স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বলতে আমরা মূলত: বুঝে থাকি ১০ ই জানুয়ারী ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশর মাটিতে প্রত্যাবর্তন করা। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙালি জাতির জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কিন্তু বাংলার মানুষের কাছে ১৭ ই মে গৌরবোজ্জ্বল আরেকটি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসাবে পরিচিত। ১৭ই মে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভাপতি, বিশ্ব মানবতার নেত্রী, বাংলার মানুষের আশা ভরসার শেষ বাতিঘর, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। দীর্ঘ ৬ বছর নির্বাসিত জীবন শেষে১৯৮১ সালের এই দিনে তিনি বাংলার মাটিতে পা রাখেন। এ দিন তাকে বহনকারী বিমানটি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লী থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকা কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে নামলে লক্ষ লক্ষ জনতা -
'শেখ হাসিনা তোমার ভয় নাই
আমরা আছি তোমার সাথে'
স্লোগানের মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানায়।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ সময় তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রবাসে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।
১৯৮১ সালের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঐ দিনটি ছিল রোববার। (২০২০ সালের ১৭ই মে অর্থাৎ আজকের দিনটিও রোববার।) সারাদেশ থেকে আসা লাখো জনতা সেদিন বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানায়। বাঙালির হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসায় সিক্ত হন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।
সে দিন বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে তাকে এক নজর দেখার জন্য বিমানবন্দর থেকে শেরে বাংলানগর পর্যন্ত লাখো জনতার ঢল নামে।
সেদিন কালো মেঘের তর্জন -গর্জন, বিক্ষুব্ধ প্রকৃতি যেন বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার পক্ষে গর্জে উঠেছিল। আর অবিরাম মুষলধারে বর্ষণে যেন বাংলার মাটি থেকে সব গ্লানি মুছে সাফ করে তাদের প্রিয় নেত্রীকে সেদিন বরণ করে নিয়েছিল।
ঝড়-বাদল আর লক্ষ জনতার আনন্দাশ্রুতে অবগাহন করে শেরেবাংলা নগরে লাখো জনতার সংবর্ধনার জবাবে সেদিন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, "সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, পিতার নির্দেশিত পথে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিশোধ নিতে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।
তিনি বলেন, আমার হারাবার কিছুই নেই। বাবা, মা, ছোট ভাই রাসেল সহ সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই। আপনাদের নিয়েই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোঁটাতে চাই। বাঙালী জাতির আর্থসামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি আনতে চাই।"
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফেরার আগেই ঐ বছরের (১৯৮১ সালের) ১৪,১৫ ও ১৬ই ফেব্রুয়ারি ঢাকার হোটেল 'ইডেনে' অনুষ্ঠিত আওয়ামীলীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাকে সর্বসম্মতিক্রমে আওয়ামীলীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও বিচক্ষণতায় বাংলাদেশ আজ মহাকাশে। সমুদ্র বিজয়, সীমান্ত বিজয়, বিশ্বমানবতার মুকুট বিজয়ের পর মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ। এই বাংলাদেশ আজ বিশ্বে নতুন বিস্ময়ের নাম।
দেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু এখন দৃশ্যমান। জনকল্যাণমুখী কার্যক্রমে দেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে দূর্বার গতিতে।
তারই নেতৃত্বে দেশে প্রবৃদ্ধি অর্জনসহ মাথাপিছু আয় বাড়ছে, কমছে দারিদ্র্যের হার। দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে তিনি 'ভিশন ২০২১' ও 'ভিশন ২০৪১' কর্মসূচী ঘোষণা করছেন। গ্রহন করেছেন 'ডেল্টাপ্ল্যান ২১০০'। গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও জনকল্যাণে শেখ হাসিনার এসব যুগান্তকারী কর্মসূচী বাংলার মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
কিন্তু সেই ১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পথ একবারেই মসৃণ ছিল না। নানা ঘাত -প্রতিঘাত পেরিয়ে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে তাকে।
বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রোকেয়া প্রাচী তার এক নিবন্ধে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবন তুলে ধরেন এভাবে,
'একবার নয়, দুইবার নয় শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। কখনও নিজ বাসবভনে, কখনও জনসভায়, আবার কখনও গাড়ী বহরে, ক্ষমতায় যাতে শেখ হাসিনা কোনোভাবেই যেতে না পারেন। ষড়যন্ত্রের গোপন জাল বিছিয়েছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা ছিল'।
গোটা আশির দশকে স্বৈরচার বিরোধী আন্দোলন হয়েছে তার নেতৃত্বে। কিন্তু আন্দোলনের কোনো ফসলই ঘরে তুলতে দেয়নি নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীরা। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পরাজয়। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামীলীগ সর্বচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার পরেও এ পরাজয় অপ্রত্যাশিত ছিল।
কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে ১৯৯৪-১৯৯৬ সালে বি.এন.পি বিরোধী তীব্র আন্দোলন শুরু করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তার আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১২ই জুন১৯৯৬ সালের সাধারন নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে নির্বাচিত হয় এবং ২৩ জুন ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।
এরপরের ইতিহাস সবারই জানা। দেশ ও জনগনের কল্যাণে অভূতপূর্ব অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ দেশের মানুষ তাকে পর পর টানা তিনবার সহ মোট চারবার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত করেছেন। তারই বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশ আজ উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলেছে দূর্বার গতিতে।
বাংলার মানুষ মনে প্রাণে বিশ্বাস করে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ অচিরেই বঙ্গবন্ধুর সপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, হাজী কেয়ামুদ্দীন মেমোরিয়াল মহিলা কলেজ, সাতক্ষীরা।