
জিয়াউর রহমান শ্যামনগর থেকে: শ্যামনগরের উপকূলীয় অঞ্চলের নারীর অধিকার আদায়য়ের লক্ষ্যে এবং মানব কল্যানে ৫ জয়িতা’র জীবন সংগ্রামের গল্প। সংগ্রামী অপ্রতিরোধ্য নারীর প্রতীকী নাম জয়িতা। নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের মূর্ত প্রতীক জয়িতা। কেবল নিজের অদম্য ইচ্ছাকে সম্বল করে চরম প্রতিকূলতাকে জয় করে জয়িতারা তৃণমূল থেকে সবার অলক্ষ্যে সমাজে নিজের জন্য জায়গা করে নিয়েছেন। সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর এই জয়িতাদের খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিয়েছে। উদ্যোগটির নাম ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’। জয়িতাদের পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে ১.অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী; ২. শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী; ৩. সফল জননী নারী; ৪. নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন যে নারী; ৫. সমাজ উন্নয়নে অবদান রেখেছেন যে নারী। শ্যামনগর উপজেলায় জয়িতা বাছাই কাজটি পরিচালিত হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বাছাইয়ের কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পাঁচজন জয়িতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর মনে করে, জয়িতারা বাংলাদেশের বাতিঘর। জয়িতাদের দেখে অন্য নারীরা অনুপ্রাণিত হলে ঘরে ঘরে জয়িতা সৃষ্টি হবে। আর তা হলেই বাংলাদেশ তার গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।
অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারীর নাম আমিরন নেছা। সাহসী মনোবল আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি নারীকে উন্নয়নের শিখরে পৌছে দিতে পারে। তেমনই এক কঠোর পরিশ্রমী নারী আমিরন নেছা। নিজের ইচ্ছাশক্তি কে কাজে লাগিয়ে কঠোর পরিশ্রম আর নিজের বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জন করে রীতিমত তাক লাগিয়েছেন পুরো এলাকা জুড়ে। সাতক্ষীরার উপকুলীয় শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের পার্শ্বেখালি গ্রামের শাহিন ইসলামের স্ত্রী আমিরন নেছা। বিয়ের পরে হতদরিদ্র স্বামীর পরিবারের সংসারের হাল ধরতে হয় আমিরন নেছা কে। স্বামীর একার আয়ে সংসারের সকল খরচ সংকুলান হয় না। যে কারণে শ্বশুর বাড়ি আসার পর থেকে শুরু হয় আমিরুনের দৈনন্দিন মজুরি দেওয়া সহ বাইরের নানা বিধ কাজ। কখনো ঘেরের লোনা পানিতে সারাদিন কাজ করা, কখনো পুরুষ মানুষের সাথে পুকুরের মাটির কাজ করা, কখনো ঘেরের শামুক বেছে দেওয়া। এভাবে বিভিন্ন ধরনের দৈনন্দিন মজুরির কাজ করে সংসারের স্বামীর আয়ের সাথে পারিপারিক আয় বাড়াতে থাকেন তিনি। পরপর দুইটি পুত্র সন্তান জম্ম দেওয়ায় তাদের ৪ জনের সংসারের খরচ যোগানো খুব কস্ট হয়ে যাচ্ছিলো দুজনের। স্বামী সুন্দরবনের মাছ কাঁকড়া আহরণ করে আয় বাড়ালেও তাতে সংকুলান হচ্ছিল না এবং প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অসুখের সম্মুখিন হতে হয় তাদের। আমিরন নেছা মনে মনে কোন ছোট খাটো কাজ খুজছিলেন। কোন এক সময় তিনি দর্জির কাজ শিখেছিলেন কিন্তু সেলাই মেশিন ও অন্যান্য উপকরণের অভাবে কাজ করার সুযোগ হয়নি। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বারসিকের পরিবেশ প্রকল্পের কাজ শুরু হলে তিনি উক্ত প্রকল্পের সদস্য নির্বাচিত হন। সে সময় তিনি আয় বর্ধক কর্মকান্ড হিসেবে একটি সেলাই মেশিন ও কিছু বিভিন্ন রকমের সিট কাপড়ের সহায়তা পান। এর পর স্বপ্ন পূরনের লক্ষ্যে আমিরন নেছা কাজ শুরু করেন। বাড়ীর আশে পাশের প্রতিবেশী ও পরিচিতজনদের সাথে নিজের দর্জি কাজের কথা বলতে থাকেন এবং দিন দিন তার পরিচিতি শুরু বাড়তে থাকে। নিজের এলাকার প্রতিবেশিদের ছোটখাট অর্ডার আসতে থাকে। এভাবেই ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে কাজের পরিধি। এখন আর দিনমজুরী দেওয়া লাগে না। আমিরন নেছা এ বিষয়ে বলেন, “স্বামীর একার আয়ে বর্তমান সময়ে টিকে থাকা কষ্টকর, তাই সংসারের আয় বাড়ানোর জন্য সেলাই মেশিন এর কাজ ও সিটকাপড়ের ব্যবসা করে আয় করছি। বারসিক থেকে সেলাই মেশিন ও সিটকাপড়ের ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল সহযোগিতা নিয়ে আমার ব্যবসাটাকে ভালোভাবে চালু করতে পারছি। লাভের টাকা দিয়ে সংসারের প্রয়োজনীয় খরচ মিটিয়ে নিয়মিত সঞ্চয় জমা করি।” সপ্তাহ বা ১৫ দিন পর পর সীটকাপড় বিক্রির টাকা একত্রিত করে পুনরায় মালামাল কিনে এনে ব্যবসাকে সমৃদ্ধি করে চলেছেন তিনি। এলাকার অধিকাংশ নারী ও শিশুদের পোশাক তৈরির জন্য প্রচুর পরিমানে অর্ডার আসে প্রতিদিন। যে কারণে তিনি একার পক্ষে সব কাজ সম্পন্ন করতে পারে না। সে কারণে তার সেলাই কাজে সহযোগিতা করার জন্য আলাদা ভাবে দুইজন কর্মী নিযুক্ত করেছেন। আমিরন নেছার কাজের বিস্তৃতির আরো একটি মূল কারণ হল তার কাছে নানা ধরনের সীটকাপড় রয়েছে। বাজারের দামেই সীট কাপড় পাওয়া যায় সেজন্য লোকজন তার কাছ থেকে সীট কাপড় ক্রয় করেন। তাছাড়া তার হাতের কাজের কোয়ালিটি খুব ভালো এবং নতুন নতুন ডিজাইনের পোশাক তৈরী করতে পারায় সর্বদা কাজের ভিড় লেগে থাকে। নিজের বাড়ীতেই সীটকাপড় এর দোকান ও সেলাই মেশিন এর কাজ করে সম্মৃতি পেয়েছেন আমিরন নেছা। তিনি এলাকার আরো ৩/৪ জন নারীকে কাজের সুযোগ করতে পেরেছেন। এলকার ২/৩ তিন জন নারী প্রতিদিন এখানে এসে কাজ করেন। প্রতি মাসে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা আয় করতে পারছেন বলে তিনি জানান। লাভের টাকা দিয়ে তিনি একটি ব্যাটারী চালিত ভ্যান কিনেছেন। বর্তমানে তার দোকানে প্রায় ২৫ হাজার টাকার সীটকাপড় রয়েছে। তিনি এখন স্বপ্ন দেখছেন ছোট ছেলেকে লেখাপড়া শিখানো পাশাপাশি তার স্বামীকে একটি ইঞ্জিন চালিত ভ্যান কিনে দেবেন। পরে নিজের দোকান ও বসত ঘরটাকে পাকা করবেন। আর্থিকভাবে সাবলম্বী আমিরন নেছা এলাকার একজন উদ্যোগী নারী হিসেবে সুপরিচিত। তার সফলতার গল্প নারী সমাজকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করবে। যা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন তরান্বিত হবে।
শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারীর নাম আছমা খাতুন। তিনি তার জীবন কাহিনীতে লিখেছেন, ইতি পূর্বে আমার জীবন কাহিনী কেউ কোন দিন শুনতে চাইনি। তোমরা যখন শুনতে চাচ্ছো তবে বসে শোন। আমার জন্মস্থান সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ থানার শেষ প্রান্তে দত্তনগর গ্রামে নাম আছমা খাতুন। আমার পিতার নাম মৃত ছকিমুদ্দীন গাজী। আব্বা একজন সুশিক্ষিত মানুষ ছিলেন। আমার আম্মার নাম মৃত জয়গুন বিবি। তিনি একজন সৎ ও আদর্শবতী। আমরা আট ভাই বোন। দুইজন ভাই ও ছয় জন বোন। এই আট ভাই বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। আমি সবার ছোট বলে আব্বা-আম্মা ভাই বোনেরা সবাই আমাকে ভালোবাসতো। বড় ভাই বোনেরা যখন স্কুলে যেতেন তখন আমি স্কুলে যাওয়ার জন্য কান্না শুরু করতাম। আমরা কান্না আব্বা আম্মা না সহ্য করতে পেয়ে মাত্র চার বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। বড় ভাই বোনদের সাথে যথন স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম তখন স্কুলের স্যারেরা খুব আদর যত্ন করতেন। আমাদের বাড়ীর পাশে একটা প্রাইমারী স্কুল তৈরী হল। আমার তখন সাত বছর বয়স তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। নতুন স্কুলে লেখাপড়ার মান ভালো ছিল না। বিধায় ১৭নং নূরনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার ছোট ভাই চতুর্ত শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। সেখান থেকে ৫ম শ্রেণি কৃতিত্বের সাথে শেষ করে নূরনগর আশলতা বহুমুখী হাইস্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়লাম সেখানে। তারপর আমার আব্বার আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেল। ছোট ভাইটা তখন এইচ এস সি পড়তো। দুই ভাই বোনের পড়ালেখার খরচ জোগাতে আব্বা আম্মার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার পড়া এখানে একেবারে শেষ হয়ে গেল। সেখান থেকে কিছুদিন পর আমাকে বিয়ে দিলেন। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ীতে খুব একটা কষ্টের মধ্যে দিয়ে জীবন যাপন করতাম। কিন্তু হঠাৎ করে আমার স্বামী অসুস্থ্য হয়ে যায়। সেই অসুস্থতার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে তিনি মারা যান। কিন্তু ভাগ্যের নির্মন পরিহাসসেখানে কিছুদিন থাকার পর আমার ভাই আমাকে নিয়ে আসে। মনের দুঃখ কষ্ট সব মনে, আমার আব্বা আম্মাকে বললাম আমি আবার লেখা পড়া করব। ভাগ্য কেহ কারো গড়ে দিতে পারে না। নিজের নিজে গড়ে নিতে হয়। তাই শুনে আব্বা আমাকে আমার নবম শ্রেণিতে ভর্তি করে দিলেন। তখন ছিল ১৯৮৮ সাল। ১৯৮৮ সালে একটা ভয়াবহ ঝড় হয়েছিল। তার নাম হ্যারিকেন ঝড়। ১৯৮৯ যখন নবম শেুণিতে ভর্তি করে দিলেন তখন আমি স্কুলে যেতে লজ্জা পাচ্ছি। শুনে স্কুলের স্যারেরা এসে আমাকে নিয়ে গেলেন। সেখান থেকে পড়ালেখা করে ১৯৯১ সালে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে এসএসসি দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করি। আমি যখন এসএসসি পাশ করেছি তখন ছোট ভাই খুলনায় পড়ালেখা করত। তারপর আমার ছোট ভাই বললো খুলনায় ভর্তি হওয়ার কথা। সেই কথা শুনে আমার আব্বার সাথে করে নিয়ে খুলনা এম,এ মজিদ কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। দুই বছর পড়ালেখা করার পর ১৯৯৩ সালে এইচএসসি বিজ্ঞান বিভাগে দ্বিতীয় বিভাগে উর্ত্তীর্ণ হই। সেখান থেকে বাড়ী এসে দেখি আমার আব্বা থুবই অসুস্থ্য। আব্বার অসুস্থতা দেখে আর খুলনায় যেতে পারলাম না। তাছাড়া পড়া লেখার খরচ বহন করা খুবই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। তখন আমি কিছু মেয়ে/ছেলেদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করলাম। আমি তখন শ্যামনগর মহাসিন ডিগ্রি কলেজ বিএ ভর্তি হয়ে পড়া লেখা চালু করলাম। বিএ পরীক্ষার পর একটা পত্রিকায় দেখলাম প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ করবে। ছোটবেলা থেকে আমার খুবই ইচ্ছা ছিল যে আমি প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার হবো। পত্রিকা দেখে দরখাস্ত দিলাম। তখন বিএ পরীক্ষার প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা শেষ হলো। তরপর পরীক্ষা দিলাম। তারপর ১৯৯৬ সালে চাকুরী হয়ে গেল। তার কিছুদিন পর জানতে পারলাম আমি বিএ পাশ করেছি। চাকুরী করতে করতে আমার চিঠি আসলো পিটিআই পড়তে হবে। তখন জানতাম একটা ট্রেনিং। ১৯৯৭ সালের ১লা জুলাই চলে গেলাম। দীর্ঘ এক বৎসর পর আবার স্কুলে যোগ দিলাম। এভাবে চাকুরী করতে করতে ২০০০ সালে আমার বিয়ে হয়। খুব কস্টের মধ্যে দিয়ে দিন যায়। তারপর ২০০৩ সালে একটা কন্যা সন্তানের জননী হই। মেয়েটার নাম আলফুন্নাহার সাথী। সেখান থেকে ২০০৫ সালে একটা পুত্র সন্তানের জননী হই। নাম- মোঃ আজহার উদ্দীন। দুৎজনই পড়ালেখা করে। বর্তমানে মেয়েটা খুলনা বিএল কলেজে বাংলা অনার্স ২য় বর্ষে আর ছেলেটা ফাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রার্ণী বিদ্যা ১ম বর্ষে পড়ালেখা করছে। বর্তমানে আমি ১৩২ নং মধ্য কৈখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত আছি। পরিশেষে বলাযায় পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসুতি। পরিশ্রম করে জীবনের উপর যুদ্ধ করে সব কিছু করেছি। চাকুরির উপর সন্তানদের পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছি। অতএব, এক কথায় সন্তান পরিজন ও সাংসারিক দায়িত্ব পালন করে খুব সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করছি। এটাই আমার গর্বের পরিচয়। নিজের ইচ্ছাশক্তি ও অক্লান্ত পরিশ্রেমের কারনে আমি নিজেকে শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে একজন সাফল্য অর্জনকারী নারী মনে করি।
সফল জননী নারীর নাম অনিমা হালদার। তিনি তার জীবন কাহিনীতে লিখেছেন, আমি অনিমা হালদার, স্বামী – মৃত পূর্ণচন্দ্র মালো, মাতা- শেফালী রায়, গ্রাম- নকিপুর, উপজেলা – শ্যামনগর, জেলা- সাতক্ষীরা। আমি শ্যামনগর পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের নকিপুর গ্রামের একজন স্থায়ী বাসিন্দা। আমার প্রাপ্ত বয়সে আমার পিতা আমাকে বিবাহ দেন। আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্বামীর সংসারে পরিবার পরিজন নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করিতে থাকি। আমার সংসার জীবনে ৪ জন সন্তানের জননী হই। আমার শান্তিপূর্ণ সংসার জীবন চলাকালীন সময়ের একপর্যায়ে আমার স্বামী দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং ১৯৯৮ সালে তিনি পরোলোকগমণ করেন। এরপর আমি আমার সন্তানদের নিয়ে চরম আর্থিক সংকটে পড়ি। আমি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ও সন্তানদের মানুষের মত মানুষ করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। এমতাবস্থায় স্বামীর রেখে যাওয়া একখন্ড জমিতে ফসল ফলিয়ে এবং গরু পালন করে জিবীকা নির্বাহ করতে শুরু করি। বর্তমানে আমার বড় মেয়ে বি,এল কলেজ খুলনা থেকে এম, এস, এস শেষ করে ৭৫নং নকিপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা, বড় ছেলে বুয়েট ঢাকা থেকে এম,এস,সি শেষ করে প্রিন্সিপাল অফিসার (বি. আই. এফ. এফ. এল) এর অধীনে, ছোট ছেলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ থেকে এম, এস শেষ করে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ (টেকনিক্যাল মার্কেট ডেভোলেপমেন্ট সিনজেনটা বাংলাদেশ লিমিটেড) এর অধীনে এবং ছোট মেয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম, এস, সি শেষ করে প্রভাষক (ইমপেরিয়াল কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং, খুলনা) এর অধীনে কর্মরত আছে। তিনি তার সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে নিজেকে একজন সফল জননী নারী মনে করেন।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন যে নারী তার নাম মারুফা খাতুন। তিনি তার জীবন কাহিনীতে লিখেছেন, আমার নাম মারুফা খাতুন, পিতা- ইশার আলী গাজী, মাতা- জবেদা খাতুন, গ্রাম- কলবাড়ী, উপজেলা- শ্যামনগর, জেলা- সাতক্ষীরা। আমার জীবনকাহিনী লিখেছি মনের কষ্ট প্রকাশ করার জন্য এবং জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য। আমার জীবন কাহিনী লিখতে গিয়ে আমাকে ভিতর থেকে সাড়া দেয় বেদনার দুঃখ এবং কষ্টের। এ কষ্টের কাহিনী লিখে কখনো শেষ করা যাবেনা। তবে কিছু বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আমি যখন শিশু শ্রেণীতে পড়ি তখন আমার বাবা আমাদের দুই বোন আর এক ভাই সহ আমার মাকে সারাজীবনের জন্য পর করে দিয়ে আরেকটি সংসার শুরু করেন। মা ছিল যুবতী ঠিক এই সময়ে সংসার ছাড়া, স্বামী ছাড়া,, গৃহহীন তিন সন্তানের ঠাই হয়েছিল একটি গাছের তলায়। উপরে রোদ, বৃষ্টি, পায়ের তলায় ছিল মাটি, পাশে ছিল বনজঙ্গল বাঘ ভাল্লুকের ভয়। আত্মীয় পরিজন পরিচয় দিতে চায়নি। অনাহারে দিন কেটেছে আমাদের। এভাবে ১টি বছর পার হল কিন্তু অনেকগুলো ছোট বাচ্চা দেখে কেউ কাজেও নেয়নি আমার মাকে। বস্ত্রহীন, আহার অভাবে মানুষের দ্বারে মা হাত পেতে কোনমতে খেয়ে না খেয়ে কেটেছে একটি বছর। তারপর আল্লাহর কাছে আমাদের আরজি কবুল হয়। একটি কাজের সন্থান মেলে মায়ের। বর্তমানে সেটা এনজিএফ হিসেবে পরিচিত নওয়াবেঁকী গণমূখী ফাউন্ডেশন। কোনমতে খাবারের চাহিদাটা এখানে থেকে মিলে কিন্তু বস্ত্র আর বাসস্থান মিলেনি তখনো। দীর্ঘদিন এনজিএফ কাজে যাওয়া আসার পথে পরিচয় হয় এক সরকারি কর্মকর্তার। তিনি আমাদের সঠিক পরিচয় জানতে পেরে আমাদের কাহিনী শুনে চোখে পানি ধরে রাখতে পারেননি। এই স্বহৃদয়বান সরকারি কর্মকর্তা আমাদের জন্য একটি সরকারি বাসভবনের ব্যবস্থা করেন, কলবাড়ী আশ্রয়ন প্রকল্প নামে পরিচিত বর্তমানে। তখন থেকে মা এনজিএফ এ রান্নার কাজ করতে থাকে আর আমাদের নিয়ে আশ্রয়ন প্রকল্পে রাতযাপন করে থাকেন। এভাবে অনেক ত্যাগ তীতিক্ষার পর আস্তে আস্তে বড় হতে থাকি। তখন মায়ের বেতন ছিল ৪শত টাকা ২০০১ সালের ঘটনা অনুযায়ী। আমি ছিলাম ভাইবোনদের মথ্যে বড়। মা রান্নার কাজে গেলে ছোট ভাইবোনদের সামলাতে হতো অনেক ভাইবোন থাকায় কেউ আমাদের ধকল নিতে রাজি ছিলেন না। ভাইবোনদের মাছে খেলতে দিয়ে মাকে কাজে সহযোগিতা করতাম এবং প্রতিদিন স্কুলে যেতাম। পাশাপাশি লেখাপড়ার খরচ যোগাতে হঁসামুরগী ও ছাগল পালন করতাম। মায়ের বেতন টাকায় সংসার চলতোনা। মায়ের ভাত ভাগ করে খেতাম এবং ভাতের মাড় খেয়ে অন্যের বাদ দেওয়া পোষাক ব্যবহার করতাম। স্কুলের ফরমফিলাপ বাই, খাতা শ্রেণি কক্ষের ছাত্রছাত্রীরা এবং শিক্ষকের সহযোগিতা নিয়ে প্রাইমারীতে ফাস্ট ক্লাস পেয়ে উর্ত্তীর্ণ হলাম। তখন খুব খুশিতে আত্মহারা হয়েছিলাম। পড়ালেখায় খুবই মনোযোগী হয়েচিলাম আরো। কিন্তু মা বিয়ে দেওয়ার জন্য মনস্থির করেছি। তখনকার সময় ১২ তে বিয়ে হতো মেয়দের। এলাকার মানুষ তখন থেকে ভাল পাত্র নিয়ে আসতো। কিন্তু আমি রাজি ছিলমান না। পড়ালেখায় আগ্রহী ছিলাম। মাকে বুঝায়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। তখন থেকে উপবৃত্তির টাকা আর ছাগল পালনের টাকা দিয়ে লেখাপড়া আর সংসার চলতো আমাদের। অনেকদূরে মাদ্রাসা শিক্ষায় ভর্তি হওয়ায় ভোরে উঠেই নামাজ পড়ে মাকে সব কাজ গুছিয়ে ভাই বোন নিরাপদে রেখে সকাল ৭টায় মাদ্রাসায় পাইভেট পড়ার জন্য যেতে হতো। ফিরে এসে আবার ভাইবোনদের খেয়াল রাখা এবং মায়ের কাজে সহযোগিতা করতাম। এভাবে ৮ম শ্রেণীতে আবারো ফাস্টক্লাস পেলাম। পড়াঘুনায় আরো আগ্রহ হল এভাবে দাখিল এবং এইচএসসি পাশ করলাম ২০১৬ সালে। তারপর শ্যামনগর মহসিন ডিগ্রী কলেজে বাংলা বিষয় নিয়ে অনার্স ভর্তি হলাম। সুযোগ পেলাম একটা ছোট চাকরি শিক্ষিকা হিসেবে নবযাত্রা প্রকল্পের কোডেক প্রজেক্টে। চলতে থাকে আমার দীর্ঘদিনের কষ্টের দিনগুলো কাটিয়ে সুখের দিনে পরিণত হতে থাকলো। খুব হ্যাপি ছিলাম চাকরিটা পেয়ে। পাশা পাশি সেলাইয়ের কাজও শিখলাম। তখন নিজের খরচ চালাতে কষ্ট হতো না। মাকে সহযোগিতা করতাম। কিন্তু সেই সুখের দিনগুলো বেশিদিন দীর্ঘায়িত হয়নি। নেমে এলো আমার কষ্টের দ্বিতীয় অধ্যায়। বিয়ে করব না বলে ছোট বোনকে বিয়ে দিয়েছিল মা। কিন্তু ছোটবোন লেখাপড়া খুববেশি জানতো না। তবুও অভাবের সংসার ভাল ছিল। আমার গায়ের রং কালো হওয়ায় যোগ্যপাত্র আসেনি। এজন্য প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যোগ্যতা অর্জন করে বিয়ে করবো। কিন্তু শেখ রক্ষা হয়নি। ২০১৮ সালের মে মাসের ১০ তারিখ আমাকে যোগ্যপাত্রের পরিচয় দেখিয়ে মায়ের কথায় বিয়ের জন্য রাজি হয়ে সামাজিক ভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। বাঙালি মেয়ে হিসেবে স্বামীকে বিশ্বাস করে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু স্বামী আর শ্বশুর বাড়ির পরিবার আমার গায়ের রং পছন্দ নয় বলে সংসারের জিনিসপাত্র আর টাকা বাড়ি করেছিল ২লক্ষ টাকা। যা আমার মায়ের পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিল না। রেড়ে যায় আমার প্রতি শারীরিক, মানসিক নির্যাতন ও স্বামীর অবহেলা। আবার সেই ছোট বেলার পোষাক আর আহারের অভাব কষ্টের কথা মনে পড়ে গেল। তখন খেকেই চোখের পানি ছিল আমার পরিচয়। পাড়া প্রতিবেশীকে দিয়ে অপমান করাতো। কারো সাথে মিশতে বা কথা পর্যন্ত বলতে দিত না। আমাকে ঘরের ভিতরে জেলখানায় বন্দি আছি এমন মনে হতো। আমাকে বুঝতে চাইতোনা কেউ। গালি দিত মা ঝিয়ের জাক করে, বাড়ি নাই ঘর নাই, চরিত্রহীন নানানভাবে। এক পর্যায়ে আমাকে চাকরী আর পড়ালেখা থেকে বঞ্চিত করেছি। এভাবে তিনমাস অতিবাহিত হয়েগেল। আমাকে আমার মায়ের সাথেও কথা বলার সুযোগ দেয়নি। আমার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ীর লোকজন আমাকে বিভিন্ন ভাবে নির্যাতন করতে থাকে যৌতুকের টাকার জন্য। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর আমার গর্ভে ১টি কন্যা সন্তান আসে। সেখান থেকে আমার জীনব আরও দুর্বিস্ব করে তুলে তারা। আমাকে আরও শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতে শুরু করে এবং গর্ভের সন্তান নষ্ট করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। আমি সন্তান নষ্ট করতে অস্বীকার করায় আমাকে ডির্ভোর্স দিয়ে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা বলে। একদিন আমার স্বামী আমাকে আমার মায়ের কাছে রেখে কাজের জন্য বাইরে যাবে বলে ডিভোর্স পাটিয়ে দিল। আমি বিষয়টা গন্যমান্য ব্যক্তিদের পারামর্শ নিয়ে মেম্বারের মাধ্যমে পাশ্ববর্তী র্যাব ক্যাম্পে জানাই। তখন থেকে র্যাব বিষয়টি যাচাই করে দেখেন এবং সবকিছু সত্য প্রমাণিত হলে একটা দিন করে সমাধান করতে ডাকা হলে পুনরায় দেনমোহর বাড়িয়ে দিয়ে আমাকে আবারো শ্বশুর বাড়ি পাঠানো হলো। কিন্তু আগের তুলনায় অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়ে গেল। কন্যা সন্তান তারা নিবে না নষ্ট করতে চায় আর বলে ছেলে না হলে আবারো ডিভোর্স দিব। আমাকে আবার আমার মায়ের কাছে রাখা হল। আমার স্বামী রাতে আমাকে নেশার ঘোরে আমাকে অনেক বার ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। আম্মার কাছে এসে ডাক্তার দেখিয়ে কোনমতে ভাভ থাকি। এভাবে ছয়মাস পার হল। মায়ের কাছে এসেই আমি পড়ালেখা করি। শ্বশুর বাড়িতে আমাকে পড়তে বসা দেখলেই অপমান করে উপহাস করে কথা শুনাতো সবাই। কিন্তু থেমে নেই আমার পড়ালেখা। মায়ের কাছে রেখে গেলেই আমি অনার্স ১ম বর্ষের ফরমফিলাপ করে ফেলি এবং গর্ভে সন্তান নিয়ে পরীক্ষাও দেই এবং ফাস্ট ক্লাস পাই। আমার ২য় বর্ষের পড়া শুরু করি। এভাবে যখনই আমার স্বামী কাচের জন্য বাইরে যেতেন ঠিক তখনই আমার পরীক্ষার সময় আসতো বছর ঘুরতেই আমার কোল জুড়ে আসে অপরূপ সুন্দর একটা কন্যা সন্তান। যাকে নিয়ে আমি খুব খুশি। কিন্তু আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে কেউ আসলোনা কন্যা হওয়াতে এবং আমাকেও আর যেতে নিষেধ করেছে শ্বশুর বাড়িতে। কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। মেয়েরয়খন ৬মাস তখন আমার স্বামী আমার মেয়ে নিয়ে যাবে বলল আমি মেয়েকে দিলাম। শ্বশুর বাড়ির লোকজন মেয়ে আর বাবার মধ্যে মিল দেখে একটু আগ্রহ পোষন করল এবং এক পর্যায়ে আমাকে নিয়ে গেল। কিন্তু সেই আগের মতই ব্যবহার করতে লাগল। এভাবে দুই বছর কেটে গেল। একদির রাতে তার পরিবার মিলে আমাকে চিরদিনের জন্য পৃথিবী থেকে বিদায় দিবে বলে মারপিট করলো এবং চক্রান্ত করল আমার আর মেয়ের কান্না শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে আসলো কোনমতে রক্ষা হল কিন্তু সেই রাত আর যেন পোহায় না। এভাবে ৫দিন কেটে গেল। কিন্তু আমি আজ বেঁচে থাকব এই বিশ্বাস আর হয়ে উঠছিলনা। মায়ের মুখখানা দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ব্যাথার যন্ত্রণায় ছটফট করছি, তবুও ঘর থেকে বাইরে যেতে দেয়নি, কথা বলতে দেয়নি কারো সাথে। আমার মা স্বপ্ন দেখেছে আমি ভাল নেই ছোট ভাইকে আমাকে দেখতে পাঠায়। যেয়ে দেখে আমার অবস্থা ভাল নেই আমি কৌশল করে ভাইয়ের সাথে মায়ের কাছে চলে আসি এবং তখন আমার মনে হচ্ছে জান্নাত পেয়েছি। মা ডাক্তার দেখিয়ে আমাকে সুস্থ্য করে। তখন আমি প্রতিজ্ঞা করেছি এই কালো চেহারা নিয়ে আর তার সামনে যাবোনা তখন থেকে আমি আবার পড়ালেখা শুরু করি। আর তখন আমার পাশে এসে ছায়ার মত দাড়িয়েছে নবযাত্রা প্রকল্পের চাকুরী। মেয়েকে নিয়ে আজ অনেক হ্যাপি। আমার বন্ধু হয়ে নবযাত্রা পাশে থেকেছে আর আমার মনের অবস্থার পরিবর্তন করেছে। আমি যখন পড়ালেখার জীবন আর সংসার জীবনে ছিলাম কথা বলতে ভয় পেতাম আর নবযাত্রা আমাকে নতুন যাত্রার পথ দেখিয়েছেন এবং একটি পরিবারের সদস্যের যত শক্তি, সাহস আত্মসম্মান বোধ সহ নেতৃত্ব দিতে শিখিয়েছে। আমি এখন ১০০-১০০০ মানুষের সামনে দাড়িয়ে মানুষকে শিখাই নিজেকে নিজের মত বাঁচতে হবে। কারোর প্রতি নির্ভরশীল হওয়া যাবেনা। আমি মাস্টার্স শেষ করেছি। সমাজে এখন আমার আর সম্মানের অভাব নেই। প্রয়োজন পড়লে সবাই মারুফা আপাকে খুজে নেয়। চাকরী আমাকে দিতে চায় মানুষ। বিয়ের জন্য পাত্রেরও অভাব নাই। কিন্তু আমি আমার মেয়েকে নিয়েই বাকি সময় ভালভাবে কাটাতে চাই। পাশাপাশি আমি একটি সমবায় সমিতির নিবন্ধন পেয়েছি সমবায় অধিদপ্তর থেকে এবং আমি নিজেই সমিতি পরিচালনা করছি। এই সমিতির সদস্য সবাই নারী। আমরা সবাই পারি এই উদ্দেশ্যে আমরা নারীরা এখান থেকে উণ গ্রহণ করে আয়বর্ধক কাজ সহ হাতের কাজ করি। সাথে সমাজ উন্নয়ন মূলক কাজ করে যাচ্ছি। বিশেষ করে আমার সাথে ঘটে যাওয়া কাহিনী থেকে কীভাবে জীবনকে পরিবর্তন করেছি এটার শিক্ষা আমি বাকী নারীদের মধ্যে সঞ্চার করতে চাই। এবং এভাবে সমাজের পাশে থেকে সামাজকে পরিবর্তন করতে চাই। আমার কর্মের মধ্যে থেকে। তাই আমি নিজেকে নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা নারী মনে করি।
সমাজ উন্নয়নে অবদান রেখেছেন যে নারী তার নাম যমুনা রানী। নিজ প্রতিভা, আত্মশক্তি ও মেধাবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে সমাজ উন্নয়নের জন্য কাজ করতে পারা মানুষেরা স্থাপন করেন অনন্য দৃষ্টান্ত। এমনই একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী উপকুলীয় নারীযোদ্ধা যমুনা রানী। বাংলাদেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরার উপকুলীয় শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের যমুনা রানী সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখায় ইতিমধ্যে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছেন। স্বামী ও এক সন্তান সহ তিন সদস্যের ছোট্ট সংসার তার। স্বামী মনিন্দ্র সরদার (৩৬) পেশায় দিনমজুর। ছেলে সুজন (১০) ৫ম শ্রেণীতে পড়া লেখা করে। এলাকায় সমাজের নানা অসঙ্গতি বা সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড সেখানেই দেখা মেলে যমুনা’র। দরিদ্র ঘরের বধু হয়েও তেমন কোন আয়েশি জীবন জীবিকা প্রত্যাশা নেই তার। পারিপারিক ও সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা যে অবহেলিত ও পিছিয়ে আছেন তা যমুনা রানী বয়স ও বুদ্ধির সাথে সাথে অনুধাবন করতে থাকেন। তিনি মনে করেন পুরুষের পাশপাশি নারীরা সবক্ষেত্রে সম মর্যাদার দাবীদার। তিনি সমাজে নারীর অবস্থা ও অবস্থান সুদঢ় করার মনোভাব ও ইচ্ছা পোষন করেন। একজন সক্রিয় নেত্রী হিসেবে তিনি সমাজের উন্নয়ন কর্মকান্ডে তিনি নিজেকে সপে দেন। কোথাও রাস্তা সংস্কার, কোথায় ও বনায়ন সৃষ্টি, কোথাও পারিপারিক কলহ, কোথাও সামাজিক উৎসব এলাকার এ সকল কর্মকান্ডে সবার আগে দেখা মেলে সুপরিচিত যমুনার মুখ। মুখ ভরা হাসি নিয়ে হাজির যে কোন সমস্যা সমাধানে। নিজ এলাকার প্রতিবেশী থেকে শুরু করে সকল মানুষের জন্য সরকারী বেসরকারী সেবা আদায়ে স্থানীয় সরকার ও সুশীল সমাজের মানুষের মাঝে নিয়মিত যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপন করে দৃষ্টান্ত তৈরী করেছেন সদা হাস্যোজল নারী যমুনা। তার স্বামীও অনেক খুশি স্ত্রীর এই ধরনের পরের কল্যান মূলক কাজ করার জন্য। নারীনেত্রী হিসেবে তিনি সমাজের উন্নয়নে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি বাল্যবিবাহ নিরোধ, যৌতুক, মাদক, নারী ও শিশু নির্যাতন, প্রবীন অধিকার, কৃষি ও পুষ্টি নিরাপত্তা সহ বিভিন্ন ধরনের উঠানবৈঠক ও আলোচনার নেতৃত্ব দেন তিনি ৷ ২০২১ সালে অক্টোবর মাসে নেটজ পার্টনারশীপ ফর ডিভেলপমেন্ট জাস্টিস’র সহযোগিতায় বারসিকের বাস্তবায়নে পরিবেশ প্রকল্প শুরু হলে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বুড়িগোয়ালিনী গ্রামে ময়না সিএসও দলে যুক্ত হয়। ২০ জন নারী সদস্য নিয়ে পথ চলা দলের সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে সক্রিয় দায়িত্ব পালন করেন। বারসিক থেকে উৎপাদনশীল সম্পদ হিসেবে ২টি ছাগল ও ৬টি দেশী মুরগী সহযোগিতা পান। বুড়িগোয়ালিনী আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাস করা যমুনা রানী সরকারীভাবে পাওয়া মাত্র ৫ শতক জায়গাতে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শে বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় ফসল চাষাবাদ ও ছাগল, হাঁস- মুরগি পালন করে তার বাড়ীটিকে একটি মডেল বৈচিত্র্যময় মডেল কৃষি খামার গড়ে তুলে অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরী করেছেন। একদিকে সমৃদ্ধশীল ও বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ কৃষি খামার গড়ে তুলে সফলতা অর্জন করেছেন অপরদিকে মানবিক কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করে একজন খ্যাতিমান সমাজ সেবিকা হিসেবে এলাকায় সুপরিচিতি লাভ করেছেন ।
শ্যামনগর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শারিদ বিন শফিক জানান, এক সময়ের সমাজের অসহায় নারী যারা কঠোর পরিশ্রমে আজ নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমরা তাদের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়িত ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক বিশেষ কর্মসূচীর আওতায় খুজে বের করে সম্মাননা প্রদান করেছি। এই সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে অনুপ্রেণিত হয়ে জীবন-জীবিকার মান উন্নত হয়ে তারা আরো এগিয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন।