মোঃ কামাল উদ্দিন:
২০১৮ সালের ২ মার্চ থেকে বাংলাদেশে সরকারি ভাবে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত, জাতীয় ভোটার দিবস প্রতি বছরের ন্যায় এই বছরেও যথানিয়মে পালিত হয়েছে জাতীয় ভোটার দিবস।
এই দিবসকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশনার জনাব ইউনুচ আলীর নেতৃত্বে গত ২ মার্চ যথাযথ মর্যদায় সকাল ১০টা থেকে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ থেকে বেলুন উড়িয়ে দেওয়া ও একটি রেলী'র মাধ্যমে ভোটার দিবসের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। অনুষ্ঠানে উদ্বোধক ও প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান, চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা, তবে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিলো বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসলাম, তিনি চট্টগ্রামের বাইরে থাকার দরুন উনার পরিবর্তে বিভাগীয় কমিশনার এর দায়ীত্ব প্রাপ্ত হিসেবে তিনিই প্রতিনিধিত্ব করেন।
ডি আই জি নুরে আলম মিনার পক্ষে প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কবীর,পুলিশ কমিশনার এ-র পক্ষে ছিলে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার নোবেল চাকমা, জেলা প্রশাসকের পক্ষে ছিলেন ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক আব্দুল মালেক ,পুলিশ সুপারের পক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রওশন আরা চট্টগ্রাম জেলা মুক্তি যোদ্ধা কমন্ডার মোজাফফর, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সিনিয়র সহসভাপতি, চ্যানেল আই চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান চৌধুরী ফরিদ, জেলা নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আইয়ুব আলী এবং আমি সহ আরো বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিনিধি এবং স্কুলের অসংখ্য শিক্ষার্থীরা।
১০ টার সময় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ থেকে লাল সবুজের গেঞ্জি ও কেপ পরে, ঐতিহাসিক ব্যান্ড বাজক নিয়ে, ব্যান্ড বাজকরা দেশাত্মবোধক গানের সুর বাজিয়ে রেলীর আগে আগে চলছিলেন, আমরা সবাই সারিবদ্ধ ভাবে হেঁটে হেঁটে রেডি সেন্স ব্লুর সামনে হয়ে আবারও সার্কিট হাউজে ফিরে আসলাম। এর আলোচনা শুরু, একে একে সবাই আমরা আলোচনায় অংশ নিলাম, তবে আমি এবং চৌধুরী ফরিদ ভোটার করার বিষয়ে অনিয়ম ও প্রবাসীদেরকে ভোটার করার জন্য যথাযথ কতৃপক্ষের কাছে আহবান জানিয়েছি।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবদুল মালেক, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কবীর সাহেব এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রওশন আরা, এডিসি নোবেল চাকমা, মুক্তি যোদ্ধা কমান্ডার মোজাফফর ভাই সহ সবাই কিন্তু জাতীয় ভোট দিবসকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। বিশেষ করে প্রধান অতিথি মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা তিনি তার বক্তব্যতে জীবনমুখী স্মৃতি ময় কিছু বাস্তবতা তুলে ধরেছেন।
তিনি তথ্য ভিত্তিক কথার মাধ্যমে ভোটার হওয়ার এবং আইডি কার্ড ও জন্ম সনদের গুরুত্ব কতটুকু তা বুঝিয়ে বলেছেন, তিনি বলেন একটি সন্তান জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম সনদ নিতে হবে, ৪৫ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর সরকার ফ্রি টিকাও পাবে না জন্ম সনদ না থাকলে। পাসপোর্ট ও আইডি কার্ড এব জন্ম সনদের নাম ও তারিখ ভুল সংশোধন করতে গেয়ে বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা দীর্ঘ সময় খুব সুন্দর করে বসালো কথা বলেছেন।
তিনি নিজেকে ঝরা পাতার পথে আখ্যাত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অবগত করেছেন বাস্তব অভিজ্ঞতা। জন্ম সনদ নেওয়া সময় নামের বানান ও বয়সে সঠিকতা দেখে নেওয়ার পরামর্শদেন। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছেন জেলা নির্বাচন কমিশন আইয়ুব আলী, তিনি অনুষ্ঠান পরিচালনার ফাঁকে ফাঁকে তথ্য ভিত্তিক বেশ কিছু কথা বলেছেন। অনুষ্ঠানটি যার নেতৃত্বে এবং সভাপতিত্বে শুরু হয়েছিল তিনি হলেন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশন জনাব মোহাম্মদ ইউনুচ আলী, তিনি জাতীয় ভোটার দিবসের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বাংলাদেশের যে কোন নাগরিক ভোটার হতে পারবে বলে বিভিন্ন পরামর্শ তুলে ধরেন। ইউনুচ আলী আরো বলেন, প্রতিদিনই ভোটার হতে পারবে কোন সমস্যা নেই, কিন্তু স্মার্ট কার্ড পাইতে একটু সময়ের প্রয়োজন তা উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে চট্টগ্রামে রোহিঙাদের সমস্যার কারণে চট্টগ্রামের আসল বসবাসকারিরা বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে জানান। চট্টগ্রামের মানুষ যেন ভোটার হওয়ার বিষয়ে কোনধরনের হয়রানি শিকার হলে তা সাথে সাথে ব্যবস্হা নেওয়াও কথাদেন। জাতীয় ভোটার দিবস উপলক্ষে ১০ জনকে দিনে দিনে ভোটার করে, ভোটার কার্ড হস্তান্তর করেন। দীর্ঘ সময় ধরে আমরা একটি সুন্দর আলোচনার মাধ্যমে অনুষ্ঠান শেষ করলাম।
জাতীয় ভোটার দিবস নিয়ে এতক্ষণ শুনাইলাম ভোটার দিবস নিয়ে লেখা দেখার পাশাপাশি একনজরে দেখার দরকার বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাস। পৃথিবীতে কয়েকটি দেশ ব্যতীত অন্যান্য প্রায় দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষমতার পালাবদল করার নিয়ম রয়েছে। ঠিক তেমনি আমাদের দেশেও নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষমতার পালাবদল হয়।
কোন প্রতিষ্ঠান বা দপ্তরের কোন পদে প্রার্থীদের মধ্য থেকে এক বা একাধিক প্রার্থীকে বাছাই প্রক্রিয়া যেমন সরকার, আইনসভা এবং বিধিবদ্ধ সংস্থাগুলিতে নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক প্রকাশ্য বা গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা হয়। নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সকল আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেই কোন এক ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল এবং কোন কোন ক্ষেত্রে এর ধরন ছিল প্রায় অভিন্ন। নির্বাচন ছিল প্রাচীন গ্রিসীয় শাসন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য এবং সেখানে সাধারণত লটারীর মাধ্যমে নির্বাচন সম্পন্ন হতো।
আমেরিকার আদিবাসীদের অনেক গোত্রের লোকের নির্দিষ্ট কোন পাত্রে শস্যকণা নিক্ষেপের মাধ্যমে গোত্রপ্রধান নির্বাচন করত। প্রাচীন ভারতে কখনও কখনও স্থানীয় প্রধান নির্বাচিত হতেন। মুঘল শাসন বিধানে স্থানীয় জনগণের মনোনীত ব্যক্তিরা স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনা করতেন। সম্রাট জেলা পর্যায়ে ফৌজদার ও অপরাপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়োগ করতেন এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হতেন।
বাংলায় গ্রামের লোকেরা নিজ নিজ গ্রামের মোকাদ্দম বা গ্রামপ্রধান, পাটোয়ারী বা কর আদায়কারী নির্বাচন করত। গ্রাম মোকাদ্দমের পরামর্শক্রমে পরগণা কাজী ও থানাদার নিযুক্ত হতেন। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে এই ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়। কিন্তু ঊনিশ শতকের সত্তর ও আশির দশকে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পঞ্চায়েত প্রথা বহাল ছিল।
আধুনিক জাতি রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্য গঠিত রাজনৈতিক দলের উদ্ভবের ফলে ঐতিহ্যগত নির্বাচন পদ্ধতির রূপান্তর ঘটেছে। নির্বাচন এখন গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ত্রয়োদশ শতকে ইংল্যান্ডে সংসদীয় ব্যবস্থা গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়া সূচিত হয়। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন নির্বাচনী আইনের (যেমন ১৬৯৪ সালের ট্রিনিয়্যাল অ্যাক্ট এবং ১৭১৬ সালের সেপ্টেনিয়্যাল অ্যাক্ট) মাধ্যমে এর নিয়মিতকরণ সম্পন্ন হয় এবং ঊনিশ শতকে পরপর প্রণীত সংস্কার বিলগুলোর আওতায় ভোটাধিকারের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়। ১৮৭২ সালে গোপন ব্যালট পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং অবশেষে ১৯২৮ সালে সর্বজনীন ভোটাধিকারের বিধান চালু হয়।
অবশ্য বাংলায় নির্বাচনী ব্যবস্থা অনুরূপভাবে বিকশিত হয় নি। ঔপনিবেশিক শাসকেরা নির্বাচিত স্থানীয় সরকার সংস্থা, যেমন গ্রামপ্রধান, পঞ্চায়েত, পাটোয়ারী, আমীন, মুনসেফ, থানাদার ও কাজীর পদসমূহ বিলুপ্তির মাধ্যমে প্রাচীন নির্বাচন ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে। এসব প্রতিষ্ঠান জনসমর্থন ও সহযোগিতার মাধ্যমে পরিচালিত হতো। ১৮৬৮ সালে পৌর আইন (৬নং আইন) প্রণয়নের মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশ নির্বাচিত এবং এক-তৃতীয়াংশ মনোনীত সদস্য সমন্বয়ে পাশ্চাত্য ধরণের পৌর কমিটি গঠনের বিধান প্রবর্তন করা হয়।
শুধুমাত্র পৌর কর দাতাদেরই সদস্য নির্বাচিত করার অধিকার ছিল। বাংলার পৌরসভাগুলোর মধ্যে প্রথমদিকে শ্রীরামপুর, বর্ধমান ও কৃষ্ণনগরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় (১৮৬৮)। ১৮৮৪ সালে প্রবর্তিত ৩নং আইন বলে ঢাকাসহ বাংলার গুরুত্বপূর্ণ পৌরসভাসমূহ নির্বাচনী ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়। একই আইনে আংশিক নির্বাচন ও আংশিক মনোনয়নের ভিত্তিতে জেলা কমিটি ও স্থানীয় বোর্ডসমূহ গঠিত হয়।
পৌর ও গ্রাম এলাকায় এই সীমিত নির্বাচনী ব্যবস্থা চালুর পর থেকেই গ্রাম পর্যায়ে ভোটাধিকার সম্প্রসারণের নতুন পর্বের সূচনা হয়। ১৯০৯ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় আইনসভায় নির্বাচনের বিধান প্রবর্তন করা হয়। ১৯১৯ সালের ভারত (১২)শাসন আইনের আওতায় ভোটাধিকার ও নির্বাচনী সংস্থাকে সম্প্রসারিত করা হয়। ১৯০৯ সাল থেকে সম্প্রদায় ও পেশার ভিত্তিতে নির্বাচন শুরু হয়।
১৯২০ সাল থেকে অনিয়মিতভাবে হলেও পৃথক নির্বাচনের ওপর ভিত্তি করে স্থানীয়, পৌরসভা ও জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন তখনও সর্বজনীন না হলেও সেখানে ব্যাপকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক আইন পরিষদে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার ভিত্তিতে এটাই ছিল সর্বশেষ নির্বাচন।
সূচনালগ্ন থেকেই বাংলার জনগণ নির্বাচনে উৎসাহী হয়ে ওঠে। ঢাকা পিপলস্ অ্যাসোসিয়েশনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা পৌরসভা, জেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচনের বিধান প্রবর্তিত হয়। ভোটাধিকার সম্প্রসারণের প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল জনগণের দাবির ফল। কিন্তু প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থায় জনগণের আগ্রহ সত্তে¡ও পাশ্চাত্য ধাঁচের নির্বাচন বাংলায় কখনও সাফল্যের সঙ্গে কার্যকর হয় নি।
লক্ষ্যণীয় যে, ভারতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো ঔপনিবেশিক শাসকের পরিকল্পনা অনুযায়ী ঔপনিবেশিক, সা¤প্রদায়িক বা গোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। তাই ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ রক্ষায় সরকার সর্বদাই নির্বাচনকে স্থানীয় অনুগত প্রভাবশালী মহল, বিশেষ করে জমিদারদের অনুকূলে প্রভাবিত করতে সচেষ্ট ছিল। ১৯৩৫ সাল অবধি পৌরসভা, স্থানীয় পর্যায়ের কমিটি ও বোর্ডে নির্বাচিত ও মনোনীত উভয় ক্ষেত্রেই জমিদারদের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। এমন কি ১৯৩৭ সালের নির্বাচনেও তাদের প্রভাব বজায় ছিল।
এরপর নির্বাচনের ইতিহাসে রাজনৈতিক মেরুকরণের ধারা লক্ষ্য করা যায়। ১৯২০ সাল পর্যন্ত দলীয় মনোনয়ন ছাড়াই প্রার্থীরা ব্যক্তিগত ও গণতান্ত্রীক ভাবে প্রতিদ্বন্দিতায় অবতীর্ণ হন। এমন কি ১৯৩৭ সালের নির্বাচন দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সংখ্যা ছিল সর্বাধিক। ২৫০ আসনের মধ্যে ৮১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী (মুসলিম ৪৩, হিন্দু ৩৯) জয়ী হন। দলীয়ভাবে মনোনীতদের মধ্যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ৫২, মুসলিম লীগ ৩৯, কৃষক প্রজা পার্টি ৩৬ এবং বিভিন্ন উপদল অবশিষ্ট আসন লাভ করে।
নির্বাচনের ফলাফলে প্রতীয়মান হয় যে, প্রার্থীদের মধ্যে তখনও তেমন রাজনৈতিক মেরুকরণ ছিল না। পরবর্তী দশকে অবস্থার মৌলিক পরিবর্তন হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিরঙ্কুশভাবে পরাজিত করে। প্রায় ৩০০ প্রার্থী স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী করলেও তাদের মধ্যে মাত্র ৮ জন (হিন্দু ৬ ও মুসলমান২) নির্বাচিত হন। এভাবেই স্বতন্ত্রপ্রার্থীদের নির্বাচনের যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। পরবর্তী সকল নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সাফল্য ছিল একান্তই ব্যতিক্রম।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর হিন্দুদের ব্যাপকভাবে দেশত্যাগ, জমিদারি প্রথার বিলোপ এবং ১৯৫৬ সালে সর্বজনীন ভোটাধিকারের বিধান প্রবর্তনের ফলে বিভাগপূর্ব নির্বাচন পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ ও জেলা বোর্ড নির্বাচনে তুলনামূলকভাবে নবীন ও অনাবাসিক আইনজীবীরা প্রাধান্য বিস্তার করে। ষাট ও সত্তরের দশকে এ প্রক্রিয়ার দ্রুত পরিবর্তন ঘটে এবং তখন প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের ক্ষেত্রে পেশাদার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সচ্ছলতার বিষয়টি গুরুত্ব লাভ করে।
আইয়ুবের দমনমূলক শাসন (১৯৫৮-১৯৬৯), স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন (১৯৬৬-১৯৭১), মুক্তিযুদ্ধ, বাকশাল গঠনসহ যুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক পরিবর্তন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড এবং তৎপরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা নির্বাচনের ধারাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়। তখন থেকে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য নয়, বরং নির্বাচনকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আইনসিদ্ধ ও বৈধকরণের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়। ১৯৭৫ পরবর্তী দশকগুলোতে অনুষ্ঠিত এ ধরনের বেশ কিছু সাধারণ নির্বাচন বর্জন কিংবা প্রতিরোধের মুখে বাতিল হয়ে যায়।
১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচন গণআন্দোলনের ফসল। বাংলাদেশের যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে অনুষ্ঠিত নির্বাচন দুটি স্বাভাবিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে পুনরুজ্জীবিত করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। কিন্তু তার জন্য চরম মূল্য দিতে হয়। রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিতে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে প্রথমবারের মতো নির্বাচনের ইতিহাসে যুক্ত হয় এক নতুন উপাদান, সন্ত্রাস। সন্ত্রাস কেবল সাধারণ নির্বাচনেই নয়, ব্যক্তি বিশেষের দলীয় অবস্থান নিরূপণের জন্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও পরিলক্ষিত হয়।
এ অবস্থা অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনকে কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সশস্ত্র ক্যাডার লালন করে। এদের কাজ হচ্ছে ভয় দেখিয়ে ভোট সংগ্রহ, নির্বাচন কেন্দ্র দখল এবং প্রয়োজনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই। এ পরিস্থিতিতে রাজনীতিবিদ, সংবাদপত্র ও জনগণ অত্যন্ত তিক্ততার মধ্যে নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণ করে। নির্বাচন এমন আত্মকেন্দ্রিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, পরাজিত দল নির্বাচনের ফলাফলকে পাতানো খেলা ও বানোয়াটরূপে আখ্যায়িত করে তা বাতিল ও নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানায়, আর বিজয়ী ক্ষমতাসীন দল এই দাবিকে ভিত্তিহীন বলে অস্বীকার করে।
১৯৯১ সালে বি এন পি নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু মাগুরা উপ নির্বাচনে অনিয়ম করার দরুন তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সহ জাতীয় পাটি এবং জামাত একসাথে তত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি চালুর দাবিতে ১৯৯৪ সাল হতে দীর্ঘ আড়াই বছর আন্দোলন করেন। ১৯৯৪ সালের ২৮ শে ডিসেম্বর সবাই এক সাথে পদত্যাগ করেছেন।
দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলনের কারনে ১৯৯৬ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারীতে বি এন পির কয়েকটি নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দল নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন। এর পর ২৬ শে মার্চ ভোররাতে ঐতিহাসিক তত্বাবধায়ক সরকারের আইন পাশ হয়।৩০ শে মার্চ বি এন পি সাংসদ থেকে পদত্যাগ করে তত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন এবং ১৯৯৬ সালে দেশে আইনগতভাবে প্রথম তত্বাবধায়ক সরকারের অধিনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম তত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টা হন প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান।
সেই নির্বাচনে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রিয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। এর পর ২০০১ সালে আবারও তত্বাবধায়ক সরকার গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন উপদেষ্টা হয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান। সেই নির্বাচনে বি এন পি জামায়াত জোট করে সরকার গঠন করেন। এর পর বি এন পি তাদের মনোনীত বিচারপতি কে এম হাসামকে উপদেষ্টা মনোনীত করার জন্য পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করার দরুন আবারও আন্দোলন শুর হয়,এই দিকে বি এন পি জোট সরকার তাদের রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজ উদ্দিন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত করেন। কিন্ত তা কেউ না মানার কারনে রাজপথে আন্দোলন জোরদার করা হয়।
যার কারণে সেনাবাহিনীর প্রধান মঈন আহমেদ এর সমর্থনে রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন আহমেদকে উপদেষ্টা থেকে সরিয়ে ড.ফখরুদ্দিনকে প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত করেণ। এবং ২০০৯ সালে তাদের অধিনে নির্বাচনে আবারো আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রিয় ক্ষমতায় আসেন। এর পর মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কারণে তত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ২০১১ সালে বাতিল করেন।সংবিধান সংশোধন করেন।এবং তত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে সংবিধান অনুপাতে নির্বাচন কমিশন ও দলিয় সরকারের অধিনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে, কিন্তু সেই নির্বাচনে বি এন পি সহ তাদের সমর্থনকৃত রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেননি।
এ-র পর দেশে দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলনের নামে সহিংসতা ঘটনা ঘটে। তবুও আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলের তত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি চালু করতে রাজি হননি। এর পরে ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বি এন পি সহ তাদের সমমনা দল সমূহ আওয়ামী লীগের দলিয় সরকারের অধিনে নির্বাচনে (৩৫)অংশ নিয়েছিলেন। কিন্ত নির্বাচন চলাকালীন তারা নির্বাচন বর্জন করেছেন। এর হলো তাদের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস সবার জানা আছে। এখন আগামী ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছ।যাচ্ছে দ্বাদশ সাংসদ নির্বাচন, সেই নির্বাচনে বি এন পি সহ তাদের সমমনা দল সমূহ আওয়ামী লীগের অধিনে নির্বাচনে অংশ নেননি।
জাতীয় ভোটার দিবসের একটিই শ্লোগান হোক, সঠিক তথ্যে ভোটার হবো স্মার্ট বাংলাদেশর গড়ে তুলবো।
লেখকঃ সাংবাদিক, গবেষক, টেলিভিশন উপস্থাপক ও মহাসচিব, চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম।