বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম জনপদের ঐতিহ্যমণ্ডিত জেলা সাতক্ষীরা। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে পূর্বে খুলনা জেলা, উত্তরে যশোর জেলা, পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা (ভারত) জেলার বসিরহাট মহকুমা এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। সাত উপজেলার সমন্বয়ে সাতক্ষীরা জেলা গঠিত। সাতক্ষীরার আবহাওয়া, জলবায়ু, পানি লবণাক্ত-বৈরী হলেও গোটা দেশের অর্থনীতিতে সাতক্ষীরা জেলার রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। সমুদ্র উপকূলে ভারত সীমান্তের কোল ঘেঁষে অবস্থিত অপার পর্যটন সমৃদ্ধ জেলা সাতক্ষীরা।
শ্যামনগর
শ্যামনগর বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ উপজেলা। এ উপজেলাতে বাংলাদেশের অক্সিজেন সুন্দরবনের অবস্থান। এখানে আছে যশোরেশ্বরী মন্দির (ঈশ্বরীপুর)। রাজা প্রতাপাদিত্য প্রতিষ্ঠা করেন ঐতিহাসিক এ মন্দির। মোঘল আমলে নির্মিত বংশীপুর শাহী মসজিদ এখনও আছে কালের মহিমায়।
নকিপুর হরিচরণ রায়চৌধুরীর বিখ্যাত জমিদার বাড়ি, শ্যামনগর জমিদার বাড়ি, নুরুল্লা খাঁ মাজার (নূরনগর),
ইশ্বরীপুর হাম্মামখানা (বংশীপুর), গোবিন্দ দেবের মন্দির,
জাহাজঘাটা নৌদুর্গ (খানপুর, ভুরুলিয়া), রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ধুমঘাট এ উপজেলাতেই অবস্থিত।
মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত, আকাশনীলা পার্ক (মুন্সিগঞ্জ) বর্তমানে আশা জাগানিয়া পর্যটন কেন্দ্র। সুন্দরবনের মাঝে আছে সুন্দরী গাছে ভরা কলাগাছিয়া ইকো ট্যুরিজম স্পট। যেখানে হরিণ, বানরের অবাধ বিচরণ আপনাকে দেবে মুক্তির আনন্দ।
দেবহাটা
ভারত-বাংলাদেশ পৃথককারী নদী ইছামতীর আদুরে কোলে দেবহাটা উপজেলার অবস্থান। বাংলাদেশের এমন এক স্থান এই উপজেলা যেখানে দাঁড়িয়ে ইন্ডিয়া এবং ইন্ডিয়ার মানুষ দেখা যায়। কেওড়ার লোনা বনের সমন্বিত সৌন্দর্য 'রূপসী দেবহাটা ম্যানগ্রোভ পর্যটন কেন্দ্র' বর্তমানে দর্শকপ্রিয়তার তুঙ্গে। যেখানে এলে সুন্দরবনের স্বাদ স্বল্পতে মিটবে। পাশাপাশি বিভিন্ন পশুপাখি, জলজ প্রাণীর দেখা মিলবে। সবচেয়ে আকর্ষণের বিষয় আন্তর্জাতিক ইছামতী নদীর গোধূলির সৌন্দর্য। নদীর বুকে নৌকায় ঘুরতে পারবেন সময় চুক্তিতে।
'বনবিবি বটতলা' দেবহাটা উপজেলার আরেক জনপ্রিয় পর্যটন স্থান। শতবর্ষী বৃহৎ বটবৃক্ষের কাণ্ড থেকে শাখা ছড়িয়ে পড়েছে কয়েক বিঘা জমিতে। বছরের বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে এই পাকুড়মূলে বসে গ্রাম্য মেলা। একই উপজেলার টাউনশ্রীপুর গ্রামে আছে পুরাতন জমিদারবাড়ি।
দেবহাটাতে যাবেন আর রসমালাই খাবেন না এমন বোকামি সচেতন পর্যটকরা করেই না। দেবহাটা থানা ভবনের সামনে অবস্থিত 'ভাই ভাই মিষ্টান্ন ভাণ্ডার' থেকে রসমালাইয়ের স্বাদ অবশ্যই নেবেন। এখানকার রসমালাই গোটা সাতক্ষীরা জেলা এবং জেলার বাইরেও বিখ্যাত।
কালিগঞ্জ
কালিগঞ্জ সদরে যাওয়ার আগে, সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ সড়কে নলতার অবস্থান। এখানে আছে অবিভক্ত ভারতবর্ষের শিক্ষা সংস্কারক ও আহছানিয়া মিশনের প্রতিষ্ঠাতা এবং বিখ্যাত সুফী সাধক পির খানবাহাদুর আহছানউল্লাহর মাজার। উল্লেখ্য প্রতিবছর রমজানে মাজার চত্বরে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষের ইফতারের আয়োজন করা হয়। এই উপজেলার আরও একটি দর্শনীয় স্থান 'প্রবাজপুর শাহী জামে মসজিদ'। এটি একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এছাড়াও কালিগঞ্জ উপজেলায় আছে শুইলপুর নদীর চর।
সাতক্ষীরা সদর
মোজাফফর গার্ডেন বা মন্টু মিয়ার বাগান বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার সর্ববৃহৎ পার্ক। শহরের কাছেই খড়িবিলা গ্রামে এর অবস্থান। এছাড়া আছে লেক ভিউ রেস্টুরেন্ট, মৌবন রেস্টুরেন্ট। পায়ের নিচে পানি। রঙিন মাছেরা ঘুরে বেড়ায় মৌবন রেস্টুরেন্টের মেঝেতে। মাছেদের সাথে ভিন্নমাত্রার আড্ডায় খাবার পরিবেশন করা হয় এখানে। সাতক্ষীরা সদরে মেডিকেল কলেজের পাশেই আছে ডিসি পার্ক। রাজ্জাক পার্ক, আব্বাস গার্ডেন, বাইপাস সড়ক। এসব জায়গাতে বিকালের আড্ডায় মেতে ওঠে আমোদপ্রিয় মানুষ। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থল বন্দর ভোমরা স্থল বন্দর এ উপজেলাতে অবস্থিত। এখানকার বাজারে ইন্ডিয়ান পণ্য কম মূল্যে পাওয়া যায়।
আশাশুনি
মাছের ঘেরের মাঝখান দিয়ে সরু চিকন বাবলার রাস্তা নয়ন জুড়াবে যে-কারোরই। আশাশুনির মানিক খালি ব্রিজের আশপাশের দৃশ্য মন কাড়ে সৌন্দর্য পিপাসু মানুষের। এই উপজেলাতে আছে আশাশুনি প্রণব মঠ, গুনাকরকাটী মাজার শরিফ, রামনগর কালিতলা মন্দিরের মতো দর্শনীয় স্থান।
পাটকেলঘাটা
থানা কিন্তু উপজেলা নয় পাটকেলঘাটা। নীলিমা ইকো পার্ক, পাটকেলঘাটা সেতু, কপোতাক্ষ নদ এ উপজেলার দর্শনীয় স্থান। পাটকেলঘাটায় গেলে হুজুরের হোটেলে চুইঝালের গোরুর গোশত দিয়ে অবশ্যই দুপুরের খাবার খাবেন।
কলারোয়া
ইতিহাসের সাথে প্রকৃতি যাদের সমান্তরালভাবে আকর্ষণ করে তাদেরকে আসতে হবে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার সোনাবাড়িয়া গ্রামে। এখানে রয়েছে টেরাকোটার নির্মাণ শৈলীর অপূর্ব নিদর্শন। প্রায় আড়াই শত বছর আগে রড, সিমেন্টের ঢালাই বা কড়ি-বরগাবিহীন নির্মিত সাতক্ষীরার কলারোয়ায় 'সোনাবাড়িয়া মঠ' বা শ্যামসুন্দর মন্দিরের তিনতলা ভবন কালের স্বাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
তালা
তেতুলিয়া জামে মসজিদ ধ্বংসপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক নিদর্শন। এই উপজেলায় আরও আছে রেজওয়ান খানের জমিদার বাড়ি, কপোতক্ষ ইকো পার্ক, আগৈলঝাড়া ঝুড়িঝাড়া মাঠ, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর আদি বাড়ির দুর্গা মন্দির।
সাতক্ষীরায় এসে সুন্দরবন দেখবেন। জেলেদের নৌকায় বসে দুপুরে চিংড়ি কিংবা নদীর মাছ দিয়ে ভাত খাবেন। ইছামতীর তীরে দাঁড়িয়ে সীমান্তে সূর্যাস্তের দৃশ্য আপনার তৃষ্ণার্ত মনকে করবে তৃপ্ত। এই লেখা পড়ার চেয়ে লেখা দৃশ্যগুলো চোখে দেখা বেশি উপভোগের। তাই সময় করে ঘুরে আসুন সাতক্ষীরা।
লেখক: হৃদয় আহ্সান আতিক
প্রভাষক, সাংবাদিক, উপস্থাপক, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর