** মুল আসামী মাসুদ বাহিনী, মামলা হলো নিরাপরাধ ও নিরীহ মানুষের নামে।
** হত্যা চেষ্টা ও হামলায় অংশ নেয় মাসুদ গ্যাংয়ের সদস্যরা হলো: রিপন মোড়ল, মেহেদী হাসান, ইউনুস, শহিদুল, সেলিম, ফাহিম, আমিনুর ও ইশার আলী।
*** জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হলো অনেককে।
** মামলাবাজ রাউফুজ্জামান ওরফে লাদেন বাবু পুরনো শত্রুদের ঘায়েল করতে মরিয়া।
রফিকুল ইসলাম:
সাতক্ষীরা সদর থানায় মাসুদ গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় পুরনো শত্রুতার জেরে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল ও জব্দ করতে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে কয়েকজন নিরীহ মানুষকে মামলার আসামী করা হয়েছে। যাকে বলা হয় এক ঢিলে দুই পাখি শিকার। এই মামলা নিয়ে এলাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিন ঘুরে ও মামলা সূত্রে প্রকাশ, গত ১৪ জুন বিকালে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার পূর্ব দহাকুলা গ্রামের মোঃ তাজেলের পুত্র মাসুদ রানা ওরফে কোপা মাসুদের নেতৃত্বে তার বাহিনী মাংস কাটা কোপা, হাতুড়ী ও জিআই পাইপ নিয়ে ৩/৪ টি মোটরসাইকেলে প্রকাশ্যে রেকি করছিল।
শহরের মুনজিতপুর গ্রামের মৃত আব্দুল মাজেদ মাষ্টারের পুত্র মোঃ রাউফুজ্জামান ওরফে লাদেন বাবুর উপর পুরনো শত্রুতার প্রতিশোধ নিতে ও হিসাব-নিকাশ মেটাতে ধুলিহরে লাদেন বাবু আসবে এমন খবরের ভিত্তিতে আগে থেকেই পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মাসুদ গ্যাংয়ের তোড়-জোড় ও প্রস্তুতি ছিল। ১৪ জুন বিকালে ব্রহ্মরাজপুর ইউনিয়ন পরিষদ সড়কে আগে থেকেই ওৎপেতে থাকা মাসুদ রানা গ্যাং লাদেন বাবু ও তার মোটরসাইকেলের আরোহী মুনজিতপুর গ্রামের মোঃ মুনছুর আলীর পুত্র আব্দুল হামিদ ধুলিহরে যাওয়ার পথে গতিরোধ করে থামায়। পরে মাসুদ রানা হত্যার উদ্দেশ্যে মাংস কাটা কোপা দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। এ সময় মাসুদ রানার সাথে তাদেরকে হত্যা চেষ্টায় অংশ নেয় মাসুদ রানা গ্যাংয়ের অন্যতম সদস্য ওমরাপাড়া গ্রামের মৃত ইব্রাহিম মোড়লের পুত্র রিপন মোড়ল, ছলেমান হাজীর পুত্র মেহেদী হাসান, লবনগোলা গ্রামের মহব্বত আলীর পুত্র শহিদুল ইসলাম, পূর্ব দহাকুলা গ্রামের মোঃ আমের আলীর পুত্র ইউনুস আলী, আব্দুস সোবহানের পুত্র সেলিম, আজিম উদ্দীন সরদারের পুত্র আমিনুর, জিয়ারুল ইসলামের পুত্র ফাহিম ও চেলারডাঙ্গা গ্রামের আরশাদ আলির পুত্র ইশার আলী। এদের কারো হাতে জিআই পাইপ কারো হাতে হাতুড়ী ও কারো হাতে মাংস কাটা কোপা ছিল। সবাই যখন এলোপাতাড়ি আক্রমন করতে থাকে তখন আব্দুল হামিদ রক্তাক্ত হাড়কাটা জখম হয়ে ঘটনাস্থল থেকে দৌড়ে পালায়। অপরদিকে লাদেন বাবু হেলমেট পরা অবস্থায় ছিল বলে তার মাথায় একাধিক আঘাত হলেও প্রানে রক্ষা পায়। তবে তার সারা শরীর মাংসকাটা কোপা, হাতুড়ী ও জিআই পাইপের আঘাতে জর্জরিত হয়। এ সময় লাদেন বাবু সন্ত্রাসীদের সাথে জবরদস্তি করে ব্রহ্মরাজপুর বাজার এলাকায় আসলেও প্রকাশ্যে তাকে তরকারি পট্রিতে ফেলে দ্বিতীয় দফায় মারপিট করে। বাজারের লোকজন জড়ো হতে থাকলে মাসুদ গ্যাং ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। লাদেন বাবুর মোটরসাইকেলও সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ করে।
পরবর্তীতে লাদেন বাবু ৯৯৯ এ ফোন করে পুলিশের সাহায্য চাইলে সাতক্ষীরা সদর থানার অফিসার ইনচার্জের নির্দেশে ব্রহ্মরাজপুর পুলিশ ক্যাম্পের এ,এস,আই আজিম উদ্দীন মোটরসাইকেলসহ তাকে আশংকাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে।
অপরদিকে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে রক্ষা পাওয়া আব্দুল হামিদ এলাকার মানুষের সহায়তা নিয়ে গুরুতর অসূস্থ অবস্থায় সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়।
এ ঘটনায় রাউফুজ্জামান ওরফে লাদেন বাবু বাদী হয়ে সাতক্ষীরা সদর থানায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে ও ৪/৫ জনকে অজ্ঞাত দেখিয়ে একটি মামলা দায়ের করে। যার মামলা নং-৫৭, তাং-১৯/০৬/২০২১ ইং।
এই মামলায় লাদেন বাবু ফায়দা লুটতে যারা আদৌও জড়িত নয় তাদেরকে আসামী করা হয়েছে। শুধুমাত্র পূর্ব শত্রুতার জেরে তাদেরকে জড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে মামলার ৪নং, ৬নং ও ১৭নং আসামী দামারপোতা গ্রামের আব্দুল খালেক মজলিশের তিন পুত্র মোঃ কামরুজ্জামান, তৌহিদুজ্জামান ও হাফিজুল ইসলাম ঘটনার দিন ও সময়ে কেউ এলাকায় উপস্থিত ছিলেন না। ঘটনাস্থলের আশ-পাশের একাধিক ব্যক্তির সাথে আমাদের এ প্রতিবেদক কথা বলে নিশ্চিত হয়েছে।
যে কারনে লাদেন বাবুর উপর হামলা ও হত্যা চেষ্টা:
সাতক্ষীরা সদর থানাধীন ব্রহ্মরাজপুর মৌজার মাছখোলা ছাগলা গেইটের দক্ষিণ পূর্ব পার্শ্বের প্রায় চার বিঘার একটি মৎস্য ঘের নিয়ে দামারপোতা গ্রামের মৃত আপ্তাব বিশ্বাসের পুত্র সিরাজ উদ্দীন বিশ্বাসের সাথে রাউফুজ্জামান ওরফে লাদেন বাবুর পরিবারের সাথে জমির দখল সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বিরোধ চলে আসছে। গত ইং ১৭/০৪/২০২১ তারিখে উক্ত মৎস্য ঘের নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে পুনরায় গোলযোগ ও মারামারি হয়। এই গোলযোগে সিরাজ উদ্দীন বিশ্বাসের পক্ষ নিয়ে মাসুদ রানা বাহিনী মৎস্য ঘেরে হাজির হলে প্রতিপক্ষের লোকজন আচমকা হামলা চালিয়ে মাসুদ রানা ও রিপন মোড়ল সহ কয়েকজন রক্তাক্ত জখম করে। এই হামলার ঘটনায় উভয়পক্ষের দুইটি পৃথক মামলা সাতক্ষীরা সদর থানায় রেকর্ড হয়। যার একটি মামলা নং-৩৩, তারিখ: ১৯/০৪/২০২১ইং। অপর মামলা নং-১৪, তাং-০৫/০৫/২০২১ইং। এদিকে মাসুদ রানা সহ তার বাহিনীর সদস্যরা সূস্থ হওয়ার পর থেকে হামলা ও মারপিটের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া ওঠে। এলাকায় পেলে কঠিন জবাব ও শায়েস্তা করা হবে বলে আষ্ফালন এবং হুংকার দিয়ে তাদেরকে অনুসন্ধান ও সুযোগ খুঁজতে থাকে। এসবের জের ধরে মাসুদ বাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে রাউফুজ্জামান ওরফে লাদেন বাবুর উপর হামলা ও হত্যা চেষ্টা চালায়।
কে এই দূর্ধর্ষ সন্ত্রাসী মাসুদ রানা :
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ব্রহ্মরাজপুর ইউনিয়নের পূর্ব দহাকুলা গ্রামের মোঃ তাজেলের পুত্র মাসুদ রানা (৩৬)। ২০১৩ সালে গাছ কাটা, নাশকতা, বিষ্ফোরক দ্রব্য আইনের একাধিক মামলা, জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মামলার রায়ের দিন সিটি কলেজের ছাত্রলীগ নেতা মামুন হত্যা, শাহীন হত্যা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজীর একাধিক মামলা, মৃত গ্রাম পুলিশ শামসুর রহমানের উপর হামলা ও হাত ভেঙ্গে দেয়া মামলা, ওমরাপাড়া বকুল মোড়লের উপর প্রকাশ্যে হামিলা চালিয়ে বাম হাত মাংস কাটা কোপা দিয়ে কুপিয়ে পঙ্গু করে দেয়া, মৃত ইউপি মেম্বার রেজাউল করিম মঙ্গলের উপর হামলা মামলা, চাঁদার দাবীতে ব্রহ্মরাজপুর বাজারের গাজী মার্কেটে হামলা চালিয়ে তিন ব্যবসায়ীকে জখমের মামলা, পূর্ব দহাকুলা গ্রামের আজিমুদ্দিনের পুত্র জিয়ারুল ইসলামের উপর হামলা সহ একাধিক ঘটনায় অভিযুক্ত মাসুদ রানা। এলাকায় তাকে কেউ সন্ত্রাসী মাসুদ আবার কেউবা কোপা মাসুদ বলে থাকে। ভাড়াটে হিসাবে ঘের দখল, জমি দখল, হামলা-মারপিট, টাকা আদায় কাজে নিজেকে ব্যবহার করতো। এক সময় মাসুদ এলাকায় মূর্তিমান আতংকের নাম হয়ে ওঠে। এলাকায় কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় না। কেউ বিরুদ্ধে গেলেই তার উপর নেমে আসে নির্যাতন। প্রায় দুই ডজন মামলা মাথায় নিয়ে মাসুদ রানা ২০১৬ সালে কয়েকটি মামলায় জামিনে জেল থেকে বের হয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। ২০১৯ সালে এলাকায় ফিরে এসে আবারও ব্যাপকভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। মাসুদ রানার নামে সাতক্ষীরা আদালতে একাধিক গ্রেপ্তারী পরোয়ানা রয়েছে। তবে কোন এক অদৃশ্য শক্তির কারনে সেই সমস্ত ওয়ারেন্ট আলোর মুখ দেখছে না। যে কোন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড তার পেশা ও নেশা। এছাড়া মাদকাসক্ত ও মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। এলাকার বখাটে, চিহ্নিত চোর-ডাকাত ও মাদকাসক্তদের নিয়ে এবার গড়ে তুলেছে অপরাধ সম্রাজ্য। পারিবারিকভাবে তার অবস্থান শূন্য। দিন আনে দিন খায় তার পরিবারের সদস্যরা। আর্থিক স্বচ্ছলতা বলতে কিছুই নেই তাদের। অথচ রাজকীয় জীবন-যাপন করে এই মাসুদ রানা। এলাকায় গণহারে চাঁদাবাজী করে মাসুদ রানা সহ তার দলের সদস্যরা কয়েকটি মোটরসাইকেল কিনেছে। এসব মোটরসাইকেলে দিনে ও রাতে এলাকায় শো-ডাউন দিয়ে মানুষকে ত্রাসে রেখেছে। অপরাধ হলো মাসুদ রানা গ্যাংয়ের প্রধান কাজ। মাসুদ রানা গ্যাংয়ের সেকেন্ড ইন কমান্ড রিপন মোড়ল ও মেহেদী হাসান। অভিযোগ আছে, মাঝে মাঝে মাসুদ রানা গ্যাং বিভিন্ন এলাকায় দিনে ও রাতে পুলিশ, ডিবি, সিআইডি ও বিজিবি পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজী করে। এলাকার তাসের জুয়ার বোর্ড ও মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসুদ গ্যাংয়ের নামে মাসিক চুক্তিতে টাকা উত্তোলন হয়। মাসুদ রানা গ্যাংয়ের কাছে সব সময় মাংস কাটা কোপা, জিআই পাইপ ও হাতুড়ী থাকে। বিশেষ কায়দায় তাদের শরীরে এসব লুকিয়ে রাখে। প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে।
যে কারনে নিরাপরাধ ও নিরীহ মানুষের নামে মামলা :
পুরনো শত্রুতার জেরে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল ও জব্দ করতে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে রাউফুজ্জামান ওরফে লাদেন বাবু কয়েকজন নিরাপরাধ ও নিরীহ মানুষের নামে অন্যায়ভাবে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। মূলত জমি-জমা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে যাদের সাথে রাউফুজ্জামান ওরফে লাদেন বাবু ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরোধ রয়েছে তাদেরকে শায়েস্তা করতে মামলা নং-৫৭, তাং-১৯/০৬/২০২১ এই মামলায় মূল আসামীর পাশাপাশি তাদেরকে জড়ানো হয়েছে। তবে এটাও সত্য যে, লাদেন বাবুর উপর হামলার প্রধান আসামী মাসুদ রানার কিছু একান্ত সহযোগীকে ওই মামলায় আসামী করা হয়েছে।
রাউফুজ্জামান ওরফে লাদেন বাবু’র বক্তব্য :
রাউফুজ্জামান ওরফে লাদেন বাবু আমাদের এ প্রতিবেদককে জানান, দুটি কারনে আমার উপর হামলা ও হত্যা চেষ্টা চালানো হতে পারে। একটি হলো, ২০০৬ সালে আমার আপন ভাই রাফেউজ্জামান জমি-জমি সংক্রান্ত বিরোধে খুন হন। এই মামলায় আমি ১নং স্বাক্ষী। অপরটি হলো, সম্প্রতি ব্রহ্মরাজপুর মৌজায় একটি মৎস্য ঘের নিয়ে দামারপোতা এলাকার কয়েকজনের সাথে বিরোধ হয়। এই দুটি বিরোধকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষরা মাসুদ গ্যাংকে ভাড়াটে হিসেবে ব্যবহার করে আমার উপর হামলা ও হত্যার চেষ্টা চালাতে পারে বলে ধারণা করছি।
হামলা ও হত্যা চেষ্টা করলো মাসুদ গ্যাং অথচ সেই মামলায় মুল আসামীর পাশাপাশি কয়েকজন নিরাপরাধ ও নিরীহ মানুষের নামে অন্যায়ভাবে মিথ্যা মামলা দিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি উত্তরে বিষয়টি এড়িয়ে যান।