
শেখ ইমরান হোসেন, তালা থেকে: সাতক্ষীরার দুগ্ধপল্লী হিসাবে খ্যাত জেয়ালার ঘোষ পাড়া গ্রাম। অল্প দিনে কোটিপতি বনে গেছে এখানকার ব্যবসায়ীরা। অনুসন্ধানে জানা গেলো ঘটনার নেপথ্য কারন। এখানে গরুর দুধ নয় বরং গ্লুকোজ, পানি, চিনি ও গাম জেলি দ্বারা তৈরী হয় খাঁটি দুধ। এই দুধ সরবরাহ হয় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই দুগ্ধপল্লীর অধিকাংশ ঘোষেরা কিছু বছর আগেও ছিলেন অন্য খামারীদের কর্মচারী, সামান্য মুজুরীতে কাজ করে কোন রকমে সংসার চালাতো তারা। তবে কয়েক বছরের ব্যবধানে ভেজাল দুৃধ বিক্রি করে হয়েছেন কোটি টাকার মালিক। তৈরী করেছে বিলাসবহুল বাড়ি, কিনেছে ট্রাকসহ সম্পত্তি।
জানা যায়, খামারীদের কাছ থেকে মিল্কভিটা, আকিজ, প্রাণ সহ অন্যান্য কোম্পানি যে দামে দুধ ক্রয় করেন তার চেয়ে কেজি প্রতি ২ থেকে ৩ টাকা কমে দুধ ক্রয় করেন স্থানীয় দুগ্ধপল্লীর ঘোষেরা। কম দামে দুধ ক্রয় করে রাসায়নিক কেমিক্যালের মিশ্রণ ঘটিয়ে সেই দুধ ৭ থেকে ১০ গুণ বৃদ্ধি করেন। তবে পরীক্ষাগারে এসকল দুধের ভেজাল সনাক্ত করতে পারেনা বলেও অভিযোগ উঠেছে। এদিকে, যাদের গরু নেই তারাও শুধু রাসায়নিক কেমিক্যাল ব্যবহার করে দুধ তৈরী করেন এমন অভিযোগ তুলেছে স্থানীয় জনসাধারণ।
স্থানীয় বাসিন্দা সাত্তার হোসেন জানান, চিনি, গ্লুকোজ, পানি, সয়াবিন তেল ও গাম জেলি ব্যবহার করে ভেজাল দুধ তৈরী করেন দুগ্ধপল্লীর খামারীরা। তারা তিন থেকে চার বছর ধরে এই ভেজাল দুধ তৈরী করে কোটি টাকার মালিক হয়েছে।
তিনি আরও জানান, এই দুগ্ধপল্লীর ব্যবসায়ীরা প্রথম যখন ব্যবসা শুরু করে তখন তাদের কিছু-ই ছিলো না। তাদের ভেজাল দুধ আকিজ কোম্পানির চিলিং সেন্টারে ধরা পড়ার পরে তারা অন্যত্রে বিক্রি করে ভেজাল দুধ। ভেজাল দুৃধ বিক্রি করে লোক ঠকিয়ে দুগ্ধপল্লীর গাভির মালিকেরা কোটিপতি হয়ে গেছেন কয়েক বছরে। স্থানীয় অধিকাংশ কর্মচারী এখন মালিক হয়ে ভেজাল দুধ বিক্রি করে ট্রাক কিনেছে, বিলাসবহুল বাড়ি তৈরী করেছে। অধিকাংশ কর্মচারীদের আগে কিছু ছিলোনা শুধু ভেজাল দুধ তেরী করে কোটি টাকার সম্পত্তি তৈরী করেছে তারা।
স্থানীয় আলি নামের একজন খামারী জানান, জেয়ালা গ্রামের যারা ঘোষ রয়েছে তারা পর্যাপ্ত পরিমানে দুধে ভেজাল মিশ্রিত করে। একটি ড্রামে ৪০ কেজি দুধ ধরে তাতে আসল দুধ দেয় ১০ কেজি আর বাকিটা গ্লুকোজ, পানি, চিনি, জেলির সংমিশ্রণ করে ৪০ কেজি পূর্ণ করে খাঁটি দুধের নামে বাজারে বিক্রি করে। এই ভাবে জিরো থেকে হিরো হয়েছে এখানকার সকল খামারিরা।
মোশারাফ হোসেন নামের অপর এক ব্যক্তি জানান, অনেক রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে দুধের মত সেম উপাদান তৈরী করে তারা। তবে আসলে সেটা দুধ না। এই দুধ দিয়ে শিশু খাদ্য তৈরী হয়। ভেজাল দুধের তৈরী খাদ্য খেয়ে বাচ্ছারা অসুস্থ হয়ে যায়। তাছাড়া এসকল ভেজাল দুধের তৈরী খাদ্যখাবার আমরা সকলে প্রতিনিয়ত খাচ্ছি।
যাতে করে এই ভেজাল দুধ তৈরী বন্ধ হয় সে সকল ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ করেন তিনি।
তালা সদর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম জানান, ঘোষ পাড়ার প্রতিটি বাড়ি দিনে দুই থেকে তিনবার যাতায়াত করতে হয় বিভিন্ন প্রয়োজনে। বিভিন্ন সময়ে তাদের ভেজাল দুধ তৈরীর কর্মযজ্ঞ সামনে পড়ে। নিষেধ করলেও তারা অমান্য করে দীর্ঘবছর যাবত এটি চলমান রেখেছে। যদি কেউ ১০ হাজার লিটার দুধের অর্ডার দেয় তবে এই ঘোষেরা কেমিক্যাল দিয়ে ১০ হাজার লিটার দুধ তৈরী করে দেয়। এমন কি আরও অতিরিক্ত ২ হাজার লিটার থেকে যায় যেটা স্থানীয় পর্যায়ে বিক্রি করে
তিনি আরও জানান, এমন অনেক ঘটনা আছে, যাদের গাভি নেই তারাও বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে দুধ তৈরী করে বিক্রয় করে কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে। এ সমস্ত ব্যবসায়ীদের কারও ১ কাঠা জমি নেই তবে সাইকেলে দুটো ড্রাম বেঁধে নামে নামে গামালে যেয়ে ভেজাল দুধ তৈরী করছে। তারা দুই তলা বাড়ি, দামি গাড়িসহ কোটি টাকার সম্পত্তি তৈরী করেছে ভেজাল দুধ বিক্রি করে।
প্রাণ গ্রুপের চিলিং সেন্টার থেকে জানান, পর্যাপ্ত পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা দুধ সংগ্রাম করে থাকি। চলতি মাসে ৭ জনের ভেজাল দুধ শনাক্ত হয়েছে। তাদের দুধ আমরা সংগ্রহ করছিনা আর।
অপরদিকে, আকিজ কোম্পানির চিলিং সেন্টার থেকে জানানো হয়, ফ্যাট অনুযায়ী দুধ সংগ্রহ করা হয়। যাদের ফ্যাট বেশি তাদের দাম বেশি দেওয়া হয়। ভেজাল দুৃধ দেওয়ার কারনে অসাধু ব্যবসায়ীদের দুধ সংগ্রহ করিনা। এখন শুধু মাত্র খামারীদের দুধ সংগ্রহ করা হয়।
তবে সাংবাদিকদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে অধিকাংশ অসাধু ব্যবসায়ীরা গাঁ ঢাকা দেন। এসময়ে শুকান্ত ঘোষ সকল অভিযোগ মিথ্যা দাবী করে জানান, দুধ পরীক্ষা করে দেখেন ভেজাল কি আসল!
স্থানীয় সুনিল ঘোষ জানান, তার চারপাশে সবার টাইলস লাগানো বিলাসবহুল বাড়ি তবে সে সৎ হওয়ায় ভাঙ্গা টালির ঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।
ভেজাল দুধের অভিযানকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, অল্প সময়ে সকল অসাধু ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তস্বরূপ শাস্তি দেওয়া হোক।
এ বিষয়ে তালা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রুহুল কুদ্দুস জানান, সাতক্ষীরা জেলার জেয়ালা ঘোষ পাড়া দুগ্ধপল্লী নামে পরিচিত। কিছুদিন ধরে অভিযোগ পাচ্ছিলাম রাসায়নিক পদ্ধতিগত ভাবে তারা নকল দুধ তৈরী করে। তার ধারাবাহিতায় গতকাল মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) ৩৫০ কেজি ভেজাল দুধ তৈরীর জেলি ও ৯৬৫ কেজি ভেজাল দুধসহ এক প্রশান্ত নামের এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। পরবর্ততী আইনী প্রক্রিয়াগত ভাবে তাকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা ও ৬ মাসের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
তিনি আরও জানান, ভেজাল বিরোধী কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। তাছাড়া স্থানীয় যারা চিলিং সেন্টার রয়েছে যারা দুধ সংগ্রহ করে তাদের কে আমরা বলেছি পর্যাপ্ত যাচায় বাছায় করে দুধ সংগ্রহ করতে। তাছাড়া অন্য যে অসাধু ব্যবসায়ী রয়েছে সকলের বিরুদ্ধে সুনিদৃষ্ট অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রশান্ত কুমার জানান, ভেজাল বিরোধী অভিযান চলমান রয়েছে। সুনিদৃষ্ট তথ্য পেলেই সেখানে অভিযান করা হবে। তাছাড়া চিলিং সেন্টারে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ভেজাল দুধ শনাক্তের জন্য।
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) ভেজাল দুধ তৈরী ও বিক্রি দায়ে ৩৫০ কেজি রাসায়নিক জেলি ও ৯৬৫ কেজি ভেজাল দুধ সহ গ্রেফতার হয় দুগ্ধ সমবায় সমিতির সভাপতি প্রশান্ত ঘোষ। পরবর্ততী ভ্রাম্যমাণ আদালতে তাকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা ও ৬ মাসের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। এর আগে সোমবার (৫ সেপ্টেম্বর) রাতে তালা উপজেলার মহান্দি গ্রামের শংকর দাস দুই ড্রাম গাম জেলিসহ পুলিশের হাতে আটক হয়। পরবর্ততী তে তাকেও দুই মাসের কারাদণ্ড প্রদান করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।