
হাবিবুর রহমান শ্যামনগর থেকে: পাঁচটি প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ ৩৫ লক্ষ টাকা থেকে শ্যামনগর উপজেলা শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তারা ৭ লক্ষ টাকা উৎকোচ আদায় করেছেন। উৎকোচ আদায়ের টাকা হালাল করতে শিক্ষা কর্মকর্তারা এখন নানা মহলে দৌড় ঝাপ শুরু করেছেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার বিভিন্ন স্কুলে অস্থায়ী গৃহ মেরামত, ওয়াশব্লক৭ ও খেলা-ধুলা সামগ্রী খাতে শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে বরাদ্দ পেতে স্কুল গুলোকে ওই শিক্ষা কর্মকর্তাদের ৭ লাখ ২২ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।
২০১৯-২০ অর্থ বছরে শিক্ষা অধিদপ্তর হতে ১৯১ টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩টি বিদ্যালয়ে অস্থায়ী গৃহ মেরামত খাতে বরাদ্দ ৯ লাখ টাকা, ৩টি বিদ্যালয়ে পিডিপি-৪ এডুকেশন ইন ইমারজেন্সি এর আওতায় বরাদ্দ ৬ লাখ টাকা। ৮টি বিদ্যালয়ে খেলা-ধুলা সামগ্রী খাতে বরাদ্দ ১২ লাখ টাকা। ১টি বিদ্যালয়ে (গোপালপুর) রাজস্ব মেরামতের খাতে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর ২০টি বিদ্যালয় ওয়্যাশবøক খাতে ৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
অভিযোগ উঠেছে, বিদ্যালয় গুলোর উল্লেখিত খাতের কাজ শুরু করার আগেই বরাদ্দের টাকা পেতে ওই পাঁচ শিক্ষা অফিসারকে ৭ লক্ষাধিক টাকা ঘুষ প্রদান করতে বাধ্য হয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। এ ঘুষ আদায়ের পিছনে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার যোগসাজস আছে বলেও অভিযোগ আছে। শ্যামনগর উপজেলা শিক্ষা অফিসার আক্তারুজ্জামান মিলনের নির্দেশে চার সহকারী শিক্ষা অফিসারের দূর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্য করার খবরটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় তারা নিজেরাই বাঁচতে দৌড় ঝাঁপ শুরু করেছেন। চার শিক্ষা অফিসার হলেন, মোঃ শাহআলম, মোঃ আজহারুল ইসলাম, মোঃ সোহাগ হোসেন ও মোঃ সোহাগ আলম। শিক্ষা অফিসার আক্তারুজ্জামান মিলন ও চার সহকারী শিক্ষা অফিসারের ঘুষ বাণিজ্য ও দূর্নীতির যাঁতাকলে পিষ্ট শ্যামনগরের শিক্ষকরা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৯ অর্থ বছরের প্রতিটি বিদ্যালয় স্লীপ খাতের বরাদ্দ থেকে ডিজিটাল হাজিরা ম্যাশিন কিনবে এমন নির্দেশনা ছিলো অধিদপ্তরের। কিন্তু স্লীপ খাতের টাকা স্কুল গুলোতে পাঠানো হয়নি। ম্যাশিন ক্রয় বাবদ সাড়ে ২৭ হাজার টাকা কেটে রেখে স্লীপ খাতের বাকী টাকা ১৫১ স্কুল গুলোতে প্রেরণ করা হয়। ওই সময় এই দূর্ণীতি মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। বরাদ্দের টাকা থেকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক, সভাপতি সহ সংশ্লিষ্টরা বাজার যাচাই-বাছাই করে হাজিরা ম্যাশিন ক্রয় করার নির্দেশনা থাকলেও এখানে হয়েছে এর উল্টোটা। উপজেলা শিক্ষা অফিসার আক্তারুজ্জামান নিজে হাজিরার ম্যাশিন ক্রয় করেন। এই অনিয়ম দুর্নীতির পিছনে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার যোগসাজস ছিল বলে গুরুতর অভিযোগ আছে। হাজিরা ম্যাশিন ক্রয় বাবদ ২৫ হাজার টাকা হারে কর্তন করেন চেকের মাধ্যমে। কিন্তু হাজিরা ম্যাশিনের বাজার মূল্য ছিল মাত্র ৬ হাজার ৮ শত টাকা। ১৫১ টি বিদ্যালয়ের একাউন্ট চেক করলে প্রমান মিলবে। দুর্নীতির বিষয়টি জানা জানি হলে শিক্ষা অফিসারকে ওই সময় নানামুখী প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
চলতি ২০২০ সালে উপজেলা উপজেলা শিক্ষা অফিসার আক্তারুজ্জামান মিলন বিগত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কৌশল পরির্বতন করেছেন। তিনি বিদ্যালয়ের বরাদ্দ প্রাক প্রাথমিক ও স্লীপ খাতের চেক আগেই শিক্ষকদের কাছে প্রদান করেছেন যাতে শিক্ষকরা ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে ক্যাশ করে বরাদ্দের উপর ১৫% হারে নগত উৎকোচ দিতে পারেন।
উপজেলা হিসাবরক্ষন অফিসের তথ্য মতে বিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র মেরামত খাতে র্নিমান সংস্থার কর্তন কৃত মূসকের হার ৬%। কিন্তু নিয়ম বহিভূত ভাবে কোন আইনের তোয়াক্কা না করে ১২% হারে ভ্যাট নিয়ে দূর্নীতি করেছেন শিক্ষা কর্মকর্তারা।
৪২ নং মরগাং স্কুলের প্রধান শিক্ষক রুহুল আমিন, ৩১ নং শ্রীফলকাটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক আকিকুর রেজা ইউনিয়ন শিক্ষক প্রতিনিধি (পদ সৃষ্টি কৃত সচিব) সহ অন্যান্য শিক্ষক প্রতিনিধিরা জানান, সহকারী শিক্ষা অফিসারদের নির্দেশে স্ব-স্ব স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নিকট থেকে ১৫% হারে টাকা উত্তোলন করে শিক্ষা অফিসে জমা দিয়েছি। ১২৭ নং স্কুলে প্রধান শিক্ষক হোসেন আলী জানান,বরাদ্দ পাইয়ে দেয়ার জন্য তিন কেজি মধু,ছয় কেজি রাজহাসের মাংশ দিয়েছি শিক্ষা অফিসার আক্তারুজ্জামানের বাসায়।
এবিষয়ে উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার শাহআলম,আজহারুল ইসলাম, সোহাগ হোসেন ও সোহাগ আলম এর সাথে কথা হলে ১২% হারে ভ্যাট নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন, কিন্তু ১৫% হারে ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যান।
শ্যামনগর উপজেলা আওয়ামীলীগ সিনিয়র সহ-সভাপতি ও রোকেয়া ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ সাবেক ছাত্র নেতা জাফরুল আলম বাবু সাতনদীকে বলেন,জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের যোগসাজসে শ্যামনগর উপজেলা শিক্ষা অফিসে সিরিয়াল দূর্নীতি হচ্ছে। এসব দূর্নীতি বন্ধ করতে হলে উপজেলা শিক্ষা কমিটিকে কঠোর হতে হবে। এই কমিটির সভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউল হক দোলন ও উপদেষ্টা এমপি জগলুল হায়দার। তারা গুরুত্ব পূর্ণ পদে আছেন। তারা উদ্যোগ নিলে উপজেলার সব সেক্টরের দূর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব।
উপজেলা শিক্ষা অফিসার আক্তারুজ্জামান বলেন. গত ২০১৯ সালে শিক্ষকদের কাছে থেকে কিছু টাকা উঠানোর ফলে আমাকে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়েছিল। তাই এবার শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা তোলায় আমি রাজি ছিলাম না। আমার চার সহকারী শিক্ষা অফিসাররা শিক্ষা সমিতির কিছু শিক্ষকদের সহযোগিতায় প্রধান শিক্ষকদের নিকট থেকে ১৪ লক্ষ টাকা তুলে নিজেদের কাছে রেখেছেন।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা- ৪ আসনের এম পি এস এম জগলুল হায়দার বলেন, উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসাররা ১৫% হারে যদি ঘুষ বানিজ্য করে থাকেন, তবে শিক্ষকদের দিয়ে সমুদয় টাকা আদায় করে শিক্ষক সমিতির ভবনের কাজে লাগানো হবে। তিনি আরো বলেন, প্রয়োজনে তার নিজস্ব তহবিল হতে দুই লাখ টাকা অনুদান দিয়ে ভবনের কাজ উদ্বোধন করবেন বলে জানান।
ছবি ঃ শ্যামনগর উপজেলার দূর্নীতি গ্রস্থ শিক্ষা অফিসার সহ চার সহকারী শিক্ষা অফিসার।