে। অসাম্প্রদায়িক মানবিক মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে হবে। লেখনীতে সেই মেসেজ থাকতে হবে। শান্তিময় সমাজ গঠনে কবি-সাহিত্যিকদের ভূমিকা অপরিসীম। তিনি দৈনিক সাতক্ষীরার সকাল পত্রিকার এ মহতী উদ্যোগকে প্রশংসা করে বলেন, সাহিত্যপাতা যদি রঙিন করা যায় তাহলে আরও সুন্দর হবে। কবি-সাহিত্যিকরা লেখায় উদ্বুদ্ধ হবে। ইতোমধ্যে আড্ডায় আবেদন এল দৈনিক পত্রদূতের বার্তা সম্পাদক এসএম শহীদুল ইসলামকে অভিনয় করতে হবে। আবেদনে সাড়া দিয়ে এসএম শহীদুল ইসলাম ‘নবাব সিরাজউদ-দৌলা’ নাটকের একটি অংশ অভিনয় করেন। এরপর বক্তব্য রাখেন সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর বাসুদেব বসু।
অধ্যক্ষ বাসুদেব বসু বলেন, তুমি আমার প্রথম সকাল/ একাকি বিকেল ক্লান্ত দুপুর বেলা/ তুমি আমার সারা দিন আমার/ তুমি আমার সারা বেলা। অনেক জাতীয় পত্রিকার ভীড়ে সাতক্ষীরার স্থানীয় পত্রিকা পড়ার মধ্য দিয়েই শুরু হয় আমার প্রতিটি সকাল। তারমধ্যে দৈনিক সাতক্ষীরার সকাল পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদগুলো পড়ি। আমরা চাই বস্তুনিষ্ঠ সত্য সংবাদ। দৈনিক সাতক্ষীরার সকাল সত্যের পথে অবিচল থাকুক। অধ্যক্ষ বাসুদেব বসু আরও বলেন, মানুষের চিন্তা, ভাব, আবেগ, অনুভূতি, কল্পনা- এ সবই সাহিত্যের উপজীব্য। এগুলোকে সামনে রেখে মানুষ এগিয়ে যায় প্রগতির পথে। সমাজ পরিবর্তনশীল। সমাজের সর্বত্র প্রতিনিয়ত রদবদল হচ্ছে। সাহিত্যের ভূমিকা শুধু অতীত ও বর্তমানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ভবিষ্যৎ পৃথিবী কেমন চাই তারও একটি ইশারা দেয় সাহিত্য।
সাহিত্য ব্যক্তিকে মার্জিত করে তোলে এবং আবেগ, অনুভূতি ও মূল্যবোধকে জীবনের সামগ্রী করে নেয়ার প্রেরণা জোগায়। সুন্দর মনের সুন্দর মানুষ ছাড়া সাহিত্যচর্চা কোনোদিনই সফল হতে পারে না। মনকে সুন্দর ও সজীব করে তোলে সাহিত্য। সাহিত্য মানে সহযোগিতা ও সহমর্মিতা, জীবনে জীবন যোগ করা। এই চেতনাই সমাজের উন্নয়নের মূল বিষয়। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, বিচারহীনতা- এসব সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরম শত্রু এবং সমাজ-প্রগতির প্রবল বাধা।
সাহিত্য সত্য, সুন্দর, আনন্দময় অনুভূতিতে পাঠক হৃদয়কে জাগিয়ে তোলে। হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিও পেতে পারে মহৎ জীবনের আভাস। পাষাণবৎ মানুষও নতুন করে খুঁজে পায় মনুষ্যত্ব। কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশে সাহিত্যপাঠ হতে পারে একটি কৌশল। সাহিত্যপাঠের মতো নির্মল ও পবিত্র আনন্দ আর নেই।
তিনি বলেন, সাতক্ষীরার কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারে সাংবাদিকদের বেশি গুরুত্ব দিয়ে লিখতে হবে। জেলার জলাবদ্ধতা, অনুন্নত যাতায়াতও যোগাযোগ ব্যবস্থা, যানজট এসব সমস্যার কথা তুলে ধরতে হবে। একই সাথে জেলার রেললাইন, অর্থনৈতিক জোন, ভোমরা বন্দর, ক্রীড়া কমপ্লেক্স, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারের নানামূখী উদ্যোগের খবর আপডেট দিতে হবে। তবেই জনগণ পত্রিকার প্রতি আরও বেশি আস্থাশীল হবে।
তিনি দৈনিক সাতক্ষীরার সকাল পত্রিকার সমৃদ্ধি ও চিরকল্যাণ কামনা করেন। ইতোমধ্যে দৈনিক সাতক্ষীরার সকাল পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক উপস্থিত সকলের উপহার নিয়ে হাজির।
এবার ফটো সেসনের পালা। দৈনিক সাতক্ষীরার সকাল পত্রিকার সহকারী বার্তা সম্পাদক আলতাফ হোসেন বাবু প্রস্তুত ক্যামেরা নিয়ে। তোলা হলো ছবি। ছবি তোলার পর সাহিত্য আড্ডার সভাপতি দৈনিক সাতক্ষীরার সকাল পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক শেখ সিদ্দিকুর রহমান জানালেন, দৈনিক সাতক্ষীরার সকাল পত্রিকার সম্পাদক তারেকুজ্জামান খানের পিতা মনিরুজ্জামান খান ছিলেন একজন নাট্যকার ও সংস্কৃতিজন। তিনি ড্রামেটিক ক্লাবের সদস্য ছিলেন। জেলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে তাঁর অবদান রয়েছে। ব্যাঘ্রতট নামে একটি বইয়ে তাঁকে নিয়ে লেখা আছে। তাঁর স্বপ্ন পূরণে দৈনিক সাতক্ষীরার সকাল পত্রিকার প্রকাশনা। আগামীতে দৈনিক সাতক্ষীরার সকাল পত্রিকার আয়োজনে জেলার সাহিত্যজনদের নিয়ে একটি বড় প্রোগ্রাম করা হবে। এজন্য তিনি সকলের পরামর্শ কামনা করেন। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে দৈনিক সাতক্ষীরার সকাল পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক তারেকুজ্জামান খান অসুস্থ অবস্থায় মোবাইলে সকল কবি সাহিত্যিকদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। বিকেল গত হয়ে সন্ধ্যার ছায়া নেমে এল। এবার আসর ভাঙার পালা। অবশেষে আড্ডার আসর ভাঙলো।
সাহিত্য আড্ডায় কবি-সাহিত্যিকদের মিলনমেলা
পূর্ববর্তী পোস্ট