সিরাজুল ইসলাম,শ্যামনগর: মুজিব শত জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে আগামী ২৬শে মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আমন্ত্রণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশে আসছেন। এ সময় তিনি দেশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান পরিদর্শন করবেন। এর মধ্যে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর যশেশ্বরী মন্দির পরিদর্শন করবেন ২৭শে মার্চ। সেজন্য সব শ্রেণীর মানুষের মাঝে আনন্দ ও উল্লাসের বন্যা বইছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক নিরাপত্তা ও প্রস্তুতির পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ২৭শে মার্চ নরেন্দ্র মোদী ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার যোগে এসে নামবেন ঈশ্বরীপুর এ,সোবহান মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে। সেখান থেকে ১কিঃমিটার গাড়ী পথে যাবেন যশেশ্বরী মন্দিরে। নরেন্দ্র মোদীর শ্যামনগর সফর উপলক্ষ্যে এ,সোবহান মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে তৈরি হচ্ছে বিশাল আকৃতির হেলি প্যাড গাড়ী পার্কিংয়ের জন্য মন্দিরের পশ্চিম পার্শ্বে ফাঁকা করা হচ্ছে বড় ধরনের জায়গা। তাছাড়া নরেন্দ্র মোদীর সফর উপলক্ষ্যে এক্ষুনি মন্দিরের আশপাশ গোয়েন্দা নজরদারী ব্যাপক বাড়ানো হয়েছে। ৫১ শক্তিপীঠ : যশোরেশ্বরী কালী মন্দির সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর গ্রামে অবস্থিত যশোরেশ্বরী কালী মন্দির। যশোরেশ্বরী নামের অর্থ “যশোরের দেবী”। সনাতনীদের জন্য এটি একটি পবিত্র তীর্থস্থান।
অর্থাৎ যশোরে সতীর পাণিপদ্ম বা করকমল পড়েছে। দেবীর নাম যশোরেশ্বরী। এই সতীপীঠে কায়মনোবাক্যে পুজো করলে ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ হয বলে সর্বসাধারণের বিশ্বাস।
মন্দির-বেদির ওপর প্রতিষ্ঠিত মাতৃমূর্তির শুধু মুখমন্ডল দৃষ্টিগোচর হয়। শ্রীযশোরেশ্বরীর কণ্ঠের নিচে তার শ্রীহস্ত ও শ্রীচরণ কিছুই নজরে পড়ে না। মূর্তির অবয়ব পুরোটাই মুখমন্ডলে আবৃত। মায়ের মাথার ওপর টকটকে লাল রঙের চাঁদোয়া। কণ্ঠে রক্তজবার মালা ও নানা অলংকার। মাথায় সোনার মুকুট। লোলজিহ্বা দেবীর ভীষণা মূর্তি। মালদার জাগ্রত জহুরা কালীমাতার মুখমন্ডলের সঙ্গে কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে যশোরেশ্বরীর। যশোরেশ্বরী মাতা ভীষণদর্শন হলেও মায়ের শ্রীবদনে কী অপূর্ব দেবীভাব। ভক্তের পরম আশ্রয়ের শেষ কথা যেন তিনিই।
ধারনা করা হয় যে, মন্দিরটি আনারি নামের এক ব্রাহ্মণ কর্তৃক নির্মিত হয়। তিনি এই যশোরেশ্বরী শক্তিপীঠের ১০০টি দরজা নির্মাণ করেন। কিন্তু মন্দিরটি কখন নির্মিত হয় তা জানা যায়নি। পরবর্তীকালে লক্ষণ সেন ও প্রতাপাদিত্য কর্তৃক তাদের রাজত্বকালে এটির সংস্কার করা হয়েছিল। কথায় আছে যে মহারাজা প্রতাপাদিত্যের সেনাপতি এখানকার জঙ্গল থেকে একটি অলৌকিক আলোর রেখা বের হয়ে মানুষের হাতুর তালুর আকারের একটি পাথরখন্ডের উপর পড়তে দেখেন। পরবর্তীতে প্রতাপাদিত্য কালীর পূজা করতে আরম্ভ করেন এবং এই কালী মন্দিরটি নির্মাণ করেন। যশোরেশ্বরী কালী দর্শনের নাম করে সেনাপতি মান সিংহ প্রতাপাদিত্যের দুর্গের নকশা নিয়ে যান। পরে আক্রমণ করে মোগলরা সেটি জয়লাভও করে। কালীর বিগ্রহের সঙ্গে প্রতাপাদিত্য এবং তাঁর সেনাপতি ও পরামশর্দাতা শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়কে বন্দি করেন মান সিংহ। জমিদার বাড়ির মধ্যে অবস্থিত ছিল। তৎকালিন জমিদার বাবু মায়ের নামে প্রায় ২০০ বিঘা জমি দান করেছিলেন। কিন্তু আজ প্রভাবশালী ভুমিদস্যুরা জাল দলিল সৃষ্টি করে মায়ের মন্দিরের সব জমি দখল করে ভোগদখল করছে। আজ মায়ের মন্দিরের ইটের দেওয়াল খসে পড়েছে।
মায়ের পুজোয় সমবেত ভক্তগণ ফুল, ফল ও নানাধরনের মিষ্টি আনেন। মাতৃমূর্তির সামনে সুন্দর করে কাঁসার থালা ও মাটির পাত্রে থরে থরে নৈবেদ্য সাজানো হয়। শ্রীযশোরেশ্বরীর পুজো তন্ত্রমতেও হয়।প্রতিবছর মন্দিরে খুব ধুমধাম করে শ্যামাপুজো হয়। মা ভীষণ জাগ্রত। শ্যামাপুজোয় এই মন্দিরে হাজার হাজার ভক্ত পুজো দেন। মানত করেন। বড় করে হোমযজ্ঞ হয়। মাকে নানা অলংকারে সাজানো হয়। মন্দিরের সামনে তিনদিন মেলা বসে। ছাগবলি হয়। মন্দিরের বারান্দায় হিন্দু ভক্তদের পাশাপাশি মুসলমান ভদ্রমহিলারা ও মাকে ভীষণ মান্যি করে। মানত করতে আসে। মানত পূরণ হলে এক জোড়া পায়রা মন্দিরের বারান্দা থেকে উড়িয়ে দেওয়া হয়।
মূল মন্দির সংলগ্ন স্থানে নাটমন্দির নামে একটি বৃহৎ মঞ্চমন্ডপ নির্মাণ করা হয়েছিল যেখান হতে দেবীর মুখমন্ডল দেখা যায়। এটি লক্ষণ সেন বা মহারাজা প্রতাপাদিত্য কর্তৃক ত্রয়োাদশ শতাব্দীতে নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু কারা এটি নির্মাণ করেছিল তা জানা যায়নি। ১৯৭১ সালের পর এটি ভেঙে পড়ে। সেই সুদৃশ্য, লম্বা-চওড়া বিরাট নাটমন্দিরের আজ কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই। এখন শুধুমাত্র স্তম্ভগুলি দেখা যায়। দু-একটা স্তম্ভ কয়েককশো বছরের নীরব সাক্ষী হয়ে ইটের পাঁজর বের করে দাঁড়িয়ে আছে কোনওরকমে। একদা মন্দিরের চারদিকে সুউচ্চ প্রাচীর ছিল। মূল মন্দিরটি বাদে আর সবকিছুই আজ কালের গর্ভে বিলীন। মন্দিরের নওবতখানা এখন ভগ্নস্তম্ভ। শ্রীযশোরেশ্বরী মন্দিরের যত শীঘ্র সম্ভব আমূল সংস্কার প্রয়োজন।