লিটন ঘোষ বাপি: জমিদার বাড়ি কথাটা শুনলেই কেমন যেন রত্নভান্ডার, গুপ্তধন, পাইক-পেয়াদা, নায়েব, উজির, হাতি ঘোড়া এসব কিছু চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যদিও এখন এগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই বললেই চলে, কালের বিবর্তনে হয়ে গেছে এক ইতিহাস।
জমিদার রায় বাহাদুর হরিচরণ চৌধুরী ১৮০০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে একচল্লিশ কক্ষের তিনতলা বিশিষ্ট এল প্যার্টানের বিশাল এই বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিশালতার কারণে এই জমিদার বাড়িতে প্রথমবার ঢুকলে কোন দিকে বহির্গমন পথ তা বোঝা বেশ কষ্টদায়ক ছিল। চন্দন কাঠের খাট-পালঙ্ক, শাল, সেগুন, লৌহ কাষ্ঠের দরজা-জানালা ও বর্গাদি, লোহার কড়ি, ১০ ইঞ্চি পুরু চুন-সুরকির ছাঁদ, ভিতরে কক্ষে কক্ষে গদি তোষক, কার্পেট বিছানো মেঝে, এককথায় জমিদার পরিবেশ। যেখানে যেমনটি হওয়া দরকার তার কোন ঘাটতি ছিল না এখানে।
জমিদার হরিচরণ রায় বাহাদুর একাধারে সুশিক্ষিত, প্রজারঞ্জক, দানশীল সমাজসেবী, বিদ্যোৎসাহী এবং স্বাধীনচেতা জমিদার ছিলেন। পিতার নাম প্রিয়নাথ চৌধুরী এবং মাতা নিস্তারিনী দেবী। কিভাবে, কি কারণে তারা এই ভাটি অঞ্চলে এসেছিলেন তার কোন সঠিক নজির পাওয়া যায় না। তবে বর্ধমানের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে আকবর পুত্র জাহাঙ্গীর ধরে নিয়ে গেলে এবং রাজধানী মুর্শিদাবাদে আটক করলে ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র বহুবর্ণের হিন্দুরা বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে গঙ্গার পূর্বপারে দক্ষিণাবর্তে পান্ডব বর্জিত দেশে এসে সুন্দরবন পরগনার বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন ।
রাজা প্রতাপাদিত্যের পরে হরিচরণ রায় বাহাদুর ছিলেন প্রভাবশালী ও বিত্তশালী জমিদার। তাঁর উদ্যোগে শ্যামনগরে তথা সমগ্র সাতক্ষীরায় অনেক জনহিতকর কাজ হয়েছিল। তাঁর সময়ে খনিত হয় অনেক জলাশয়। নির্মিত হয় অনেক রাস্তাঘাট, রোপিত হয় অনেক বৃক্ষ। অনেক জমিদারের মতো হরিচরণ রায় শুধু সম্পদ ও বিলাসে মত্ত না থেকে চেষ্টা করেছিলেন এলাকার মানুষকে শিক্ষিত করতে। তাঁর প্রত্যক্ষ সাহায্যে ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল নকিপুর হরিচরণ পাইলট উ”চ বিদ্যালয়।
১৯৫৪ সালে জমিদার পরিবার এখান থেকে স্ব- পরিবারে ভারতে চলে যায় (অন্য একটি ডকুমেন্টে দেখা যায় ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় জমিদার স্ব-পরিবারে কোলকাতা চলে যান)। রায় বাহাদুরের এই জমিদার বাড়ির একটি অলৌকিক কাহিনী রয়েছে। জমিদার হরিচরনের মাতা নিস্তারিণী প্রায় সময় স্বপ্নে বস্তা বস্তা টাকা বা গুপ্তধন পেতেন। সেই টাকা দিয়ে হরিচরণ কিনেছিলেন ১৪ টি চৌহদ্দি, এক চৌহদ্দি সমান দুই থেকে আড়াই হাজার বিঘা, সুর্যাস্ত আইনে এসব জমি কেনা হতো। আইনটি হল নিলামে ওঠার টাকা সুর্যাস্তের আগে যে পরিশোধ করতে পারতো চৌহদ্দি তাঁর হয়ে যেত। প্রজাদের উৎপাদিত ধান রাখার জন্য জমিদার বাড়ির সামনে ছিল ৪০০ টি গোলা, এই জমিদার এতোটাই ধনী ছিলেন যে তিনি তার মাকে ঘুমাতে মানা করতেন, যেন তিনি আর টাকার স্বপ্ন না দেখেন!
অতি জরাজীর্ণ অবস্থায় আজও কালের স্বাক্ষর বয়ে নিয়ে চলেছে ঐতিহাসিক রায় বাহাদুর বাবু হরিচরণ চৌধুরীর নান্দনিক জমিদার বাড়িটি।