
আহাদুর রহমান: কলারোয়ায় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা মামলায় সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুল ইসলাম হাবিবসহ ৫০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) আলোচিত এ মামলায় জেল হাজতে থাকা ৩৪ জন আসামির উপস্থিতিতে রায় ঘোষণা করেন, সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিম মো. হুমায়ুন কবীর।
এ মামলার আসামীদের মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুল ইসলাম হাবিব, আরিফুর রহমান ও রিপনকে ১০ বছরের কারাদন্ড, কলারোয়া উপজেলা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের বাচ্চুকে নয় বছরের এবং বাকি ৪৬ জনকে ২ থেকে ৭ বছর মেয়াদের কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে।
রায় ঘোষণার সময় ৩৪ জন আসামি আদালতে হাজির ছিলেন। তারা হলেন সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুল ইসলাম হাবিব, আশরাফ হোসেন, নজরুল ইসলাম, মো. আবদুর রাজ্জাক, শেখ তামিম আজাদ মেরিন, মো. আবদুর রকিব মোল্ল্যা, মো. আক্তারুল ইসলাম, মো. আবদুল মজিদ, মো. হাসান আলী, ময়না, মো. আবদুস সাত্তার, তোফাজ্জেল হোসেন সেন্টু, মো. জহুরুল ইসলাম, গোলাম রসুল, মো. আবদুস সাত্তার, আবদুস সামাদ, মো. আলতাফ হোসেন, শাহাবুদ্দিন, মো. সাহেব আলী, সিরাজুল ইসলাম, রকিব, শহীদুল, মো. মনিরুল ইসলাম, শেখ কামরুল ইসলাম, ইয়াছিন আলী, শেলী, শাহিনুর রহমান, দিদার মোড়ল, সোহাগ হোসেন, মাহাফুজুর মোল্লা, আবদুল গফফার গাজী, রিঙ্কু, মো. আবদুস সামাদ, টাইগার খোকন ওরফে বেড়ে খোকন।
পলাতক আছেন ১৬ জন। তারা হলেন আবদুল কাদের বাচ্চু, মফিজুল ইসলাম, মো. আলাউদ্দিন, খালেদ মঞ্জুর রোমেল, আরিফুর রহমান, রিপন, ইয়াছিন আলী, রবিউল ইসলাম, মাজাহারুল ইসলাম, আবদুল খালেক, আবদুর রব, সঞ্জু, নাজমুল হোসেন, জাবিদ রায়হান লাকী, কণক ও মো. মাহাফুজুর রহমান।
সরকার পক্ষে এ মামলা পরিচালনা করেন বাংলাদেশের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এসএম মুনীর, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জি, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সিরাজুল ইসলাম সিরাজ, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শাহিন মৃধা এবং সাতক্ষীরার পিপি অ্যাডভোকেট আবদুল লতিফ, অ্যাডভোকেট শহিদুল ইসলাম পিন্টু, অতিরিক্ত পিপি জি এম ওকালত হোসেন, অতিরিক্ত পিপি তামিম আহম্মেদ সোহাগ, এ্যাড আ,ক,ম, রেজওয়ান উল্লাহ সবুজ, এপিপি হুমায়ুন কবীর ।
আসামি পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, অ্যাডভোকেট শাহানারা আক্তার বকুল, অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ, অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান পিন্টু, অ্যাডভোকেট তোজাম্মেল হোসেন, অ্যাডভোকেট আবদুস সেলিম প্রমুখ।
সর্বোচ্চ ৪ বছর সাজাপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন যুগিখালির সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম, তুলশিডাঙ্গার জাভিদ রায়হান , ট্রলি শহিদুল ও মনিরুল ইসলাম, কলারোয়ার মো. ্্ইয়াসিন আলি, রায়টার মো. ্ইয়াসিন আলি ও ময়না, কয়লার আবদুস সাত্তার, শেলী, কনক, তুলশিডাঙ্গার টাইগার খোকন, রিপন, তুলশিডাঙ্গার আবদুল মজিদ, তুলশিডাঙ্গার খালেদ মঞ্জুর রোমেল ও রকিব, বহুরার তোফাজ্জেল হোসেন সেন্টু, শুভংকরকাটির মাজহারুল ইসলাম, কেড়াগাছির আবদুল মালেক, বাটরার আবদুর রব, শেখ কামরুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম, ক্ষেত্রপাড়ার বিদার হোসেন, গাজনার সোহাগ হোসেন , ঝিকরার মাহফুজ মোল্লা, ওফাপুরের মাহফুজুর রহমান, আরিফুর রহমান মঞ্জুু, ঝিকরার গোলাম রসুল ও রিংকু, সিংহলালের মো. শাহাবুদ্দিন, বৈদ্যপুরের সিরাজুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক, পুটুনির আবদুস সামাদ, গদখালির মফিজুল ইসলাম, হুলহুলিয়ার হাসান আলি,ময়না, দরবাসার জহুরুল ইসলাম, আবদুল মালেক,মাজহারুল হক, নজরুল ইসলাম, ইলিশপুরের মো. আলাউদ্দিন, কয়লার সাহেব আলি ও রামকৃষ্ণপুরের শাহিনুর রহমান ।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনির বলেন, ‘ঘটনার দিন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুল ইসলাম হাবিবের পরামর্শে ও নির্দেশে প্রায় চার-পাঁচশ নেতাকর্মী ও বিএনপির সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছিল। এই হামলার বিচার শুরু হয়েছিল, আজকে রায়ের মাধ্যমে তার পরিসমাপ্তি ঘটলো। সাতক্ষীরার জনগণ কলঙ্কমুক্ত হলো। আজকের রায়ে হাবিবুল ইসলাম হাবিব, আরিফ এবং রিপন এই তিন জনকে ১০ বছর পর্যন্ত সাজা দেওয়া হয়েছে। বাচ্চু এবং রঞ্জুকে ৯ বছর করে সাজা দিয়েছেন আদালত। সর্বনিম্ন সাড়ে চার বছর সাজা দেওয়া হয়েছে। অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। কাউকে খালাস দেওয়া হয়নি।’
তবে আসামি পক্ষের আইনজীবী শাহানারা পারভিন বকুল বলেন, ‘আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। এই রায়ে সন্তুষ্ট হবো কিভাবে? আমরা উচ্চ আদালতে যাবো। আশাকরি উচ্চ আদালত আমাদের ন্যায়বিচার দেবেন।’
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ধর্ষণের শিকার এক মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীকে দেখতে ২০০২ সালের ৩০ আগস্ট সাতক্ষীরার কলারোয়ায় যান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। সড়ক পথে ঢাকায় ফেরার পথে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা বিএনপি অফিসের সামনে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটে। শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। বোমা বিস্ফোরণ ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। হামলায় জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি প্রকৌশলী শেখ মুজিবুর রহমান, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা ফাতেমা জামান সাথী, আবদুল মতিন, জোবায়দুল হক রাসেল, শহীদুল হক জীবন, সাতনদী সম্পাদক হাবিবুর রহমানসহ কমপক্ষে এক ডজন দলীয় নেতা-কর্মী আহত হন।
এ ঘটনায় ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর কলারোয়া মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোসলেমউদ্দিন বাদী হয়ে যুবদল নেতা আশরাফ হোসেন, আবদুল কাদের বাচ্চুসহ ২৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ৭০ থেকে ৭৫ জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন। বিভিন্ন আদালত ঘুরে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর মামলাটি এজাহার হিসেবে গণ্য হয়। ২০১৫ সালে এ ঘটনায় আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়। এর মধ্যে হত্যাচেষ্টা মামলায় এক আসামি রকিব ওরফে রাকিবুর রহমানের বয়স ঘটনার সময় ১০ বছর ছিল উল্লেখ করে হাইকোর্টে মামলা বাতিলে আবেদন করা হয়। ২০১৭ সালের ২৩ আগস্ট ওই আবেদন হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দিয়ে রুল জারি করেন। এ রুলের ওপর শুনানি শেষে ৮ অক্টোবর রুলটি খারিজ করে রায় দেন হাইকোর্ট। এরপর হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল করে আসামিপক্ষ।
সবশেষ গত বছরের ২৪ নভেম্বর দায়ের করা মামলা বাতিল চেয়ে এক আসামি আবেদন করলে আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেন। ফলে বিচারিক আদালতে এ মামলা চলতে আর কোনও বাধা নেই বলে জানিয়েছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এসএম মুনির।
এদিকে রায় ঘোষনার পরপরই আওয়ামী লীগ আনন্দ মিছিল বের করে। এতে নেতুত্ব দেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আফম রুহুল হক , দলের সাধারন সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম ও অর্ধক্ষ আবু আহমেদ । তারা রায়কে যুগান্তকারী উল্লেখ করে স্বাগত জানিয়ে বলেন এতে সাক্ষীরাবাসী কলংকমুক্ত হলেন। অপরদিকে বিএনপি এই রায় প্রত্যাখ্যান করে এক বিক্ষোভ সমাবেশে বলেছে এতে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন সাবেক সাধারন সম্পাদক তারিকুল হাসান। এদিকে রায় ঘোষনার পরপরই সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুল ইসলাম হাবিবকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তার মেয়ে কানেতা ইয়া লাম লাম। এ সময় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারনা ঘটে।