সাতনদী ডেস্ক: করোনা ভাইরাস জনিত উপসর্গ নিয়ে সদ্য প্রয়াত সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর খোকনের পুত্র আবির তার বাবাকে নিয়ে সম্প্রতি একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। একজন পুত্র তার বাবাকে কতোটা ভালবাসতে পারে, কতটা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারে আর অভিভাবকহীন হলে একজন পুত্র , একটি পরিবার কতোটা অসহায়ত্ব বোধ করতে পারে প্রাণছোঁয়া ঐ স্ট্যাটাসটি পড়লে তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। তাই স্ট্যাটাসটি দৈনিক সাতনদীর পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো।
‘আমরা এখন আরো বেশি কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়ে গেলাম’
আমি ও আমার পরিবার এর কাছে মনে হচ্ছে যে আমরা হয়তো কোনো বাজে স্বপ্ন দেখলাম । কিন্তু এইটা যে আসলে বাস্তবেই হয়ে গেলো আমরা এখনো বিশ্বাসই করতে পারছি না। আমার কাছে এখনো মনে হচ্ছে যেন একটা বাজে স্বপ্ন দেখে হয়তো ঘুমটা ভাঙলো।
আমার বাবা একজন অত্যন্ত সৎ, নিষ্ঠাবান,পরিশ্রমী একজন ব্যক্তি ছিলেন। যিনি সারাটি জীবনে হয়তো নিজের কথা কখনো ভাবেননি। আমাদের জন্যই সারাটা জীবন উৎসর্গ করে গেলেন। এই করোনা সংকটময় দিনেও তিনি ঝুঁকি নিয়ে প্রতিটা দিন অফিসে গেছেন, বাসায় ফিরেছেন। আমি এই নিয়ে আমার বন্ধুদেরও বলেছিলাম যে আমরা খুব ভয়ে আছি। কারণ আমার আব্বু আর আপু দু’জন চাকুরীজীবি পরিবারে এবং তারা প্রতিদিনই অফিস এর গাড়ি দিয়েই অফিসে আসা যাওয়া করছেন।
আমার বাবার ৩-৪ দিন ধরে কাশি হচ্ছিল, পরিমানটা দিন দিন বেড়েই চলছিল। আমার তখনই সন্দেহ হচ্ছিল। আমি বাবা কে বললাম, আপনার করোনা হয়নি তো ? সে হেসে বললো, ”অরে ধুর বেটা, টন্সিল এর ব্যথা, এইটা আগের থেকেই ছিল। ঐরকম কিছু না।” কারণ সে চাচ্ছিল বাসায় থেকেই ট্রিটমেন্ট নিয়ে সুস্থ হতে। কারণ করোনা পজেটিভ হলে এলাকার ভিতর আতঙ্ক ছড়াবে। এছাড়া লজ্জাতেও সে তখন এটা সাধারণভাবেই দেখছিলো।
আমিও ভাবলাম যে এইরকম সাধারণ জ্বর কাশি বাসায় ওষুধ খেলে, গরম পানি খেলে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। আমি এই কয়দিন বাসায় সাধারণভাবেই কাটাচ্ছিলাম বিভিন্ন স্কিল ডেভেলপেড করার জন্য অনেক কিছু শিখছিলাম। কিন্তু বাবার কাশি বেড়েই চলছিল আম্মু ও জ্বর অনুভব করতে শুরু করলো তার দুই দিন আগে। তখন আমি ভয় পেয়ে গেলাম।
আম্মুকে বললাম, বললো যে কোরোনার নমুনা দুই একদিন এর ভিতরই নিতে আসবে। কিন্তু বাবার কাশি বেড়েই চলছিল, কাশির সাথে সাথে ফুসফুস মারাত্মকভাবে আক্রমণ করছিলো মনে হচ্ছে। হয়তো বাবার গলায় চুলকাচ্ছিল। আমি এর পরের দিন একটু দেরিতে উঠলাম। দেখলাম, আম্মু বাবাকে ভাতেরজাউ রান্না করে খাওয়াচ্ছে। হঠাৎ দেখলাম সে জানি কেমন করছে। মনে হচ্ছে অনেক কষ্ট হচ্ছে, মনে হলো শ্বাস কষ্ট হচ্ছে বাবার। সে ওই মুহূর্তে এই লড়াই এর সাথে পেরে উঠতে পারছিল না। আম্মুকে বললো, সকালে অ্যাম্বুলেন্স খবর দেয়া হয়েছে। উত্তরার রিজেন্ট এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স আসবে। আম্মু বললো, “তোর কাছে কি ভাংতি টাকা আছে ? আমাকে দে তো ।” আমার কাছে ৩৫০০ টাকা ছিল আমি সাথে সাথে পুরাটাই আম্মুকে দিয়ে দিলাম । আমি ঘরে পড়ার জামা গায়েই অ্যাম্বুলেেন্সে উঠে গেলাম। কারণ আমার মনে হচ্ছিলো এমনিতেই দেরি হয় গেছে।
আমি ভাবলাম হাসপাতালে হয়তো অনেকেই থাকবে আব্বুর জন্য, বিশেষ করে অফিসের লোক। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলাম আমি আর আম্মু ছাড়া পরিচিত কেউই নেই। কারণ লকডাউন থাকার কারনে রাস্তায় তেমন গাড়ি চলে না । এছাড়া অনেকেই হয়তো লক্ষণগুলোর বর্ণনা শুনেই আসতে আর সাহস করেনি।
এদিকে শাবান আঙ্কেল সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল হাসপাতালে। তারা সর্বাত্মক চেষ্টাই করেছিল আই.সি.উই তে রেখে অক্সিজেন দেয়ার। কিন্তু ডাক্তার বললো, তার পালস্ নেই এবং ব্রেনও অক্সিজেন নিচ্ছে না। ডাইরেক্টলি বললেন যে, “সে আগেই মারা গেছে।’ বললো, “আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি, দোয়া করেন যদি ব্রেইন হঠাৎ মিরাকেল ভাবে কাজ করতে শুরু করে।” রাত ১০:০০ টার দিকে আম্মুকে উপরে ডাকা হলো শেষ বারের মতো দেখার জন্য। তখন আম্মু ফোনে কয়েকজনকে জানিয়ে দেয়।
এছাড়া নিউজ স্ক্রল গুলাতেও অফিসিয়ালি আপডেট দিয়ে দেয় যে বাবা আর নেই। বাবার করোনা টেস্ট হওয়ার আগেই মারা গেছেন তাই এটা অফিসিয়ালি বলা হয়নি। বলা হয়েছে যে করোনা ভাইরাস এর উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন।
সবাই বাবার জন্য দোয়া করবেন, যেন আল্লাহ ওনাকে জান্নাতবাসী করেন। ওনার মতো ভালো, সৎ এবং নিষ্ঠাবান মানুষ সমাজে খুব কমই আছে । এছাড়া আমি চাই না এখন সবাই আমাদেরকে ডিমোটিভেট বা ভয়ভীতি দেখাক। এমনিতেই ‘আমরা এখন আরো বেশি কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়ে গেলাম।
আমরা সবাই সতর্কতা অবলম্বন করেই বাসায় আছি । বাসা বা এলাকা হয়তো লকডাউন হতে পারে। তাই এই মুহূর্তে মনে করি সবাই আমাদের জন্য দোয়া করুক। আমার বন্ধুরা অনেক চিন্তিত হয়ে পড়েছে আমার জন্য, আমাদের সামনের দিনগুলো নিয়ে। আশা করি আমাদের পরিবার ,আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ , ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটি , বাংলাদেশ সরকার পাশে থাকবেন ।
বাস্তবতা অনেক বেশি কঠিন হয়ে গেছে তবুও এর সাথেই সব কিছু এডজাস্ট করে নিতে হবে। সবাই ভালো থাকবেন অনেক ভাল। দয়া করে আমাদের পাশে থাকুন, ভুলে যাবেন না প্লীজ।
সংগৃহীত