জিয়াউর রহমান, শ্যামনগর থেকে:
শ্যামনগরের উপকূলীয় অঞ্চলের নারীর অধিকার আদায়য়ের লক্ষ্যে এবং মানব কল্যানে ৫ জয়িতা’র জীবন সংগ্রামের গল্প। সংগ্রামী অপ্রতিরোধ্য নারীর প্রতীকী নাম জয়িতা। নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের মূর্ত প্রতীক জয়িতা। কেবল নিজের অদম্য ইচ্ছাকে সম্বল করে চরম প্রতিকূলতাকে জয় করে জয়িতারা তৃণমূল থেকে সবার অলক্ষ্যে সমাজে নিজের জন্য জায়গা করে নিয়েছেন। সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর এই জয়িতাদের খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিয়েছে। উদ্যোগটির নাম ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’। জয়িতাদের পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে ১. অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী; ২. শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী; ৩. সফল জননী নারী; ৪. নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন যে নারী; ৫. সমাজ উন্নয়নে অবদান রেখেছেন যে নারী। শ্যামনগর উপজেলায় জয়িতা বাছাই কাজটি পরিচালিত হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বাছাইয়ের কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পাঁচজন জয়িতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর মনে করে, জয়িতারা বাংলাদেশের বাতিঘর। জয়িতাদের দেখে অন্য নারীরা অনুপ্রাণিত হলে ঘরে ঘরে জয়িতা সৃষ্টি হবে। আর তা হলেই বাংলাদেশ তার গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।
অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারীর নাম শ্রাবনী রানী। তিনি তার জীবন কাহিনীতে লিখেছেন- আমি শ্রাবনী রানী, স্বামী- সুশীল কুমার মন্ডল, গ্রাম+ ডাকঘর ও ইউনিয়ন- রমজাননগর, উপজেলা- শ্যামনগর, জেলা- সাতক্ষীরা। প্রায় ১৪ বছর পূর্বে রমজাননগর গ্রামের সুশীল কুমার মন্ডলের সাথে আমার বিবাহ হয়। বাবার আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল ছিল না, তাই বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারি নাই। আমার গরীব পিতার পক্ষে আমাদের ভাইবোনদের লেখাপড়ার খরচ যোগাড় করা ছিল অসম্ভব। আমার লেখাপড়া করার ইচ্ছা থাকলেও অভাবের কারণে তা করতে পারিনি। রমজাননগর গ্রামের কুমার মন্ডলের সাথে আমার বিবাহের পর শুরু হয় নতুন জীবন যুদ্ধ। স্বামীর সংসারেও তেমন অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ছিল না। কোনরকম জীবন যাপন করতে থাকি। স্বামীর উপার্জনের উপর নির্ভর করে কোর রকম সংসার চালাতে হতো। একসময় আমি চিন্তা করি এভাবে আর কতদিন সংসার চলবে। এমতাবস্থায় আমি ২০১১ সালে সুশীলন নামে একটি এনজিও’র সাথে পরিচিতি লাভ করি। সুশীলন এনজিও আমাকে ঘর থেকে বাইরে এনে বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। সুশীলন এনজিও আমাকে পানি ও পায়খানার উপর বিভিন্ন ট্রেনিং করায়। সুশীলন পুষ্টি প্রকল্পেও এক বছর কাজ করি। ২০১৪ সালে আরওএসসি প্রকল্পের সহযোগিতায় ৫বছরের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের থেকে ঝরে পড়া শিশুদের নিয়ে লেখাপড়ার কাজ শুরু করি। এর পাশাপাশি ২০১৬ সালে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ “নবযাত্রা” প্রকল্পে বিভিন্ন মহিলা সদস্যদের নিয়ে সবজি বাগান তৈরী করার উদ্যোগে ব্যবসা করার লক্ষ্য নিয়ে এলাকায় কাজ শুরু করি। ২০১৭ সালে বিআরডিপি থেকে ১ মাসের দর্জি প্রশিক্ষণ নিয়ে বেকারদের মাঝে দল করে প্রশিক্ষণ দেই নিজে। ২০২১ সালে পুনরায় সুশীলন বয়স্ক স্কুলের সাথে কাজ করি। বর্তমানে বিভিন্ন পেশার সাথে জড়িত এবং আর্থিক দিক থেকে আমি অনেকটা সাবলম্বী। আমার পরিবার বর্তমানে অনেক সুখী এবং জনগন আলোর পথ চেনার অনেক সুযোগ পেয়েছি। আমার বিশ্বাস নারী পুরুষ কোন ভেদাভেদ নেই। নারীরা ইচ্ছা করলে অনেক কিছু করতে পারে। তাই আমি নিজেকে একজন অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী মনে করি।
শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারীর নাম চন্দনা রানী মন্ডল। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ৭নং মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের চিত্ত রঞ্জন মন্ডলের কন্যা চন্দনা রানী মন্ডল। তার জীবনে চলার পথ ছিল অনেক কষ্টময়। মাত্র ৯ মাস বয়সে পিতৃহারা হন। মা অনেক কষ্টে দিন মুজুরের কাজ করে সংসার চালান। মা ছিল তার একমাত্র অবলম্বন। মা তার খুবই সামান্য উপার্জন দ্বারা মেয়েচির পড়াশুনার খরচ চালায়। চন্দনা রানী মন্ডল অনেক মেধাবী ছিল। সে ইং- ২০০২ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়। বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী হিসাবে সরকারি সহায়তায় তার পড়াশুনার জন্য অর্থের সংস্থান হয়। একইভাবে ইং ২০০৬ সালে অষ্টম শ্রেণিতে ও সে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি প্রাপ্ত হয়। এভাবে সে অভাবের সংসারে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে থাকে। সে ২০০৮ সালে ব্যবসায় শিক্ষার ছাত্রী হিসাবে এস.এস.সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে জিপিএ ৫.০০ পায়। এরই মধ্যে মা শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সংসার প্রায় অচলাবস্থায় হয়ে পড়ে। পড়াশুনার ব্যয় নির্ভাহ করনে না পারায় ইং ২০০৮ সালে জেলেখালি গ্রামের মোহনলাল মিস্ত্রীর মহাশয়ের পুত্র চন্দন মিস্ত্রীর সহি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা হয়। কিন্তু জীবনের এই উত্থান পতনের সন্ধিক্ষণেও সে হাল ছাড়েনি। বিয়ের পরেও পড়াশুনার প্রতি তার আগ্রহ একটুও কমেনি। স্বামীর অভাবের সংসারেও নানা প্রতিক‚লতার মধ্য দিয়ে ইং ২০১০ সালে এইচ.এস.সি পরীক্ষায় ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় সে আবারও জি.পিএ ৫.০০ পায়। এভাবে স্বামীর সংসার সামলে সে তার সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখে। ইং ২০১৪ সালে বি.বি.এ (ব্যবস্থাপনা) সম্পন্ন করে এবং প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। একই ভাবে ২০১৫ সালে প্রথম বিভাগে এম.বি.এ (ব্যবস্থাপনা) সম্পন্ন করে। বিয়ের পরে এভাবে দীর্ঘ ১০ বছর পড়াশুনা ও কঠিন সংগ্রামের পর অবশেষে ইং ২৭/০৯/২০১৮ তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়েল অধীনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হয়। বর্তমানে সে এক সন্তানের জননী। তার চাকুরী হতে প্রাপ্ত বেতনে স্বামী পুত্র নিয়ে একটি সুখী ও সুন্দর জীবন যাপন করছে। সে একজন আদর্শ শিক্ষক, আদর্শ জননী ও আদর্শ নাগরিক। সমাজের বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কর্মখান্ডে সে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সমাজের অবহেলিত, সুবিধা বঞ্চিত ও দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের কল্যাণে সে সদা তৎপর। সেদিক থেকে চন্দনা রানী নিঃসন্দেহে একজন আদর্শ অভিভাবক। নিজের ইচ্ছাশক্তি ও অক্লান্ত পরিশ্রেমের কারনে সে নিজেকে একজন শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী মনে করেন।
সফল জননী নারীর নাম শাহানারা খাতুন। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ১নং ভ‚রুলিয়া ইউনিয়নের নাগবাটি গ্রামে গ.ম. আল-মামুনের স্ত্রীর শাহানারা খাতুন। দরিদ্র পরিবারে জন্ম তার। সে যখন ৯ম শ্রেণিতে পড়ে তখন তার পিতা দারিদ্রতার কারনে বিবাহ দেয়। লেখাপড়া করার ইচ্ছা থাকলেও পরিবারের সিদ্ধান্তে তাকে বিবাহ করতে হয়। শাহানার খাতুন এর বিবাহ হয় একটি দারিদ্র পরিবারে। সেখানে তাকে অনেক প্রতিকুল অবস্থার মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে। সে নিজেও ছিলো থুবই অসহায়, বিবাহের পর একে একে সে ০৩টি সন্তানের জননী হন। কিন্তু তার স্বপ্ন ও আশা ছিলো খুবই বড়। তিনি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারলেও তার ইচ্ছা ও আশা ছিলো সে তার সন্তানদেরকে লেখাপড়া করিয়ে মনুষের মতো মানুষ করবে। তাই শিক্ষা অনুরাগী শাহানারা নিজে বেশি পড়ালেখা করতে না পরলেও তার সন্তানদেরকে মানুষের মতো মানুষ করেছেন। শাহানারা খাতুন সংসারে অভাব অনটন ছিল নিত্য সঙ্গী। তিনি ভাবলেন যে কিভাবে আমি আমার ছেলে মেয়েদেরকে পড়ালেখা করাব। তখন তিনি কাঁথা সেলাইয়ের কাজ শুরু করে ও বাড়ীতে হ*াস-মুরগী, গরু-ছাগল পালতে লাগলেন। আর ঔগুলো ছিলো সংসারের আয়ের একমাত্র উৎস। তার স্বামী গ্রাম্য ডাক্তারি করতেন। সেখান থেকে বেশি অর্থ উপার্জন হতো না কিন্তু সে অর্থ দিয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। তার প্রথম ছেলে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সাইন্সে এম.এ পাশ করে কুষ্টিয়া রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী করছে। ২য় ছেলে বরিশাল বি.এম কলেজ থেকে বি.এ অনার্স শেষ করে এম.এ অধ্যয়রনরত আছে। তার মেয়েটি ৮ম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। তিনি অনেক দুঃখ, কষ্ট সহ্য করে ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত করেছেন। যার কারণে তিনি একজন সফল জননী নারী হিসাবে সমাজের মানুষের কাছে গ্রহণ যোগ্যতা অর্জন করেছেন। সে মনে করে আমার সন্তান সততা ও নিষ্ঠার সাথে দেশের দায়িত্ব পালন করবেন এবং সুনাগরিক হিসাবে নিজেকে তুলে ধরবেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাবেন। সে তার সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে নিজেকে একজন সফল জননী নারী মনে করে।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন যে নারী তার নাম মোছাঃ সেলিনা আখতার। তিনি তার জীবন কাহিনীতে লিখেছেন- আমি মোছাঃ সেলিনা আখতার। মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম হয়। আমার বাবা একজন সামান্য কৃষক। মা একজন গৃহিনী। আমরা ৫ ভাই বোন। দুই ভাই ও তিন বোন। তিন বোনের মধ্য আমি বড়। বাবার অভাবের সংসারে আমাদের ৫ ভাই বোনের লেখা পড়ার চালাতে হিম সিম খেতে হতো। আমার মা-বাবা দুজনে সব সময় বাহিরে থাকতো জিবীকার সন্ধানে। তার কারনে পারিবারের কাজ-কাম আমাকে করতে হতো। এভাবে চলতে থাকে আমাদের জীবন ও লেখাপড়া। আমি যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি তখন আমার মেজো বোনের বিয়ে হয়ে যায়। এর পর আমি কলেজে ভর্তি হই। আমার বাবা গরীব থাকার কারনে আমি কোন প্রাইভেট পড়তে পারিনি। তার কারনে আমি দুইবার ফেল করি। তবুও আমি থেকে থাকিনি ২০০৮ সালে আমি এইচ.এস.সি পাশ করি তাপর বি.বিএ পাশ করি। এরপর ২০১০ সালে আমার বিয়ে হয়। বাবা মা যৌতুক হিসাবে কিছুই দিতে না পারায় বিয়ের তিন মাস যেতে না যোতেই আমার উপর নেমে আসে নির্যাতন। আমি শারীরিক দিক একটু খাটো ছিলাম তার কারনে আমাকে নানান কথা শুনতে হতো। তবুও আমি কিছু বলতাম না। মুখ বন্ধ করে সব সহ্য করছি বাবার আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে। বিয়ের এক বছর পর আমার নিজে পছন্দে একটা শাড়ি কিনেছিলাম। আমার স্বামী সেদিন বাড়ি ছিলো না। যখন স্বামী বাড়ি আসে আমি তখন শাড়িটা তাকে দেখায়। আমি কেন শাড়ি কিনলাম তার জন্য আমাকে প্রচন্ড মারধর করে। তবু আমি কোন কিছু বলেনি। সহ্য করছি সব নির্যাতন। এমনকি বাবার বাড়িতে ও কিছু বলতাম না। বিয়ের দুই বছর হয়ে গেল। আমি মা হতে চলেঠি সবাই অনেক খুশি ২০১২ সালে আমি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেই। সন্তানের বয়স যখন ছয় মাস কথন আমার উপর নেমে এলো অমানবিক নির্যাতন। একদিন রাতে আমার ছেলে খুব কান্না কাটি করে। তাতে আমার স্বামীর ঘুমাতে পারেনা। রাত যখন ১১.৩০ বাজে তখন আমাকে খুব মারপিট করে আমার শিশুটা কোলে থাকর কারনে আমি নিজেকে রক্ষা করতে পারিনি। আমার মাথায় এবং বাম চোখে অনেক জোরে আঘাত পায়। চোখ ফুলে যায় আমি নিস্তেজ হয়ে যায়। সকালে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। মাথায় প্রচুর আঘাতের কারনে আমি মাঝে মাঝে মানষিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি এবং বাম চোখে আজও কম দেখি। কেটে গেল আরও দুই বছর। এরপর আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এই নির্যাতনের বিভীষিকা থেকে আমাকে বের হতে হবে। ২০১৪ সালে আমি আমার দুই বছরের সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসি। কিছুদিন সবাই আমার সাথে খুব ভাল ব্যবহার করে। তারপর সবার কথা শুনে আমি বুঝতে পারলাম আমি তাদের চোখে বোঝা হয়ে গেছি। কারণ বাবার আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। আমি পরিকল্পনা করলাম ঢাকায় যাব কাজ করতে। আমার সন্তান রেখে আমি ঢাকায় চলে যাই। চোখে পানি আসতেছে একথা লিখতে যেয়ে। একদিকে কাজের কষ্ট অন্য দিকে সন্তানের কষ্ট। আমি নিজে থেকে খুব ভেঙ্গে পড়ি। তিন মাস পর আমি চলে আসি। তবুও আমি আর স্বামীর বাড়ী যাব না প্রতিজ্ঞা করলাম। এরপর যুব উন্নয়নে দুই বছর মেয়াদী একটা কাজ পাই। সেখানে দুই বছর কাজ করার পর আমার হাতে কিছু টাকা আসে। সেই টাকা দিয়ে আমার বাবার ভিটার এক সাইডে আমি একটা ঘর তৈরী করি এবং কিছু টাকা সন্তানের নামে রাখি। ২০১৭ সালে কাচ শেষ হয়ে যায় আমি বেকার হয়ে পড়ি। যে কাজ পাই সেই কাজ করতে থাকি। ২০১৭ সালের শেষে আমার তালক হয়ে যায়। কারণ আমি শ্বশুর বাড়ীতে না যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করি। ২০১৯ সালে আমি মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে দর্জি বিজ্ঞান প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি এবং সেলাই মেশিন কিনে কাজ শুরু করি সেলাইয়ের কাজ। এদিকে আমার একটা প্রকল্পে নাম হয় সেখানে ৩০জন সদস্য একটা সমিতি করতে হবে। ওই ৩০জন সদস্যর আমি হলাম লিডার। শুরু হলো আমার জীবনের নতুন দিগন্ত। সঞ্চয় জমা নেওয়া এবং ঋণ দেওয়া। গ্রামিণ সঞ্চয় ও ঋণ আমার সমিতির নাম হাওয়ালভাংগী ভিএসএলএ-৩। খুবই শিঘ্রই আমার সমিতির রেজিষ্ট্রেশন হবে। সেই সাথে ভিলেজ এজেন্ট হিসাবে কাজ করি। এবাবে চলতে থাকে আমার ব্যবসা ও সমিতি। ২০১৯ সালে আমি ২৯ শে নভেম্বর মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় হতে কিশোর কিশোরী ক্লাব স্থাপন প্রকল্পে আবৃত্তি শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পাই। বর্তমানে আমি ৪২নং নওয়াবেঁকী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আবৃত্তি শিক্ষক হিসাবে কাজ করছি। আমার ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। আলহামদুলিল্লাহ ছেলেকে নিয়ে অনেক ভাল আছি। আমি আর চার দেওয়ালের মধ্য বন্দি নই। পেয়েছি মুক্ত জীবন মুক্ত বাতাস। আমার জীবনের অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়ে আমি আলোর পথে আসছি। নারীদের কে আমি বলবো নির্যাতনের বিভীষিকা থেকে বেরিয়ে আসুন। জীবনটা এত সস্তা নয়। “ভেঙ্গে দাও নির্যাতনের কালো হাত, বজ্রকণ্ঠে করবো মোরা নির্যাতনের প্রতিবাদ”। তাই আমি নিজেকে নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা নারী মনে করি।
সমাজ উন্নয়নে অবদান রেখেছেন যে নারী তার নাম প্রতিমা রানী মিস্ত্রী। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের বৈচিত্রময় সুন্দরবণের কোলঘেঁষে শ্যামনগর থানার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডে জেলেখালী গ্রামের সঞ্জয় কুমার মিস্ত্রীর স্ত্রী প্রতিমা রানী মিস্ত্রী। জেলেখালী গ্রামে অবকাঠামো বলতে ১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১টি সরকারী প্রাইমারী স্কুল, ১টি ডিগ্রী কলেজ, ৩টি দূর্গা মন্দির, ২টি মসজিদ, ১টি পোষ্ট অফিস, ১টি পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র ও মাতৃসদন কেন্দ্র এবং প্রায় সাড়ে ৩কিলোমিটার রাস্তা আধা পাকা এমন একটি গ্রামে মাস করেন প্রতিমা রানী মিস্ত্রী। সে ১৯৯৪ সালে আনসার ভিডিপি’র ইউনিয়ন দলনেত্রী মনোনীত হন। কিন্তু তার পরিবার মধ্যবিত্ত হওয়ায় অনেক বাঁধা বিপত্তির সম্মূখীন হতে হয়। তারপরেও তিনি সকল বাঁধা পেরিয়ে এখন বিভিন্ন সরকারী বে-সরকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়ে সামাজিক উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ডের অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করছেন। বিশেষ করে নারীদের নেতৃত্ব দেওয়া ও নারীদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। এরই মধ্যে ২০১৪ সাল থেকে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর পরিচালিত “মরমী মহিলা উন্নয়ন সংগঠন” নিজেই পরিচালনা করে আসছেন। তিনি হাঁটিহাঁটি পা পা করে আজ নারীদের নিয়ে দল গঠন ও পুঁজি গঠন করে আইজএ ঋণের মাধ্যমে নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, সহিংসতা, ইভটিজিং বিষয়ে নারীদের সচেতন করা বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী দলিত, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, হিজড়াদের নিয়ে সামাজিকভাবে মর্যাদা দেওয়া ও স্কুলের ছেলে-মেয়েদের জন্য বিভিন্ন বিদেশী সংস্থার সাথে যুক্ত থেকে তাদের সহযোগিতা করেন। এছাড়াও তিনি শ্যামনগর থানার সকল বেসরকারী সংস্থার সাথে যুক্ত থেকে মরমী মহিলা উন্নয়ন সংগঠনটি সঠিক ভাবে পরিচালনা করেছেন। এই আস্তা ও বিশ্বাস তিনি অর্জন করতে পেরেছেন। সব মিলিয়ে প্রতিমা রানী মিস্ত্রী সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন।
শ্যামনগর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শারিদ বিন শফিক জানান, এক সময়ের সমাজের অসহায় নারী যারা কঠোর পরিশ্রমে আজ নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমরা তাদের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়িত ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক বিশেষ কর্মসূচীর আওতায় খুজে বের করে সম্মাননা প্রদান করেছি। এই সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে অনুপ্রেণিত হয়ে জীবন-জীবিকার মান উন্নত হয়ে তারা আরো এগিয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন।