
আকরামুল ইসলাম: প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৯টা। চিকিৎসক ও রোগীরা পৌঁছানোর পূর্বে হাসপাতালে হাজির হয়ে যায় ঔষধ কোম্পানী প্রতিনিধিরা। এরপর ডাক্তার এসে রোগী দেখে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বাইরে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় ওষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে টানাহেচড়া। কোন কোম্পানীর ঔষধ চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে লিখেছেন প্রথম পর্যায়ে সেটি দেখার প্রতিযোগিতা।
শুধু দেখা নয় একটি ছবিও মোবাইলে ফোনে ধারণ করে রাখেন এসব প্রতিনিধি। প্রায় দেড়শ ঔষধ কোম্পানীর সাড়ে চারশ প্রতিনিধি প্রতিদিন দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে জেলার হাসপাতালগুলো। ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের এমন কর্মকাণ্ডে একদিকে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে রোগীরা। অন্যদিকে, চিকিৎসকরা বলছেন, আমরাও অতিষ্ট। তবে শিক্ষিত এসব চাকুরীজীবীদের অসম্মান করতেও দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ছি।
রোগীদের অভিযোগ, সরকারি হাসপাতালের মধ্যে ডুকে এমন কার্যক্রম চালালেও হাসপাতালের প্রশাসন নিরব। তবে ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধি নেতাদের দাবি, শনিবার ও মঙ্গলবার ছাড়া কোন প্রতিনিধি হাসপাতালে প্রবেশ করেন না। কেউ গেলে নিজ দায়িত্বে যান দায়ভার কোম্পানীর নয়।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ওৎ পেতে আছেন ওষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিরা। চিকিৎসক রোগীকে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে ছেড়ে দিলেই শুরু হয় ব্যবস্থাপত্র নিয়ে টানাটানি। জেলা সদর হাসপাতালে রোগীর চেয়ে ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ভিড়ে নাকাল বৃদ্ধ, শিশু ও মহিলা রোগীরা। রোগীর ব্যবস্থাপত্র নিয়ে ফটোশেসনে মেতেছেন প্রতিনিধিরা। রোগীদের বসার চেয়ারগুলোতে ব্যাগ রেখে যেন দোকান খুলে বসেছেন।
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের এক কর্মচারি দাবি, প্রতিদিন সকাল থেকেই বহিঃর্বিভাগ খোলা থাকা পর্যন্ত রিপ্রেজেনটেটিভদের ভিড় থাকে। ডাক্তারের চিকিৎসা নিয়ে রোগীরা বেরিয়ে এলেই প্রেসক্রিপশন দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে এসব প্রতিনিধিরা।
তিনি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আমার নামটি প্রকাশ করবেন না। ছোট কর্মচারি প্রকাশ করলে চাপ পড়বে আমার উপর।
তালা সদরের শিবপুর গ্রাম থেকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন হাজিদা বেগম। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক (মেডিসিন) ড. কাজী আরিফকে দেখিয়ে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্রটি হাত থেকে নেন রেনেটা কোম্পানীর প্রতিনিধি মিকাইল ইসলাম। ব্যবস্থাপত্রের একটি ছবি তুলে আবার ফেরৎ দেন।
হাজিদা বেগম বলেন, হাসপাতাল বা কোন চেম্বারে ডাক্তারকে দেখাতে গেলেই বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রেসক্রিপশন নিয়ে নেন রিপ্রেনটেটিভরা। ডাক্তার কোন ওষধ লিখলো সেটি তাদের দেখতে হবে। এই ঘটনা চলছে অহরহ। বাঁধা দেওয়ার মত কেউ নেই। গ্রাম থেকে আমার মত আসা রোগীরা কি বা করতে পারবে।
ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, মানুষ আসে রোগ নিয়ে বিপদে পড়ে আর এদের ঔষধ বিক্রি করতে হবে। মানুষ বাঁচলো না মরলো এটা তাদের দেখার দরকার নেই।
তবে এ ব্যাপারে রেনেটা কোম্পানীর প্রফেশনাল সার্ভিস অফিসার মিকাইল ইসলাম বলেন, ডা. কাজী আরিফ স্যারের কাছে এসেছিলাম। ব্যবস্থাপত্রটি দেখলাম এছাড়া কিছু নয়।
পেটে ব্যাথা নিয়ে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ডাক্তার দেখানোর জন্য যান সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী রুহুল আমিন। সঙ্গে ছিলেন উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী শাহিন বিল্লাহ্। ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের দৌরাত্নে ডাক্তারকেই দেখানোর সুযোগ পাননি তারা।
শিক্ষার্থী শাহিন বিল্লাহ্ জানান, হাসপাতালে ওষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের দৌরাত্নের কারণে ডাক্তারদের রোগী দেখতেও হিসসিম খেতে হয়। সকাল ৯টার পর থেকেই আগমন ঘটে এসব প্রতিনিধিদের। বন্ধু রুহুল আমিনকে ডাক্তার দেখানোর জন্য নিয়ে গেলেও দেখানোর সুযোগ হয়নি রিপ্রেজেনটেটিভদের চাপে। প্রতিনিধিরা ডাক্তার ভিজিট করছেন। পরে ডাক্তার না দেখিয়েই চলে এসেছি। হাসপাতাল প্রশাসনও নিরব ভূমিকা পালন করছে।
তবে রোগীদের এসব অভিযোগের বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চিকিৎসকরা বলেন, ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের দৌরাত্নে শুধু রোগীরা নয় চিকিৎসকরাও অতিষ্ট। তবে বিবেচনা করেই তাদের কিছু বলা হয়। তারাও শিক্ষিত যুবক। ঔষধ কোম্পানীতে চাকুরি করছে। এসব দায়ভার ঔষধ কোম্পানীগুলোর। ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিরা যদি এমন অপতৎপরতা না করেন তবে রোগীরা আরও ভালো সেবা পাবেন।
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, আমি রোগী দেখছি এমন সময় কোম্পানীর প্রতিনিধিরা ডুকে পড়েন। এসে তাদের ওষধের স্যামপল দেন। রোগীরা মনে করে আমরা কোম্পানীর থেকে সুবিধা নিয়ে সেই কোম্পানীর ঔষধ লিখে দিচ্ছি। আমাদের সম্মানটাও নষ্ট হচ্ছে। রোগীরাও নেতিবাচক ধারণা করেন। আমি মনে করি এসব বন্ধ হওয়া উচিত।
রেনেটা লিমিটেড ওষধ কোম্পানীর সাতক্ষীরা সিনিয়র সেলস্ রিপ্রেজন্টেটিভ মিনারুল ইসলাম জানান, জেলা আমাদের ২২ জন কর্মী রয়েছে। এদের কাজ ডাক্তারদের প্রমোশন করা, ক্যামিষ্ট ভিজিট করা ও ঔষধের অর্ডার কাঁটা।
প্রতিনিধিদের কাজ কি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা ডাক্তারদের বোঝায় কোন ঔষধে কোন কাজ হবে। তিনি যখন ডাক্তার হয়েছেন তখন এই কোম্পানী ছিল না। যার কারণে তিনি এই ওষদের গুণাগুণ সম্পর্কে অবগত নন। সেকারণে আমরা তাদের ওষদের গুণাগুণ সম্পর্কে ধারণা দিয়ে থাকি। পরবর্তীতে রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে সেই ওষধ লিখলো কিনা সেটিও আমরা নজরদারি করি। আমাদের কোম্পানীর ওষধ ব্যবস্থাপত্রে লেখানোর জন্য ডাক্তারদেরও উদ্ধুদ্ধ করতে হয়।
সাতক্ষীরা ওষধ কোম্পানীর ম্যানেজার অ্যাসোসিয়েশন সংগঠণের সভাপতি সাইফুল আলম জানান, বাংলাদেশে চারশোর অধিক ওষধ কোম্পানী রয়েছে। ৯২ জন ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধি রয়েছে সাতক্ষীরায়। এছাড়াও সাতক্ষীরা জেলায় দেড়শ ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিরা কাজ করেন। এসব কোম্পানীগুলোর প্রতিনিধির সংখ্যা ৪৫০ জনের বেশী। যারা জেলার বিভিন্ন ডাক্তারদের ভিজিট করেন। সাতক্ষীরা সদরে ফারিয়া (ফার্মাসিটিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ অ্যাসোসিয়েশান) সংগঠণটি নেই।
সরকারি হাসপাতালে ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের দৌরাত্নে রোগীরা অতিষ্ট এমন অভিযোগে তিনি বলেন, শনিবার ও মঙ্গলবার বেলা ১টা-২টা পর্যন্ত ছাড়া কোন প্রতিনিধি হাসপাতালে প্রবেশ করেন না। রোগীদের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে টানাহেচড়ার অভিযোগও সঠিক নয়। এছাড়া শনিবার ও মঙ্গলবারের বাইরে যদি কোন ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধি সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রবেশ করেন তার দায়িত্ব কোন কোম্পানীর নয়, দায়িত্ব সেই প্রতিনিধির।
কতগুলো ওষধ কোম্পানী বা প্রতিনিধি সাতক্ষীরায় কাজ করছে তার সঠিক তথ্য জানা নেই জানিয়ে সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা. আবু শাহীন বলেন, জেলাব্যাপী সকল হাসপাতালগুলোতে সম্পাহে দুইদিন ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের ভিজিটের জন্য বলা হয়েছে। এর বাইরে কোন কোম্পানীর প্রতিনিধিরা সরকারি হাসপাতালে প্রবেশ করতে পারবে না। যদি কেউ প্রবেশ করে তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চিকিৎসকদের সতর্ক করা হবে। এছাড়া রোগীর ব্যবস্থাপত্রে ছবি তোলার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিরা, এতে ভোগান্তিতে পড়েন রোগীরা। সেক্ষেত্রে দ্রুত সময়ের মধ্যে জেলাব্যাপী হাসপাতালগুলোতে একটি নোটিশ দিয়ে ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের এমন দৌরাত্ন বন্ধ করে দেওয়া হবে।