জাতীয় ডেস্ক:
শোনা যাচ্ছে, সরকারি ইউনিভার্সিটিতে নাকি স্টুডেন্টদের শিক্ষক রেটিং চালু হবে। মানে এতদিন মাস্টাররাই কেবল ছাত্রছাত্রীদের নাম্বার দিয়েছেন, এবার দেবে স্টুডেন্টরাও। এই প্রথাটা কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশেই চালু আছে এমনকি বাংলাদেশেও। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোতে জন্ম থেকেই রয়েছে। এতে টিচাররা সচেতন থাকে, মনোযোগী হয়, ক্লাস মিস দেয়না। ঠিক ছাত্র ছাত্রীদের মতো। এতদিন সরকারি ইউনিভার্সিটিতে ছিল না। তারা যেন শিক্ষা ব্যবস্থার ব্রাহ্মণ। কিন্তু কী কারণে হঠাৎ চালু করার কথা ভাবলো-জানা যায় নি। আশা করি, এর পরিণাম সম্পর্কে ভেবেই করা হয়েছে।
শিক্ষক রেটিং: এটা আবার কি নতুন ঝামেলা?
আফসান চৌধুরী
২
আমি বিদেশের কোনো ইউনিভার্সিটিতে পড়িনি, তবে তিনটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছি। মোটামুটি ভালোভাবে পাস করেছি। তবে আমার দুশ্চিন্তা কম ছিল রেটিং নিয়ে, কারণ আমি তো ক্যারিয়ার বানাই না কোথাও। মন দিয়ে ভালোবেসে পড়িয়েছি। কিন্তু বিদেশে অনেক শিক্ষকই এই রেটিং নিয়ে ভয়ে থাকেন। এ ছাড়া আছে এক অনলাইন গেঁড়াকল নাম, ‘রেট মাই টিচার’। স্টুডেন্টরা নাম ধরে মার্ক দেয়-এই ওয়েবসাইট অনলাইনে দেখা যায়। পশ্চিমা দেশে এই পদ্ধতিকে অনেক দাম দেয়। শিক্ষক বার বার ফেল করলে জবাবদিহি করতে হয়, মিটিং বসে, দুই এক কেসে চাকরি পর্যন্ত চলে যায়, চাপ না সহ্য করতে পেরে, অর্থাৎ ফেল করে শিক্ষকও। আমার দেশে কি সেই ভয় আছে?
৩
আমার দেশের ছাত্রছাত্রীরা বেশিরভাগ ক্যাডার বাহিনীর সদস্য। হয় পার্টি ক্যাডার না হয় বিসিএস। এর বাইরে তাদের অন্য কিছু নিয়ে খেয়াল নেই। তবে শিক্ষক ভাইয়ারা যে বেশ সেনসিটিভ কোনো সমালোচনা নিয়ে এটা সবার জানা। আমি নিজের অভিজ্ঞতা বলি। একবার ডিপার্টমেন্টের এক অনুষ্ঠানে বলেছিলাম, ‘ক্লাসরুমে যা শিখেছি, তার চেয়ে বেশি শিখেছি ক্যান্টিনে আর করিডোরে।’ কথাটা কিন্তু সত্য। আমি নানা পরিসর থেকে শিখেছি। তাছাড়া সব ঘরে বসে শিখতে হবে কে বলেছে? যাই হোক এই কথার দাম আমাকে দিতে হয়েছে যে ভাবেই হোক। কী সেটা আর বললাম না। তাই বলছিলাম, যাদের চামড়া এতো পাতলা তারা সুডেন্ট রেটিং সহ্য করবেন কীভাবে?
৪
উনাদের যে খারাপ লাগবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সময় তো পাল্টাচ্ছে- এটা মানা দরকার। কারণ আজকের দুনিয়ায় শিক্ষক পড়াবে ছাত্রদের আর তারা বলতে পারবে না ভালো না খারাপ হচ্ছে, সেরকম ব্যবস্থা দুনিয়া থেকে উঠে গেছে। এখন শিক্ষক ও স্টুডেন্ট দুইজনই গুরুত্বপূর্ণ। অতএব পছন্দ হোক আর নাই হোক, মনে হয় পৃথিবীব্যাপী শিক্ষা পদ্ধতি প্রয়োগ ও প্রচারের যে বাস্তবতা তার হাত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় দুনিয়ার দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে। এবং সেটা কারো কারো কানে গেছে, তাই এই ব্যবস্থা। নাকি এর সাথে অন্য কিছু যুক্ত আছে?
৫
ছাত্রছাত্রীদের রেটিং প্রদান বড় সমস্যা হবে না। আসল হলো রেটিং ব্যবহার করবে প্রশাসন ও রাজনৈতিক শক্তিরা- প্রতিষ্ঠানের ভেতরে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে রাজনৈতিক দলের শাখা প্রশাখা বলেই মনে হয়। ক্ষমতায় থাকা দলের লোক ছাড়া চাকরি হয় না। পদ ও প্রমোশন হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সবচেয়ে বড় বাস্তবতা আওয়ামী লীগ আর বিএনপির প্রতি আনুগত্য। শিক্ষক নির্বাচন মাস্টারদের প্রধান চিন্তা। তাহলে ছাত্রছাত্রীদের কী এখন দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হবে? যদি কোনো শিক্ষক বিরোধী দলের সমর্থক হয়, তাহলে আগামী আমলাবৃন্দ তাকে কি ভালো মার্ক দিতে উৎসাহ বোধ করবে?
৬
স্টুডেন্ট টিচারের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য রেটিং যতটা না ব্যবহার হবে, তার চেয়ে বেশি হতে পারে- অপছন্দের লোককে বিপদে ফেলতে। সেটা রাজনৈতিক হতে পারে, ব্যক্তিগতও হতে পারে। আগামীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় খবরগুলো হবে কীভাবে রেটিং পদ্ধতির ব্যবহার হচ্ছে বা অপব্যবহার হচ্ছে কিনা। রাজনীতিপ্রধান প্রতিষ্ঠানে সবই হয় সেই নিরিখে।
৭
আজকাল নিজেদের উন্নতিই যথেষ্ট নয়, শত্রুপক্ষের অন-উন্নতিও একটি বড় লক্ষ্য। অতএব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বা অন্য সরকারি পরিসরে লাল নীল, গোলাপি, হলুদ ঝগড়া আরও অনেক রঙিন ও তীব্র হবে। এতে ছাত্রছাত্রীদের কী লাভ হবে আমরা জানি না। তবে মাস্টারদের লাভ ছাড়াও ক্ষতি হবার অনেক সুযোগ রয়েছে। পরিস্থিতি যে বেশ জটিল হবে সবার জন্য সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
৮
আসলে বাস্তব ইতিহাস হচ্ছে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা মূল উদ্দেশ্য শিক্ষা গ্রহণ বা বিতরণ নয়। এই সব প্রতিষ্ঠান হচ্ছে রাজনীতির অনেকগুলো পরিসর বা শাখা প্রশাখার মধ্যে একটি। তাদের উদ্দেশ্যে রাজনীতি। যতক্ষণ না শিক্ষাকে এই ধরনের গোত্র ও দলীয় রাজনীতির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে ততক্ষণ প্রতিটি সিদ্ধান্ত এই ধরনের সংকট তৈরি করবে।