শ্যামনগর প্রতিনিধি: লবণাক্ততার প্রভাবে শ্যামনগর অঞ্চলে কৃষিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এতে কমে যাচ্ছে ফসল উৎপাদন। বাড়ছে কৃষকের খরচ। ফলে দিন দিন কৃষিবিমুখ হয়ে পড়ছে মানুষ। সাতক্ষীরা উপকূলে সুপেয় পানির সংকট নিয়ে গবেষণাপত্র উপস্থাপন ও সমাধানে একটি সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) সাতক্ষীরা পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক) এই সেমিনারের আয়োজন করে। গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন সাংবাদিক ও গবেষক তানজির কচি এবং সুলতান শাহাজান। এতে বলা হয়, ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হওয়ার কারণে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে বরাবরই সুপেয় পানির সংকট বিদ্যমান। সুন্দরবনের কোলে এ অঞ্চলে জনবসতির শুরু থেকেই মানুষ সুপেয় পানি সংগ্রহের সংগ্রামে লিপ্ত। জনবসতি শুরুর পর থেকে অদ্যাবধি শ্যামনগর অঞ্চলের মানুষের জীবনধারণের প্রধান উৎস পুকুর বা দিঘির পানি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এ অঞ্চলে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা, লবণাক্ততার আওতা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিতভাবে লোনা পানির চিংড়ি চাষের ক্ষেত্র সম্প্রসারণ, পুকুর ও দিঘিগুলো সংস্কার না করা, প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন পুকুর ও দিঘি খনন না করাসহ নানা কারণে শ্যামনগর অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট প্রকট হয়েছে। এই সংকট দূর করতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ গৃহীত ও বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু টেকসই কোনো সমাধান হয়নি বলে সেমিনারে উল্লেখ করা হয়। সরকারি জলমহালগুলো প্রভাবশালীরা দখলে রেখেছে উল্লেখ করে আরও বলা হয়, সুপেয় পানি সংকট নিরসনে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পিএসএফ স্থাপন বা সংস্কার, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ট্যাংক বিতরণ, রিভার্স অসমোসিস প্লান্ট স্থাপন ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু নানা কারণে আধুনিক প্রযুক্তি সুপেয় পানির সংকট নিরসনে সফলভাবে ভূমিকা রাখতে পারছে না। গবেষণাপত্রে বলা হয়, মিষ্টি পানির উৎস কমে যাওয়ায় শ্যামনগর অঞ্চলের কৃষিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। লবণাক্ততার প্রভাবে কৃষি জমি কমে লোনা পানির ঘেরে রূপান্তর হচ্ছে। ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে। কৃষকের খরচ বাড়ছে। দিন দিন কৃষি বিমুখ হয়ে পড়ছে মানুষ। হারাচ্ছে পেশা। বর্ষা মৌসুম ছাড়া অন্যান্য মৌসুমে চাষাবাদ হচ্ছে না। এতে আর্থিক ক্ষতি বাড়ছে। উদ্ভিদ-প্রাণবৈচিত্র্য বিলুপ্ত হচ্ছে। বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে। ফলজ বৃক্ষ হ্রাস পাচ্ছে। গবাদি পশু কমে যাচ্ছে। প্রকৃতি থেকে শামুক, কেঁচো, জোক, ব্যাঙ হারিয়ে যাচ্ছে। পশু-পাখি হারিয়ে যাচ্ছে। গাছপালা জন্মাতে অসুবিধা হচ্ছে। স্বাদু পানির কচ্ছপ পাওয়া যাচ্ছে না। জ্বালানি সংকট বাড়ছে। গরম অনুভূত হচ্ছে। উদ্ভিদ-খাদ্য বৈচিত্র্য কমে যাওয়ায় শ্যামনগর অঞ্চলে অপুষ্টি বেড়েছে বলে সেমিনারে জানানো হয়। বলা হয়, এ অঞ্চলে পানিবাহিত চর্মরোগ, রাতকানা, অন্ধত্ব, ডায়রিয়া, আমাশয় বেড়েছে। নারীদের ঋতুকালীন সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। ‘সুপেয় পানির সংকট নিরসনে শ্যামনগরের মানুষের শেষ ভরসা পুকুর। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নদী ভাঙন ছাড়াও অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ ও মৎস্য ঘেরগুলোর আউট ড্রেন না থাকায় ঘেরের লোনা পানি চুঁইয়ে চুইয়ে মিষ্টি পানির পুকুরগুলো লবণাক্ত করে তুলছে। অনেক পুকুর দীর্ঘদিন সংস্কার করা হয় না। অনেকগুলো ভরাট হওয়ার উপক্রম, কিছু কিছু মজে গেছে। অনেকগুলোর পানি এখন আর খাওয়া যায় না। অনেকগুলোই প্রভাবশালীরা দখল করে মাছ চাষ করছে।’ আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভব মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করলেও শ্যামনগর অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট নিরসনে তা অনেকটা অকার্যকর বলে উল্লেখ করা হয় গবেষণাপত্রে। বলা হয়, শ্যামনগর উপকূলে আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ রিভার্স অসমোসিস (আরও) প্লান্টও অকেজো হয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এছাড়া রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম পরিবেশসম্মত প্রযুক্তি হলেও তা সারা বছরের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছে। যা বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে কার্যকর। গবেষণায় শ্যামনগর উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যবহার্য পানির সংকট মোকাবিলায় বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়। এরমধ্যে রয়েছে- প্রতিটি গ্রামে বড় বড় পুকুর বা জলাধার খনন, সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা। পুকুর বা জলাধারগুলো অবশ্যই দুর্যোগ সহনশীল হতে হবে। পুকুর বা জলাধারগুলোতে যেন বন্যা বা প্লাবনের পানি প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য পাড় প্রয়োজনীয় উচ্চতা ও প্রস্থ বিশিষ্ট এবং মজবুত হতে হবে। বিদ্যমান ও নতুন করে খননকৃত পুকুর বা জলাধারগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনায় স্থানীয় সরকারের নেতৃত্বে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এজন্য স্থানীয় সরকারকে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। পুকুর ভরাট নয়, আরও পুকুর খননে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে উৎসাহিত করতে হবে। অপরিকল্পিতভাবে লবণ পানির চিংড়ি চাষ বন্ধ করে নীতিমালা অনুযায়ী চিংড়ি চাষে বাধ্য করতে হবে এবং লবণ পানির মাছ চাষের জন্য জোনিং সিস্টেম প্রবর্তন করতে হবে। চিংড়ি ঘেরগুলোতে অবশ্যই কার্যকর আউট ড্রেন রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে। যাতে ঘেরের পানি পুকুর বা কৃষি জমিতে চুঁইয়ে যেতে না পারে। বিদ্যমান পুকুর বা জলাধারগুলো প্রকৃত রূপে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। এছাড়া জলমহাল ঘোষিত খালগুলোর ইজারা বাতিল করে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। এসব খালে লবণ পানি উত্তোলন করা যাবে না। খালগুলোতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে কৃষিসহ নানামুখী ব্যবহারে উন্মুক্ত করতে হবে। উপকূল রক্ষা বাঁধ টেকসই ও মজবুত করতে হবে। সুপেয় পানির সংকট নিরসনে বরাদ্দকৃত অর্থের সিংহভাগ পুকুর বা জলাধার খনন, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় করতে হবে। সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক আজাদ হোসেন বেলালের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বারসিকের পরিচালক পাভেল পার্থ। অতিথি হিসেবে আলোচনা করেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা কামরুল ইসলাম ফারুক, সাংবাদিক ও গবেষক গৌরাঙ্গ নন্দী, সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক অধিকার ও উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সহ-সভাপতি অধ্যাপক মোজাম্মেল হোসেন, সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, সনাক-সাতক্ষীরার সভাপতি হেনরী সরদার, অধ্যাপক পবিত্র মোহন দাস, সাংবাদিক কল্যাণ ব্যানার্জি, এম কামরুজ্জামান, শরীফুল্লাহ কায়সার সুমন, গোলাম সরোয়ার, আহসান রাজীব, গাজী আল ইমরান, মো. কামরুজ্জামান, শেফালী বেগম প্রমুখ।