আশাশুনি সংবাদদাতা: প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের ঋতু শীতকাল। শীত কালকে আরও অপরূপ করে তোলে নানা পাখির আগমন। শীতের শুরুতে প্রতি বছর দূরদূরান্ত থেকে শীতের পাখিরা আসে আমাদের দেশে। দেশী পাখির পাশাপাশি অতিথি পাখির আনাগোনা ও কলকাকলি দেখতে ভ্রমণ পিপাসু মানুষ ভিড় করে বিভিন্ন জলাশয় ও অভয়াশ্রমে। পাখিদের কলকাকলী প্রকৃতির শোভা বাড়িয়ে দেয় বহু গুণে। শীত আসলেই আমাদের দেশের জলাশয়, হাওড়, খাল-নদী-বিল, বড় বড় গাছের শোভাবর্ধনকারী বাগান ও পুকুর রং-বেরঙের পাখিতে ভরে যায়। এসব অতিথি পাখি আমাদের দেশের স্থায়ী বাসিন্দা নয় বরং শীতপ্রধান দেশ থেকে শীত থেকে বাঁচতে এখানে আসে। এদেরকে অতিথি পাখি বলা হলেও মূলত এরা পরিযায়ী পাখি। পৃথিবীর প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৮৫৫ প্রজাতি পরিযায়ী। বহু প্রজাতির পানিকাটা, জলচর, শিকারি ও ভূচর পাখিরা বছরের নির্দিষ্ট সময়ে পরিযান করে। পাখি পরিযানের অন্যতম দু’টি কারণ হচ্ছে খাদ্যের সহজলভ্যতা আর বংশবৃদ্ধি। আবাসিক ও পরিযায়ী মিলে আমাদের দেশে পাখি প্রায় ৬৫০ প্রজাতির। এরই মধ্যে ৩৬০ প্রজাতি আবাসিক। বাকি ৩০০ প্রজাতি পরিযায়ী। সব পরিযায়ী পাখি শীতের সময় আসে না। ৩০০ প্রজাতির মধ্যে ২৯০টি শীত মৌসুমে আসে ও ১০টি প্রজাতি থেকে যায়। পরিযায়ী পাখি আমাদের জন্য আশীর্বাদ স্বরুপ। পরিযায়ী পাখিদের আগমন আমাদের প্রকৃতিতে আনন্দের আমেজ এনে দেয়। এদের আগমনে আমাদের প্রকৃতি সৌন্দর্যে ভরে উঠে। এরা যে শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে তা নয়। এরা বিভিন্ন কীটপতঙ্গ খেয়ে আমাদের ফসলকে রক্ষা করে। পরিযায়ী পাখি আমাদের পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা করে। পরিযায়ী পাখিদের যাতায়াতের পথকে উড়ালপথ বলে। সিনাই হয়ে আসা—যাওয়ার পথটি ছাড়াও ইউরোপের সিসিলি ও স্পেন হয়ে দুটি, মধ্য আমেরিকা ও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ হয়ে দুটি এবং পূর্ব এশিয়ার প্রান্ত ধরে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ আছে। এছাড়াও পৃথিবীতে পরিযায়ী পাখিদের গমনাগমনের ভিন্ন পথ আছে। প্রায় সব উৎস থেকে আসা পাখিরা এ পথের ওপর দিয়ে গিয়ে আফ্রিকায় ছড়িয়ে যায় এবং ফিরতি পথে এ পথ দিয়েই তাদের আগের স্থলে ফিরে যায়। বংশপরম্পরায় এরা কাজটি করে আসছে এবং প্রতি বছর হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যাতায়াত করলেও একই স্থানে তারা ফিরে আসে। শীতকালে সুদূর সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া ও চীন থেকে হাজার হাজার অতিথি পাখি বাংলাদেশে আসে। হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশের হাওর, বিল, জলাশয়ে এরা আশ্রয় নেয়। এই পাখিরা আমাদের দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আন্তর্জাতিকভাবে জলচর পাখির জন্য বাংলাদেশের সীমানায় স্বীকৃত ২৮টি জায়গা রয়েছে। এগুলো হলো বরিশাল বিভাগের চর বারি, চর বাঙ্গের, কালকিনির চর, চর শাহজালাল, টাগরার চর, ডবা চর, গাগোরিয়া চর, চর গাজীপুর, কালুপুর চর, চর মনপুরা, পাতার চর ও উড়ির চর। চট্টগ্রাম বিভাগের চর বারী, বাটা চর, গাউসিয়ার চর, মৌলভীর চর, মুহুরী ড্যাম, মুক্তারিয়া চর, ঢাল চর, নিঝুম দ্বীপ, পতেঙ্গা সৈকত, সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপ। সিলেট বিভাগের আইলার বিল, ছাতিধরা বিল, হাইল হাওর বাইক্কা, হাকালুকি হাওর, পানা বিল, রোয়া বিল, শনির বিল ও টাঙ্গুয়ার হাওর। শীত এলেই আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় শীতের এই পরিযায়ী পাখিদের বিচরণ দেখতে পাওয়া যায়। প্রতি বছর শীতের শুরুতেই ওরা আসে ঝাঁকে ঝাঁকে। এসব জলাশয়সহ বিভিন্ন হাওর, বাঁওড়, বিল ও পুকুরের পাড়ে চোখে পড়ে নানা রং—বেরঙের নাম জানা ও অজানা পাখির। বাংলাদেশের হাওর এলাকা ও বিস্তৃত সুন্দরবন এলাকা পরিযায়ী পাখিদের অন্যতম আকর্ষণ। নানা রং আর আকৃতির পরিযায়ী পাখির কূজনে মুখরিত হয় জলাশয়, বিল—ঝিল, নদীপাড়ের বন-বাদাড়ে। বাংলাদেশের বেশ কিছু জায়গায় তাদের বেশী আনাগোনা দেখা যায়।
তবে বাংলাদেশের দিকে এ উড়ালপথে জনবসতি বেশি হওয়ায় এবং মানুষের অত্যাচারে পরিযায়ী পাখিদের আগমন কমতে বসেছে। কিছু অসাধু মানুষের জন্য পরিযায়ী পাখির সংখ্যা দিন দিন কমছে। এসব পাখি বেআইনিভাবে শিকার করা হয়। তারা শুধুমাত্র খাবার জন্য পরিযায়ী পাখিদের শিকার বানায়। পাখি শিকারের জন্য বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ, জাল ও বন্দুক ব্যবহার করা হয়। পরিযায়ী পাখি শিকারের ফলে এদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এছাড়াও, পরিবেশ দূষণ, জলাভূমি ও বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণেও পাখিদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। পরিযায়ী পাখি আমাদের পরিবেশের বন্ধু। এ পাখিগুলোকে অচেনা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমাদের বন্ধুসুলভ আচরণ করা দরকার। এই পাখিগুলো রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।
আমাদের সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন উপজেলার বড় বড় মৎস্য খামার গুলোতে শীতকালে অতিথি পাখির আগমন দেখতে পাওয়া যায়। তাছাড়া দেশী পাখিরও বেশ বিচরণ রয়েছে এসব এলাকায়। পাখিরা সন্ধ্যার পূর্বেই নিরাপদ বাগান ও বড় গাছের বাগানে আশ্রয় খুজে নেয়। প্রতিদিন এসব আশ্রয়স্থলে পাখির নিয়মিত আগমন প্রস্থানের দৃশ্য ও কলকাকলি নতুন মাত্রার সৃষ্টি করে থাকে। তবে কষ্টদায়ক হলেও সত্য যে, এক শ্রেণির পাখি শিকারীরা বন্দুক, ইয়ারগান বা অন্য অস্ত্রহাতে রাতের আঁধারে বাগানে ঢুকে পাখি শিকার করে থাকে। পাখিরা তাদের আশ্রয়স্থলে হানার কারনে জীবন বিসর্জন দিয়ে থাকে, আবার কিছু নিরাপত্তার অভাব অনুভব করে অন্যত্র চলে যায়। আবার খাল-বিল ও মৎস্য ঘেরে দিনের বেলায়ও পাখি শিকারের ঘটনা ঘটে থাকে। অতিথি পাখির পাশাপাশি ফাঁদ পেতে, জাল ব্যবহার করে, বিষ ব্যবহার করে বা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে দেশী পাখি ধরার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে এলাকায়।
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী পরিযায়ী পাখি হত্যার দায়ে একজন অপরাধীকে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। একইভাবে কোনো ব্যক্তি যদি পরিযায়ী পাখির মাংস, দেহের অংশ সংগ্রহ করেন, দখলে রাখেন কিংবা ক্রয়—বিক্রয় করেন বা পরিবহণ করেন, সেক্ষেত্রে তার সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার আইন প্রচলিত রয়েছে।পরিযায়ী পাখি নিধন এবং বাজারে বিক্রি নিষিদ্ধ জেনেও আইনের ফাঁক গলিয়ে এক শ্রেণির পেশাদার এবং শৌখিন শিকারি কাজগুলো করে চলেছে। পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিযায়ী পাখির গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যও পাখিদের বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। পাখি হলো প্রকৃতির কীটনাশক। পাখির সংখ্যা কমে গেলে কীটপতঙ্গের আক্রমণে অসম্ভব হয়ে পড়বে ফসল ফলানো। তখন নির্ভর করতেই হবে কীটনাশকের ওপর। অতিরিক্ত কীটনাশক পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। যে দেশে পাখি যত বেশি, সে দেশের পরিবেশ ততো সুস্থ ও সুন্দর। কাজেই পাখি ঘাটতি অবশ্যই উদ্বেগের ব্যাপার। পাখি নিসর্গকে সুন্দর করে, চোখকে প্রশান্তি দেয়, সৌন্দর্য চেতনাকে আলোড়িত করে। পাখিরা আসুক, ওদের কলকাকলিতে ভরে উঠুক আমাদের চারপাশ। পাখিরা আমাদের পরিবেশের জন্য অপরিহার্য। তারা আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই আমাদের উচিত পাখি রক্ষার জন্য সচেতন হওয়া। পাখি শিকার বন্ধে আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। পাখিদের রক্ষায় সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। পাখি শিকারের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়াও, বিভিন্ন সংগঠন পাখি রক্ষায় কাজ করছে। এই পদক্ষেপ গুলো যথেষ্ট নয়।
আমরা পাখিদের উৎপাত ও শিকার করবো না। তাদের প্রতি সদয় হয়ে আমরা মানবিক আচরণ করবো। পাখি রক্ষার জন্য আমাদের জনমত গড়ে তুলতে হবে। পাখির প্রতি মানুষের ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে হবে। পাখির গুরুত্ব সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে বুঝাতে হবে। তাহলে আমরা নির্মল পরিবেশে সুস্থভাবে বসবাস করতে পারব।