শেখ আব্দুল হাকিম,শ্যামনগর থেকে: এক বছর আগেও ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদজনক শিশু শ্রমিক কখনো চিংড়ী, কখনো কাঁকড়া ও কখনো বিভিন্ন ধরণের মাছ ধরাসহ কঠোর পরিশ্রমের সাথে জড়িত ছিল ফয়সাল শেখ। দিনভর খাটতে হতো ছোট্ট শিশু ফয়সালকে। সারা দিন কঠোর পরিশ্রম করে আয় করত মাত্র একশত টাকা। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে তা তুলে দিত মায়ের হাতে। আশপাশে বিদ্যালয় না থাকায় পড়ালেখা হচ্ছিল না। কিন্তু এখন সেসব অতীত ফেলে রেখে ফয়সাল নিয়মিত বিদ্যালয়ে যায়। আলোর উত্তরণ সংস্থা শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের চতুর্থ শ্রেণির এই ছাত্রের চোখে এখন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন। ফয়সাল শ্যামনগরের মথুরামপুর গ্রামের শেখ আবুজার ও ফরিদা বেগমের সন্তান।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার শেষ সীমান্তে সুন্দরবনের কোল ঘেঁেষ গড়ে উঠেছে মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়ন। এই উপক‚লীয় এলাকার ফয়সাল শেখের মতো বহু শ্রমজীবী শিশু এখন বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। উত্তরণ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা এসব এলাকার শিশুদের জন্য খুলেছে উত্তরণ শিশু শিক্ষা কেন্দ্র নামের চারটি বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয় গুলোতে পড়ছে ৩৫০ শ্রমজীবী শিশু। এর মধ্যে ১৪ থেকে ১৭ বছর বয়সী ২৫ জন মেয়ে ইন্ডাষ্ট্রিয়াল সুইং মেশিন ও টেইলরিং এবং ২৫ জন ছেলে ইলেকট্রনিকস ও মোবাইল সার্ভিসিংয়ের বিষয়ে তিন মাসের কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে।
উত্তরণের শিশু শ্রম নিরসন প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক নাজমা আক্তার বলেন,শ্যামনগরে মুন্সীগঞ্জ,কাশিমাড়ি,বুড়িগোয়ালিনী ও গাবুরা ইউনিয়নের চার গ্রামে ৪ টি শিশুকেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। এই চার টি ইউনিয়নের চারটি লার্নিং সেন্টারে ৩৫০ জন শ্রমজীবী শিশুকে শিক্ষাদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি শিশুদের চিত্রাঙ্কন,সংগীতসহ নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাÐ ও খেলাধুলায় যুক্ত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, দুই বছর মেয়াদী উক্ত প্রকল্প ২০২১ সালের ১ জানুয়ারী হতে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে।এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হ্রাস করা বিশেষ করে বাংলাদেশের উপক‚লীয় অঞ্চলে মৎস্য খাতে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুদের সুরক্ষা দেয়া।
মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের মথুরাপুর গ্রামে উত্তরণের শিশু শিক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, শিক্ষকের সঙ্গে গলা মিলিয়ে নামতা পড়ছে শিশুরা। চোখে-মুখে শ্রমের ক্লান্তি নেই। আছে দুষ্টুমির হাসি। শিশুদের এমন নির্ভার কষ্টহীন চেহারা দেখে অভিভাবকেরাও খুশি।বিদ্যালয়ের অদূরে দাঁড়ানো কয়েকজন অভিভাবক বলেন,আমরা ভাবতেই পারিনি এভাবে ওরা পড়ার সুযোগ পাবে। বাচ্চারা পড়ছে দেখে খুব ভালো লাগছে।’
এ শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষার্থী নয়ন মন্ডল, তাইজুল সরদার, ফুলঝুরি, সীমা বারুই, সোনামনি সরদারসহ কয়েকজন জানায়, শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে পড়তে তাদের ভালো লাগে। কারণ বিভিন্ন কাজ করার পাশাপাশি তারা এখানে পড়াশুনার সুযোগ পেয়েছে। উপক‚লীয় এলাকার এই শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে মুক্ত করে শিখন কেন্দ্রে পড়াতে পেরে স্থানীয়দের মাঝেও উৎসাহ দেখা যায়।
শ্যামনগর উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ সোহাগ হোসেন জানান, মূলত ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রমে নিয়োজিত স্কুল বহির্ভূত শিশুদের শিক্ষার মূল স্রোতে আনার জন্যই এ ব্যবস্থা। এটি দুর্গম ও পিছিয়ে পড়া উপকূলীয় এলাকায় অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ্জ্ব আবুল কাশেম মোড়ল বলেন, উত্তরণের এডুকো প্রকল্পের এই কার্যক্রম উপকূলীয় এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। স্কুলটি যাতে স্থায়ীরূপ পায় সেজন্য সার্বিক সহযোগিতা করা হবে বলে জানান তিনি।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আ.ন.ম. আবুজর গিফারী বলেন, শিশু শ্রম নিরসনে এসকল কার্যক্রমে এলাকার শ্রমজীবী ছেলে-মেয়েরা উপকৃত হচ্ছে।