আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
মিসরের এক বিধবা তার পাঁচ ছেলের জন্য মাংস ও ডিম জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন। জার্মানির এক ক্ষুব্ধ লন্ড্রি মালিক তাকিয়ে আছেন তার পাঁচগুণ বেড়ে যাওয়া বিদ্যুৎ বিলের দিকে। নাইজেরিয়ার বেকারিগুলো তাদের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, কারণ ময়দার দাম এত বেড়েছে যে তারা আর কিনতে পারছে না।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, ইউক্রেনে রাশিয়া যে আক্রমণ শুরু করে তার এক বছর পর বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ব্যাপক দুর্ভোগ নিয়ে এসেছে। এখনও এই যুদ্ধের পরিণতি চলমান– খাদ্যশস্যের সরবরাহ কমেছে, কমেছে সারের সরবরাহ, জ্বালানির মূল্যে ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি আরও বেশি মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা নিয়ে এসেছে এমন এক বিশ্বে, যা ইতোমধ্যে করোনাভাইরাস মহামারিতে প্রায় বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিল।
যুদ্ধের প্রভাব যতটা হতাশাজনক, তার মধ্যে সান্ত্বনা একটাই: পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারত। উন্নত বিশ্বে দেশ ও কোম্পানিগুলো তাদের অবাক করার মতো সহনশীলতার প্রমাণ দিয়েছে, এখন পর্যন্ত সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি যন্ত্রণাদায়ক মন্দা এড়ানো গেছেন।
কিন্তু উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে এই সংকট ছিল অনেক বেশি তীব্র।
মিসরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জনগণ দরিদ্রের মধ্যে বাস করেন। হালিমা রাবি বেশ কয়েক বছর ধরে স্কুলগামী বয়সের পাঁচ সন্তানের ভরণপোষণ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। ৪৭ বছর বয়সী এই বিধবা মোদির দোকান থেকে জরুরি পণ্য কেনা বাদ দিয়ে দিছেন মূল্যবৃদ্ধির কারণে।
কায়রোর একটি সরকারি হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতার কাজে যাওয়ার পথে রাবি বলেন, একেবারে অসহনীয় হয়ে পড়েছে। মাংস ও ডিম এখন বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও অপর ধনী দেশগুলোতে ভোগ্য পণ্যের মূল্য বেড়েছে ব্যাপক। মূলত তেলের মূল্যে যুদ্ধের প্রভাবে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছিল, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ানোর ফলে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে মন্দায় পতিত হবে এবং ডলারের বিপরীতের বিশ্বের অপর মুদ্রাগুলো ধুঁকবে।
গত বছর চীন কঠোর জিরো-কোভিড লকডাউন প্রত্যাহার করে নেয়। যা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিকে চাঙ্গা হওয়ার দিকে নিয়ে গেছে।
প্রকৃতিও কিছুটা সুপ্রসন্ন ছিল। স্বাভাবিকের তুলনায় উষ্ণ শীতকাল হওয়াতে ইউরোপের বাসা-বাড়িতে ব্যবহার্য প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য খুব কম থাকতে সহযোগিতা করেছে। এতে ইউরোপে রাশিয়া তেল-গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিলেও জ্বালানি সংকটে ক্ষতি ছিল সীমিত। অবশ্য জ্বালানির মূল্য এত বেশি ছিল যে জ্বালানি নির্ভর রুশ অর্থনীতি নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ফুলে ফেঁপে উঠেছে।
পিটারসন ইন্সটিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকস-এর প্রেসিডেন্ট অ্যাডাম পোসেন বলেন, যুদ্ধ একটি মনুষ্য বিপর্যয়। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতিতে এর প্রভাব ধাক্কা সামলাচ্ছে।
তবু যুদ্ধের ফলে ছোট ও বড় দুর্ভোগ দেখা দিচ্ছে। যেমন- ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়া সেনা জড়ো করা আগের চেয়ে তিনগুণ বেশি।
দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির ওয়ালডুরেন এলাকায় একটি বাণিজ্যিক লন্ড্রি পরিচালনা করেন স্ভেন পার। ১২টি ভারী মেশিন চালান তিনি। এগুলো প্রতিদিন ৮ টন কাপড় ধুতে পারে। গত বছর তার গ্যাসের বিল এসেছে ১ লাখ ৭৬ হাজার। আগের বছর ছিল ৩২ হাজার ইউরো।
পার বলেন, এই মূল্য আমরা ক্রেতাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছি। এখন পর্যন্ত বিল দেখিয়ে ক্রেতাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত মূল্য আদায় করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ক্রেতারাও ভালো নেই। অতিরিক্ত মূল্য তাদেরকে আদায় করতে হচ্ছে তাদের ক্রেতার কাছ থেকে।
তার নিয়মিত ক্রেতা থাকলেও এখন ব্যবসা কমেছে আগের তুলনায়। কম ক্রেতা আসে এমন রেস্তোরাঁগুলোর টেবিলক্লথ ধুইতে হয় কম। ফেব্রুয়ারিতে অনেক হোটেল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে কমেছে বিছানার চাদরের সংখ্যাও।
খাদ্যদ্রবের লাঘামহীন মূল্যবৃদ্ধির ফলে নির্দিষ্টভাবে দরিদ্রদের দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে বেশি। যুদ্ধের ফলে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে গম, বার্লির সরবরাহ কমেছে। বিশেষ করে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার কিছু দেশের প্রধান সরবরাহকারী ছিল দেশ দুটি। এর ফলে এসব অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ সার সরবরাহকারীও রাশিয়া।
যদিও জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় গত বছর কৃষ্ণ সাগর দিয়ে চুক্তির আওতায় ইউক্রেন থেকে কিছু খাদ্যশস্য রফতানি হয়েছে। কিন্তু এই চুক্তিটি আগামী মাসে নবায়ন করতে হবে।
রাশিয়ার সার রফতানি কমে যাওয়াতে কৃষকরাও সংকটে পড়েছেন। ছবি: এপিরাশিয়ার সার রফতানি কমে যাওয়াতে কৃষকরাও সংকটে পড়েছেন। ছবি: এপি
বিশ্বের শীর্ষ গম আমদানিকারক দেশ মিসরের বাসিন্দা রাবি জুলাই মাসে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে আরেকটি কাজ শুরু করেছেন। তবুও তিনি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। মাসে তার আয় ১৭০ ডলারের কম।
রাবি বলেছেন, মাসে তিনি একবার মাংস রান্না করেন। সস্তায় হাড়গোড় কিনে সন্তানের আমিষের ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু এখনও এমন কিছু পাওয়াও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
সরকার মিসরীয়দের আহ্বান জানিয়েছে, আমিষের ঘাটতি পূরণে মুরগির পা ও পাখা খাবার হিসেবে গ্রহণের জন্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এমন পরামর্শ ঘুরছে। কিন্তু এর ফলে এসবেরও চাহিদা বেড়ে গেছে।
রাবির কথায়, এমনকি মুরগি পায়ের দাম অনেক বেশি।
রাশিয়ার অন্যতম শীর্ষ গম আমদানিকারক নাইজেরিয়ায় গত বছর গড়ে খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। গমের ঘাটতির কারণে কিছু কিছু স্থানে রুটির দাম হয়েছে দ্বিগুণ।
একটি ময়দা কোম্পানির পরিচালক আলেক্সান্ডার ভেহরেস বলেন, মানুষকে অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। কোন খাবার তারা কিনবে? খাবারে ব্যয় করবে না সন্তানদের স্কুলে নাকি চিকিৎসায়?
নাইজেরিয়ার রাজধানী আবুজাতে অন্তত ৪০ শতাংশ বেকারি বন্ধ হয়ে গেছে ময়দার দাম ২০০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার পর।
বেকারি সংঘের চেয়ারম্যান মানসুর উমর বলেন, যেসব এখনও চালু আছে সেগুলোও বন্ধের দ্বারপ্রান্তে, মুনাফা একেবারে নেই বলেলেই চলে। অনেক মানুষ রুটি খাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছেন। দাম বাড়ার কারণে তারা বিকল্পের দিকে ঝুঁকছেন।
স্পেনে সার কিনতে কৃষকদের সহযোগিতা করার জন্য ৩২০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর দেশটিতে সারের দাম বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।
মাদ্রিদের পূর্বে আনচুয়েলো গ্রামের এক কৃষক হোসে সানজেচ বলেন, এখানকার জমির জন্য সার গুরুত্বপূর্ণ। জমির যদি খাবার না থাকে তাহলে ফসল বেড়ে উঠবে না।
এসব কিছুর অর্থ হলো বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্থর গতি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৩ সালের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়েছে। ২০২২ সালে ১ ট্রিলিয়ন মূল্যের উৎপাদন কমেছে।
ব্যাংকিং জায়ান্ট সিটি-এ প্রধান বৈশ্বিক অর্থনীতিবিদ নাথান শিটস বলেন, জ্বালানির মূল্য কমে যাওয়ার পরও উল্লেখযোগ্য নিম্নমুখীতা রয়েছে ইউরোপে এবং মহাদেশটি মন্দার ঝুঁকিতে রয়েছে।
আইএমএফ বলছে, গত বছর ধনী দেশগুলোতে খুচরো মূল্য বেড়েছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২২ সালের জানুয়ারির পূর্বাভাস ছিল ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। দরিদ্র দেশগুলোতে যুদ্ধের আগে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ পূর্বাভাস থাকলেও তা বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রে এমন মূল্যস্ফীতি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
ইন্ডিয়ানার নভেলভাইলের দ্য লাক্সারি পারগোলার সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্ট্যাসি এলমোর বলেছেন, গত বছরে আট শ্রমিকের স্বাস্থ্য বিমার ব্যয় বেড়েছে ৩৯ শতাংশ। শ্রমিক স্বল্পতার সময়ে তাকে ঘণ্টা প্রতি মজুরিও বাড়াতে হয়েছে। মূল্যস্ফীতি বেশি থাকায় আমরা আমাদের পণ্যের আবেদন বিস্তৃত করেছি। সাধারণ মানুষ যাতে কিনতে পারে সেজন্য সব কিছু সহজ করা হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার অনেক দোকানি জানেন যে, মূল্যবৃদ্ধির কারণে ইতোমধ্যে হিমশিম খাওয়া ক্রেতাদের কাছে উচ্চমূল্যে পণ্য বিক্রি করা যাবে না। এর ফলে তারা বিভিন্ন পণ্য ভাগ করে বিক্রি করছেন।
৫২ বছরের মুকরনি বলেন, এক কেজি চালকে আট ভাগ করা হত কিন্তু এখন ১০ ভাগ করা হচ্ছে। দাম বেশি হলে ক্রেতারা দোকানে আসে না।
তিনি বলেন, আমরা শান্তি চাই। কারণ, শেষ পর্যন্ত কেউ পরাজিত বা জয়ী হবে না, কারণ সবাই ভুক্তভোগী হবে।