প্রিন্ট এর তারিখঃ এপ্রিল ২০, ২০২৫, ১১:৪৪ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৫, ৮:৩১ অপরাহ্ণ
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ সুপেয় পানির সংকটে শ্যামনগরের মানুষ এখন দিশেহারা। দৈনন্দিন একটি পরিবারে পানযোগ্য পানির যে পরিমাণ চাহিদা, অনেক পরিবারের পক্ষেই তা পুরোপুরি মেটানো মোটেই সম্ভব হচ্ছে না সাতক্ষীরার উপকূলে। ৮ হাজার ৮৫০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা খরচ করে সুপেয় পানির প্রকল্প হাতে নেয় আওয়ামী সরকার। যেখানে অসহায়, গরীব আর পিছিয়ে পড়া মানুষকে স্বল্প মূল্যে নিরাপদ পানি দেওয়ার কথা ছিল। বরাদ্ধের হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় করে সরকারি কর্মকর্তা, এমপি ও দলীয় লোকজনই হয়েছেন লাভবান।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরে সুপেয় পানিসহ দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারযোগ্য পানির সংকট নতুন কিছু নয়। এই সংকট নিরসনে সরকার শত শত কোটি টাকা খরচ করলেও তার সুফল পাচ্ছে না প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একাধিক প্রকল্প শুধু টাকা খরচের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। যে তিমিরে রয়েছে, সেই তিমিরেই থেকে যাচ্ছে সংকট। মাঝে কোটিপতি বনে যাচ্ছেন দুর্নীতির সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
সূত্র মতে, শ্যামনগর উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানি সংকট নিরসনে ‘সমগ্রদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প’ ও ‘উপকূলীয় জেলাসমূহে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ’ নামে দুটি প্রকল্পের আওতায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বাস্তবায়নে ৩ হাজার লিটারের পানি সংরক্ষণের ট্যাংক ও অন্যান্য সরঞ্জামাদিসহ স্থাপন করা হচ্ছে। এসব প্রকল্পের আওতায় সরকারের উপকারভোগী প্রতি ব্যয় প্রায় ৪২ হাজার ২০০ টাকা (ভ্যাট ট্যাক্সসহ)। তবে সরকারি বরাদ্দের এই পানির ট্যাংক বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মোঃ মোস্তাফিজুর রহমানের সহযোগিতায় জনস্বস্থ্য অধিদপ্তরের টেকনিশিয়ান দাবি করা ঠিকাদারের প্রতিনিধি নজরুল ইসলাম ও তার সহযোগীরা সমাজের বিত্তবান ও স্বচ্ছল চাকরীজীবীদের কাছে ১২ থেকে ১৭ হাজার টাকায় ফেরি করে বিক্রি করছেন এসব ট্যাংক। এই অনিয়মের সাথে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও জড়িত বলে অভিযোগ এলাকাবাসী। ফলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ঠিকাদার প্রতিনিধির যোগসাজশে সরকারের কোটি কোটি টাকা তছরুপ হচ্ছে। সাবেক সংসদ সদস্য ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে যে তালিকা পাওয়া গেছে সেই তালিকা অনুযায়ীই ট্যাংকি বিতরণ করা হচ্ছে। আমাদের দুর্নীতির কোন সুযোগ নেই।
তার সাথে সুরে সুর মিলিয়ে কাজের ঠিকাদার প্রতিনিধি নজরুল ইসলাম বলেন, অফিস থেকে যে তালিকা দেয়া হয়েছে, সেই তালিকা অনুযায়ী আমরা ট্যাংকি বিতরণ করছি।
তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, খাবার পানি সংকটে থাকা প্রকৃত অসহায় দরিদ্র মানুষের পরিবর্তে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বিত্তবান ও চাকরিজীবীদের মাঝে অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে পানির ট্যাংকি বিতরণ করা হয়েছে।
অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ের ট্যাংকি পাওয়া বিত্তবান ও চাকরিজীবীদের দাবি, তিন হাজার লিটারের একটি পানির ট্যাংক দোকানে কিনতে গেলে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা লাগে। কিন্তু ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে শুনে তাদের কাছ থেকে ক্রয় করেছেন তাঁরা।
বঙ্গোপসাগরের সন্নিকটে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরার সর্বশেষ উপজেলা শ্যামনগর। সমুদ্রঘেঁষা হওয়ায় এই উপজেলার অধিকাংশ এলাকার পানি লবণাক্ত। তাই বসানো যায় না গভীর নলকূপও। বর্ষাকালে পানিতে লবণাক্ততা কম থাকলেও শুকনো মৌসুমে মানুষকে মারাত্মক কষ্ট পোহাতে হয়। দৈনন্দিন কাজকর্ম সারতে ও পান করতে তখন একমাত্র অবলম্বন পুকুর এবং ধরে রাখা বৃষ্টির পানি। অথচ সেই পানির কষ্টে থাকা উপকূলের গরীব অসহায় মানুষই পাচ্ছে না সরকারের এই সুবিধা। অর্থের বিনিময়ে সরকারের এই মহৎ উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
উপকূলীয় অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সুপেয় পানির কষ্ট দূর করতে সমগ্রদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও উপকূলীয় জেলাসমূহে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ নামে দুইটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এই প্রকল্পের আওতায় উপকারভোগীদের বাড়িতে তিন হাজার লিটার বৃষ্টির পানি ধারণক্ষমতার পানির ট্যাংক ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি স্থাপন করা হয়। এজন্য উপকারভোগীদের ১ হাজার ৫০০ টাকা হারে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়।
কিন্তু শ্যামনগরে এজন্য উপকারভোগীদের গুনতে হচ্ছে ১০ থেকে ১৭ হাজার টাকা পর্যন্ত। যা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ ঠিকাদারের প্রতিনিধি ও তার লোকজন নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ফলে প্রকৃত উপকারভোগীরা বঞ্চিত হলেও বিত্তবানরা ১২ থেকে ১৭ হাজার টাকার বিনিময়ে একের অধিক সরকারি ট্যাংক ক্রয় করছেন। অথচ ট্যাংকের গায়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সতর্কবার্তা হিসেবে লেখা আছে, ‘জলধারাটি ক্রয় ও বিক্রয় সমভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
উপকূলীয় অঞ্চলের সুপেয় পানির কষ্টে থাকা এলাকাবাসীর অভিযোগ, দেড়-দুই বছর আগে পানির ট্যাংকি বাবদ টাকা জমা দিলেও তারা এখনো পানির ট্যাংক পাননি। অথচ যারা নগদ টাকায় ১২ থেকে ১৭ হাজার টাকা দিয়ে পানির ট্যাংক কিনছেন সেসব বড়লোকের (বিত্তবানদের) বাড়িতে পানির ট্যাংক পৌঁছে গেছে।
আটুলিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আল আমিন হোসেন বলেন, উপকূলীয় এ অঞ্চলে সুপেয় পানি খুবই অভাব। সরকার আমাদের এই উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের কথা ভেবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে পানি পান করার জন্য পানির ট্যাংকি দিচ্ছে। কিন্তু পানির ট্যাংকি গরীব অসহায় মানুষ না পেয়ে এলাকার বিত্তবানরাই পাচ্ছেন। এলাকার বিত্তবানরা ১২ থেকে ১৭ হাজার টাকার বিনিময়ে ক্রয় করছেন সরকারি ট্যাংক। আর ব্যবহার করছেন গরুর গোয়াল, মুরগির খামারে।
কৈখালী ইউনিয়নের শৈলখালি এলাকায় গেলে আয়েশা খাতুন নামের এক বৃদ্ধ বলেন, দিনে দু-তিনবার অনেক দূর হেঁটে পানি আনতে হয়। মাজায় আর পারে না। পানির পাত্র না থাকায় বৃষ্টির সময় পানি ধরে রাখতে পারিনি। শুনেছি সরকার থেকে তিন হাজার লিটারের পানির ট্যাংকি দেচ্ছে, অনেকের সাথে বলে।
অফিস ক্যাসিয়ার শাখাওয়াত হোসেন ঘুষ গ্রহনের অনৈতিক প্রস্তাব দেন।
সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের আলোচিত নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহিদুল ইসলামকে অবশেষে কুষ্টিয়া জেলায় বদলি করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-সচিব আশফিকুন নাহার স্বাক্ষরিত ৪৬.০০.০০০০.০৮৩.১৯.০০১.২২-১০৩ নাম্বার স্মারকে তাকে এ বদলির আদেশ দেয়া হয়।
উল্লেখ্য, নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রায় দুই শত কোটি টাকার টেন্ডার নয়ছয়ের অভিযোগসহ নানা অনিয়ম দূর্নীতির অভিযোগ এনে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপদেষ্টা ও সচিবসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ দিয়েছেন স্থানীয় ভুক্তভোগী ঠিকাদাররা ও এলাকাবাসী।
এছাড়া টেন্ডারবাজি ও দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল ধন সম্পদ গড়ে তোলা, যশোরের নিউ মার্কেট এলাকায় ৫তলা বাড়িসহ ৮/১০টি প্লটসহ কয়েক বিঘা জমি, গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানীসহ বিভিন্ন স্থানে নামে বেনামে সম্পত্তি রয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়।
এছাড়া তার বিরুদ্ধে ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিও নিয়েছেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। যা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে। একই সাথে তার বিরুদ্ধে একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলেও এ বিষয়ে নিউজ প্রচার হয়েছে।
বদলি সম্পর্কিত বিষয়ে জানার জন্য নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহিদুল ইসলামের কাছে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে ফোন দিলে তিনি তার ফোনটি রিসিভ করেননি।