নিজস্ব প্রতিবেদক : সাতক্ষীরায় তালা সদরের শিবপুর গ্রামের আব্দুল হাকিম শেখ। যার বাড়ির রান্নাঘর থেকে ১৬টি কাটা রাইফেল উদ্ধার করে র্যাব। সেই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামী আব্দুল হাকিম। বর্তমানে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন। সেই আব্দুল হাকিমকে সঙ্গে নিয়ে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন মোহাম্মদ আলী বিশ্বাস। বর্তমানে তিনি মুক্তিযোদ্ধা। তবে তার এ মুক্তিযোদ্ধা নাম নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। এলাকায় সে রাজাকার মোহাম্মদ আলী হিসেবে পরিচিত। এমন কি খুনী মোহাম্মদ আলী হিসেবেও তাকে অনেকেই সম্বোধন করেন এখনো। তবে ভূয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে তিনি এখন ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।
স্থানীয় বাসিন্দারাসহ তালা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধার সাবেক কমাণ্ডারও মোহাম্মদ আলী মুক্তিযোদ্ধা নন এবং একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা বিরোধী শক্তি, খুনি, ডাকাত ও লুণ্ঠনকারী তার তথ্য উপাত্ত তুলে ধরে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে অভিযোগ জানালেও কোন কাজ হয়নি। অসাধু কিছু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মোহাম্মদ আলী চলে যায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়।
গত ২৫ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে মোহাম্মদ আলীর স্বরুপ তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলন করেন তালার মাঝিয়াড়া বাজার এলাকার রওশন আরা বেগম। লিখিত বক্তব্যে তিনি উল্লেখ করেন, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার শিবপুর গ্রামে যুদ্ধকালীন সময়ের ডাকাত, লুণ্ঠনকারী ও খুনি মোহাম্মদ আলী বিশ্বাস এখন মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়। তিনি ওই গ্রামের মৃত. হাজের আলী বিশ্বাসের ছেলে। যুদ্ধকালীন সময়ের মোহাম্মদ আলী বিশ্বাসের তাণ্ডবলীলার ক্ষত আজও বয়ে বেড়াচ্ছে অনেক ভুক্তভোগী। সেই মোহাম্মদ আলী বিশ্বাস এখন ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ আর হতাশা প্রকাশ করেছেন যুদ্ধকালীন সময়ে মোহাম্মদ আলীর হাতে খুন হওয়া ওমর আলী সরদারের স্ত্রী তফুরোন বিবিসহ অনেকেই। মোহাম্মদ আলী বিশ্বাস আমার নাবালিকা মেয়েকে (১৩) জোরপূর্বক বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসক ও তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দেয়ার পর তিনি আমাকে ও আমার মেয়েরে বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিচ্ছে। ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন সময়ে শিবপুর গ্রামের মৃত. এজাহার আলী সরদারের ছেলে ওমর আলী সরদারকে রাতের আঁধারে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় মোহাম্মদ আলী বিশ্বাস। এরপর বাড়ির পাশে নির্মমভাবে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে তারা। পার্শ্ববর্তী ইসলামকাটি ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের মৃত. সুধীর হোড়ের ছেলে জয় হোড়ের বাড়িতে ডাকাতি করার সময় মোহাম্মদ আলীকে জয় হোড় চিনতে পারায় তাকে গুলি করে। এতে জয় হোড় বুকে গুলিবিদ্ধ হয়। তিনি এখনও সেই ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন। মাঝিয়াড়া গ্রামের মির্জা নজরুল ইসলাম নজুর বাড়িতে ডাকাতিকালে মোহাম্মদ আলীকে চিনে ফেলায় তার মাকে কুপিয়ে জখম করে। একই গ্রামের মরহুম আব্দুল হান্নান চিশতির বাড়িতে চুরিকালে হাতেনাতে আটক হয় মোহাম্মদ আলী। আটক হওয়ার পর এ ঘটনায় কারাগারেও যেতে হয় মোহাম্মদ আলীকে। মরহুম আব্দুল হান্নান চিশতির ছেলে উপজেলা আ.লীগের সাবেক তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ ইদ্রিস আজও মোহাম্মদ আলীকে রাজাকার হিসেবে সম্বোধন করেন। ২০০৪ সালে ১৮ নভেম্বর তালার মাঝিয়াড়া এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য শেখ সিদ্দিকুর রহমান যুদ্ধকালীন সময়ে মোহাম্মদ আলী বিশ্বাসের খুন, ডাকাতি, চুরি, লুণ্ঠনসহ সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের বাস্তব ঘটনা তুলে ধরে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন।
আবেদনে সিদ্দিকুর রহমান উল্লেখ করেন, মোহাম্মদ আলী বিশ্বাস তালার বারুইহাটি গ্রামের তফেল জোয়াদ্দার, আনছার আলী বিম্বাস, আজেদ আলী মোড়ল, মাঝিয়াড়া গ্রামের মৃত. ছবেদ আলী মির্জার বাড়ি তিন বার, মৃত. আব্দুর রশিদ মির্জার বাড়ি দুইবার, শেখ আশরাফ আলীর বাড়িতে দুইবার, তার ছেলে শেখ সিদ্দিকীর বাড়িতে দুইবারসহ গোপালপুর গ্রামের ৭/৮টি হিন্দু বাড়িতে একাধিকবার ডাকাতি করেন। এছাড়া যুদ্ধকালীন সময়ে মদ, জুয়া, নারীদের জোরপূর্বক ধর্ষণের কথাও তুলে ধরে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্তি না করাসহ মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
লিখিত বক্তব্যে আরও জানানো হয়, ২০০৯ সালে ১৫ অক্টোবর তালা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অমল কান্তি ঘোষ তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে আবেদন করেন। উপজেলার ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার স্বাক্ষরিত আবেদনে বলা হয়, ভুয়া তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম উত্তোলন করেছেন মোহাম্মদ আলী বিশ্বাস। ভুয়া তথ্যে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম উঠিয়ে ভাতা উত্তোলন করছেন তিনি।
ওই সময় মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম তুলতে তালা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটির বিরুদ্ধে তালা সহকারী জজ আদালতে মামলা করেন মোহাম্মদ আলী। যার নং ৩৬/২০০৫ ইং। তবে বিচারক দীর্ঘ শুনানি শেষে মামলাটি খারিজ করে দেন। যুদ্ধকালীন সময়ে মোহাম্মদ আলী বিশ্বাস তৎকালীন বিতর্কিত বামফ্রন্ট (নকশাল) কামেল বাহিনীর অন্যতম সদস্য ছিলেন। এ আবেদনটি প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভন্ন দপ্তরে পাঠান মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অমল কান্তি ঘোষ।
মোহাম্মদ আলী বিশ্বাসের একমাত্র ছেলে মোস্তফা বিশ্বাস ৩ বছর আগে ফেন্সিডিলসহ সাতক্ষীরা ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেল খাটেন। সম্প্রতি ইসলামকাটি ইউনিয়নের গোপলপুর গ্রামের কালিপদ বিশ্বাসের ছেলে বিধান বিশ্বাসের জমি দখল করতে উঠেপড়ে লেগেছে। মুক্তিযোদ্ধার নাম ব্যবহার করে চাঁদা চায়। তবে স্থানীয় ইউপি সদস্য সঞ্চয় দের বাধার কারণে সম্ভব হয়নি। বাস্তব এ ঘটনা স্থানীয় বাসিন্দাসহ তালাবাসীর সর্বজন স্বীকৃত। এসব ঘটনায় সংবাদ সম্মেলনকারী রাজাকার মোহাম্মদ আলী বিশ্বাসের যুদ্ধকালীন সময়ের অপকর্ম ও বর্তমান অপকর্মের ঘটনাবলী তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানায়
অন্যদিকে, মঙ্গলবার দুপুরে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে মোহাম্মদ আলী বিশ্বাস। তিনি অভিযোগ করেন, বিভিন্ন জায়গায় মিথ্যা ও হয়রানি মুলক দরখাস্ত দিয়ে একের পর এক তাকে হয়কারি করা হচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে দক্ষিণাঞ্চলের এক সময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী মৃনাল বাবুর ডানহাত হাকিম শেখসহ বেশ কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন।