
লিটন ঘোষ বাপি/ ইয়াছিন আলী, দেবহাটা থেকে: রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান দেশজুড়ে আলোচিত সমালোচিত মোঃ সাহেদ করিমকে অবশেষে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান (র্যাব)। বুধবার ১৫ জুলাই ভোরে সাতক্ষীরার দেবহাটার শাখরা-কোমরপুর সীমান্ত এলাকার বেইলি ব্রিজের নীচে থেকে তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় র্যাব। র্যাব-৬ এর সাতক্ষীরা ক্যাম্প কমান্ডার সিনিয়র এএসপি বজলুর রশিদের নেতৃত্বে র্যাবের একটি দল সাহেদ করিমকে আটক করেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, বুধবার ভোরে র্যাবের একটি বিশেষ অভিযানে সাতক্ষীরার সীমান্ত এলাকা থেকে মোঃ সাহেদকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় সাহেদের কাছ থেকে একটি বিদেশী অবৈধ অস্ত্র জব্দ করা হয় বলে তিনি জানান। আশিক বিল্লাহ জানান, এরআগে রাজধানীর ঢাকা ও মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের শমসেরনগরসহ কয়েকটি এলাকায় সাহেদকে গ্রেফতারে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সাহেদের ফোন ট্র্যাক করে তার অবস্থান নির্ধারণের চেষ্টাও চালালো হয়। কিন্তু চতুর সাহেদ তার মোবাইল ফোনটি অনেক আগে ফেলে দেয়। সাহেদের অবস্থান অনুমান করে দেশের বিভিন্ন জেলায় তল্লাশি চালায় র্যাব ও পুলিশ। তাকে গ্রেফতার করতে কয়েকটি জেলার সব সীমান্ত, রিসোর্ট, হোটেল মোটেলেও নজরদারি বাড়ানো হয়।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রিজেন্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসুদ পারভেজকে গাজীপুর থেকে গ্রেফতার করে র্যাব। এদিন রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে করা মামলায় গ্রেফতারকৃত ৭ জনকে ৫ দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। একই দিনে সাহেদের বিরুদ্ধে করা র্যাবের মামলা ডিবিতে স্থানান্তর করা হয় বলে জানা যায়। এছাড়াও সাহেদের প্রধান সহযোগী তারেক শিবলীকে রাজধানীর নাখালপাড়া থেকে গ্রেফতার করা হয়। অন্যদিকে হেফাজতে নেয়া হয় টিভি নাটকের অন্যতম প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘টেলিহোম’র প্রধান ও সাহেদের ভায়রাভাই মোহাম্মদ আলী বশিরকে। ইতিমধ্যে মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে পুলিশ। জব্দ করা হয় সাহেদের পাসপোর্ট। হদিস মেলে সাহেদের বিরুদ্ধে আরও ২৩ মামলার। মোট ৫৬ টি মামলার আসামি সাহেদ।
তবে স্থানীয় সূত্র মতে, সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলা শাখরা কোমরপুর এলাকার এক ব্যক্তির আশ্রয়ে মাছের ঘেরে আশ্রয় নিয়েছিল বহুরূপী প্রতারক মোহাম্মদ সাহেদ করিম। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত ৩/৪ দিন ঐ এলাকায় অবস্থান করেছে ৫৬ মামলার আসামি সাহেদ করিম। স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, গোপন সূত্রে খবর পেয়ে মঙ্গলবার রাত থেকেই পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের একাধিক টিম শাখরা, কোমরপুরসহ সাতক্ষীরার সকল সীমান্ত এলাকায় সাহেদকে ধরতে অভিযান শুরু করে। সূত্র মতে, এক পর্যায়ে র্যাবের উপস্থিতি টের পায় বহুরূপী প্রতারক সাহেদ। তখন সে ইছামতি নদীর সঙ্গে সংযুক্ত শাখরা খালের সাথে একটি ড্রেনের মধ্যে বোরকা পরে লুকানোর চেষ্টা করে। আর তাকে অবৈধভাবে ভারতে পার করতে ইছামতি নদীতে অপেক্ষায় থাকে বাচ্চু মাঝি নামের এক দালাল বলে সূত্রটি নিশ্চিত করে। তবে এ সময় র্যাবের অভিযানে সাহেদ গ্রেফতার হলেও বাচ্চু মাঝি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
পরে র্যাব সাহেদকে নিয়ে সকাল ৯ টার দিকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় র্যাবের হেড কোয়ার্টারে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং বুধবার দুপুরে রাজধানীর উত্তরায় সাহেদের দুই নম্বর অফিসে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লেঃ কর্নেল সারওয়ার-বিন কাশেম, র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেঃ কর্নেল শাফি উল্লাহ বুলবুল ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমের নেতৃত্বে এক অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে চাল টাকা উদ্ধার হয় বলে জানা গেছে। এর আগে তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরোয়ার।
তিনি বলেন, ‘সাহেদ আজ দেশত্যাগ করবে তাই বোরকা পরিহিত ছিল। তার সঙ্গে স্থানীয় দালালরা ছিল, যারা সীমান্ত পারাপার করে। এমন কিছু দালালের নামও আমরা পেয়েছি, তাদের ধরতে কাজ করছি। বাচ্চু দালাল নামে একজন দালাল মাঝি ছিল। আরও দুই-একজন তাকে নৌকায় পার হতে সাহায্য করছিল। আমরা তাদের নাম বলছি না, তারা আমাদের নেটওয়ার্কে রয়েছে। তাদেরকেও চেষ্টা করছি ধরে ফেলার।
র্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সাহেদ ঘনঘন অবস্থান পরিবর্তন করায় আমরা তার কাছে গিয়েও তাকে ধরতে পারছিলাম না। গতরাতে সে সাতক্ষীরা সীমান্তের দেবহাটা থানার কোমরপুর গ্রামের ইছামতি নদীর পাশে ভারতীয় বর্ডারের সীমানায় অবস্থান করেছে। কারন, নদীর যে সীমানা সেখানে কাঁটাতারের বেড়া খুবই দুর্বল হয়। এতে তার পার হয়ে যাওয়া সহজ ছিল। এর আগে গত ৬ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান শুরু করে র্যাব। অভিযানে করোনার নমুনা সংগ্রহ করে তা টেস্ট না করে ফলাফল প্রদান, হাসপাতালের লাইসেন্স না থাকাসহ বিভিন্ন অভিযোগ পায়। এর একদিন পর হাসপাতালটির উত্তরা ও মিরপুর শাখা সিলগালা করে দেয়া হয়। এরপর থেকেই আত্মগোপনে ছিলেন রিজেন্ট চেয়ারম্যান মোঃ সাহেদ করিম।
বুধবার ভোরে দেবহাটা উপজেলার শাখরা কোমরপুর বেইলি ব্রিজের পাশে নর্দমার মধ্যে থেকে বোরকা পরা অবস্থায় তাকে যখন গ্রেফতার করা হয় তখন ফজরের নামাজের পরে অল্প কিছু লোক রাস্তায় হাঁটাচলা করছিলেন। এর মধ্যেই তাদের নজরে আসে সাহেদকে গ্রেফতারের বিষয়টি। এদেরই একজন দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর গ্রামের নুরুল ইসলাম (৬০)। সাহেদকে গ্রেফতার নিয়ে এই প্রত্যক্ষদর্শী নুরুল ইসলাম বলেন, ভোরে আমরা যখন ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়েছি তখন দেখলাম বেইলি ব্রীজের ওপারে র্যাবের তিনটি গাড়ি এসে থামলো। এরপর র্যাব সদস্যরা চিৎকার করে বলতে থাকেন এই পেয়েছি। আল্লাহু আকবর, ধর ধর। এ সময় আমরা সবাই এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলাম তারা সাহেদকে ধরে ফেলেছেন। পরে তারা তাকে ব্রীজ পার করে এপারে নিয়ে আসেন। এপারে নদীতে একটি নৌকা আছে। সাহেদ তার স্বীকারোক্তিতে র্যাবকে বলেছে এই নৌকাতে করেই নদী পাড়ি দিয়ে তার ভারতে চলে যাওয়ার কথা ছিল।