সচ্চিদানন্দদেসদয়:আজ সনাতন ধর্মালম্বীদের সরস্বতী প‚জা। সরস্বতী প‚জা আমাদের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি অন্যতম প্রচলিত প‚জা। সরস্বতী দেবীকে শিক্ষা, সংগীত ও শিল্পকলার দেবী ও আশীর্বাদাত্রী মনে করা হয়। বাংলা মাঘ মাসের শুক্লা পক্ষের পঞ্চমী তিথীতে এই প‚জা অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষা, সংগীত ও শিল্পকলায় সফলতার আশায় শিক্ষার্থীরা দেবীর প‚জা করে থাকে।বাকদেবী, বিরাজ, সারদা, ব্রাহ্মী, শতরূপা, মহাশ্বেতা, পৃথুধর, বকেশ্বরীসহ আরও অনেক নামেই দেবী ভক্তের হৃদয়ে বিরাজ করে।পুরাণ অনুযায়ী দেবী সরস্বতীর ব্রহ্মার মুখ থেকে উত্থান। দেবীর সকল সৌন্দর্য ও দীপ্তির উৎস ম‚লত ব্রহ্মা।
প‚জার জন্য দেবী সরস্বতীর ম‚র্তি শ্বেত বস্ত্র পরিধান করে থাকে যা পবিত্রতার নিদর্শন। দেবীর আসনকে পুষ্পশোভামন্ডিত করে রাখা হয়। পরিবারের সকল সদস্য খুব ভোরে স্নান শেষে পরিষ্কার বস্ত্র পরিধান করে দেবীর সামনে অবস্থাান করে থাকে। পুরোহিত প‚জা শুরু করবার আগ পর্যন্ত দেবীর মুখমন্ডল ঢাকা থাকে। প‚জার অর্ঘ্যের পাশাপাশি দেবী প‚জার আরেকটি প্রধান অংশ ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যপুস্তকক। সরস্বতী প‚জার একটি বিশেষ অর্ঘ্য হল পলাশ ফুল। দেবীর অঞ্জলির জন্য এটি একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। প‚জা হিন্দু বিদ্যা ও সঙ্গীতের দেবী সরস্বতীর আরাধনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠেয় একটি অন্যতম প্রধান হিন্দু উৎসব। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে মাঘ মাসের শুকা পঞ্চমী তিথীতে সরস্বতী প‚জা আয়োজন করা হয়। তিথীটি শ্রীপঞ্চমী বা বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত। শ্রীপঞ্চমীর দিন অতি প্রত্যুষে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছাত্রছাত্রীদের গৃহ ও সর্বজনীন প‚জামন্ডপে দেবী সরস্বতীর প‚জা করা হয়। ধর্মপ্রাণ হিন্দু পরিবারে এই দিন শিশুদের হাতেখড়ি, ব্রাহ্মণভোজন ও পিতৃতর্পণের প্রথাও প্রচলিত। প‚জার দিন সন্ধ্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সর্বজনীন প‚জামন্ডপ গুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজিত হয়। প‚জার পরের দিনটি শীতলষষ্ঠী নামে পরিচিত। কোনো কোনো হিন্দু পরিবারে সরস্বতী প‚জার পরদিন অরন্ধন পালনের প্রথা রয়েছে। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে যতটুকু জানা যায়, ‘সরস্বতী বিদ্যা দেবী। ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণের প্রকৃতি খন্ডের প্রথম অধ্যায় বলা হয়েছে- বুদ্ধিরূপা, বাক্যরূপা, বিদ্যারূপা। সঙ্গীত ও শিল্পকলার দেবী হিসেবে সরস্বতী প‚জিত হয়ে থাকেন, স্মৃতি ও মেধা দান করেন। সব মিলিয়ে সরস্বতী সর্ববিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবেই প‚জিত হয়ে থাকেন। পদ্মপুরাণ মতে ‘দেবী সরস্বতী আদ্যন্তবিহীনা, শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্র-পরিহিতা এবং শ্বেতগন্ধে অনুলিপ্তা। অধিকন্তু তাহার হস্তে শ্বেত রুদ্রারে মালা; তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেতবীণাধারিণী, শুভ্রবর্ণা এবং শ্বেত অলঙ্কারে ভ‚ষিতা।’সরস্বতীর বাদিত বীণার নাম কচ্ছপী। দেবী কখনো দ্বিভুজা, কখনো চতুর্ভুজা, আবার প্রয়োজনবোধে কখনো বা ষোড়শভুজা। ’বৈদিক যুগের শুরুতে সরস্বতীর প্রধান পরিচয় ছিল নদী হিসেবে। আর্যরা ভারতে প্রবেশের পর ব্রহ্মাবর্ত নামক একটি স্থাানে প্রথম বসতি স্থাাপন করেছিলেন। সেই স্থাানের একটি নদীকে আর্যরা সরস্বতী নামে আখ্যায়িত করেন। এই নদীটি ক্রমে ক্রমে পবিত্র নদী হিসেবে আর্যদের কাছে সম্মানিতা হয়ে ওঠে। বেদে সরস্বতী নদীর উল্লেখ আছে। সুবল চন্দ্রমিত্রের ‘সরল বাঙ্গালা অভিধানের মতে, ভারতের প্রথম আর্য উপনিবেশ স্থাাপনের সময় পাঞ্জাব প্রদেশে এই নদীর তীর প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। এই নদীটি সরমুর নামক স্থাানে উদ্গত হয়ে অম্বালা জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অনেক জায়গায় বালুর ভেতরে নদীটি হারিয়ে গেছে, আবার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। পরে এটি পরিণত হয়ে- থানেশ্বর ও কুুরর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পাতিয়ালা রাজ্যে প্রবেশ করেছে। পরে এই নদী ঘর্ঘরা (ঘাগগর) নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মতে– অন্তর্সলীলারূপে প্রবাহিত নদীটি প্রয়াগধামে গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
ধারণা করা হয়, এই নদীগুলোর ভেতর ঘাগগর নদীকে বেদে বর্ণিত সরস্বতীকে বিবেচনা করা হয়। এই নদীর তীরে ঋষিরা অত্যন্ত নির্বিঘেœ ধর্মাচারণের জন্য আবাসভ‚মি হিসেবে নির্বাচন করেন। কালক্রমে এই নদীতীরে বৈদিক ঋষিদের একটি বড় পল্লী গড়ে ওঠে। বৈদিক ঋষিদের সম্মিলিত বেদপাঠ উক্ত স্থাান মুখরিত করে রাখত বলে উক্ত স্থাান বাগ্দেবীর আবাস হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। বেদের টীকাকারদের মতে এই নদীটি সেকালে-একালের গঙ্গা নদীর মতোই প‚জিত হত। তবে, আর্যরা এই নদীকে জ্ঞান উদ্দীপনা বা বাক্যের উৎপাদয়িত্রা হিসেবেই প‚জা করেছেন। কালক্রমে বিভিন্ন উপ্যাখ্যানের স‚ত্রে এই নদীকে দেবী সত্তায় উন্নীত করা হয়েছে। ঋগবেদের ১।১৪২।৯ শ্লোকে বাক-দেবী হিসেবে তিনটি নাম পাওয়া যায়। এরা শুচি ও দেবগণের মধ্যস্থাা নামে অভিহিত হয়েছেন। এই তিন দেবী হলেন, ভারতী স্বর্গস্থা বাক, ইলা পৃথিবীস্থা বাক এবং সরস্বতী অন্তরীস্থা বাক।আজ কচিকাঁচা থেকে বড়রা সবাই হলুদ সহ নানারঙের শাড়ি পরিহিত হয়ে পুজায় হাজির হবেন। সাজগোঁজ অন্যান্য দিনের চেয়ে সম্প‚র্ণ পৃথক। প্রত্যেকেই মায়ের চরণে পুষ্প পত্তাঞ্জলী প্রদান করে আশীর্বাদ প্রার্থনা করবেন ভাল ফলাফলের জন্য। সেই শ্রদ্ধা ও আত্মবিশ্বাস সারা বছর ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনায় উদ্দীপনা জোগায়। সকাল থেকেই বাগদেবীর আরাধনায় মত্ত হয়ে উঠেন শিক্ষার্থীরা। অঞ্জলী প্রদানের পর প্রসাদ গ্রহণ করেই আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠে সকলে। এযেন শিশু থেকে কিশোর কিশোরী ও যুবক যুবতী,বৃদ্ধ বৃদ্ধা সকলে। মনে নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ণ ফেরি করে বেড়ানোর উদ্দীপনায় আবারও অপেক্ষা একটি বছরের।
লেখক: সাংবাদিক,আশাশুনি,সাতক্ষীরা