সাতনদী অনলাইন ডেস্ক: পড়াশোনা শেষে স্বাবলম্বী হয়ে পরিবারের হাল ধরার স্বপ্ন দেখছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী জিন্নাত আরা। সেই লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। হতে চেয়েছিলেন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি শুরু করেছিলেন অনলাইন ভিত্তিক হ্যান্ড পেইন্টের কাজ। গড়ে তুলেছিলেন ‘হেমন্ত’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানও। তবে সেই স্বপ্ন হঠাৎ থমকে গেল। যাকে ঘিরে তার আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন, সেই প্রিয় মা ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত। শুরু হয় জিন্নাত আরার জীবনের নতুন সংগ্রাম।
এখন পর্যন্ত তিনি মা’কে বাঁচাতে রীতিমতো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যেই প্রায় ২০ লাখেরও বেশি টাকা খরচ হয়েছে। যা নিম্ন্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য যেন মহাসাগর পাড়ি দেয়ার মতো। ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় তার পরিবারে এক মহাদুর্যোগ নেমে এসেছে। তবুও টিকে থাকার লড়াইয়ে জিন্নাত আরা অকুতোভয় হয়ে নিজেকে চিরতরে সপে দিয়েছেন মায়ের জন্য। সাংসারিক টানাপড়েনের মধ্যেই মায়ের ওষুধ, পুষ্টিকর খাবার, ফলমূল ইত্যাদি সাধ্যমতো যোগাড় করছেন। জিন্নাত আরা অবশ্য ইতিমধ্যেই নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তাছাড়া এই অসময়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছেন বন্ধুমহলসহ আরো অনেকে। জিন্নাত আরা রাজশাহী সদরের বাসিন্দা। এই যুদ্ধরত অবস্থায় নিজের ব্যবসাটাকেও ধরে রেখেছেন তিনি। ব্যবসার পরিধি বাড়াতে আরো জোরালোভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি নিজের তৈরি পণ্য বিক্রি করতে রাজধানীর মিরপুরে এক মেলায় অংশ নিয়েছেন।
জিন্নাত আরা জানান, তার মা সুফিয়া বেগমের (৫৪) ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়ে গত বছরের জানুয়ারিতে। খরচের কথা চিন্তা করে তার ভাই এবং বাবা দেশেই মায়ের চিকিৎসা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু দেশে ব্রেস্ট ক্যান্সারের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা ভেবে, সাহস করে উন্নত চিকিৎসার জন্য মা’কে নিয়ে যান কলকাতায়। জিন্নাত আরা বলেন, একরকম যুদ্ধ করে একাই সিদ্ধান্ত নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য মা’কে নিয়ে কলকাতা রওনা হই। নিউটাউন টাটা মেডিকেল সেন্টারে মায়ের চিকিৎসা শুরু হয়। ভালো দিকটা ছিল যে, সেকেন্ড স্টেজেই মায়ের ব্রেস্ট ক্যান্সার শনাক্ত করা গেছে। আর খারাপ দিকটা হলো, মায়ের ডায়াবেটিস ছিল। তারপর অনেক ধরনের পরীক্ষার পর সফলভাবে মায়ের সার্জারি সম্পন্ন হয় গত বছরের ২৩শে মার্চ।
কলকাতায় মায়ের চিকিৎসার অভিজ্ঞতা নিয়ে জিন্নাত আরা বলেন, মা’কে নিয়ে একা একা কলকাতায় ৪৫ দিনের জার্নিটা আমার কাছে যুদ্ধের মতো ছিল। এরমধ্যেই আবার করোনা মহামারি শুরু হলো। এরপর দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। পথে যশোরে আটকা পড়লাম প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের নামে অনিশ্চিত গ্যাঁড়াকলে। সেখানেও বেশ কয়েকদিন যুদ্ধ করে বাড়ি ফিরলাম। দেশে ফিরে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই টাটা মেডিকেল থেকে সাজেস্ট করে দেয়া অনকোলজিস্ট ড. রোকনুজ্জামানের কাছে বাকি চিকিৎসার জন্য ২ মাসের জন্য ঢাকায় বাসা ভাড়া নিই। সেখানে ২১টি রেডিওথেরাপি সম্পন্ন হয় অনেক যুদ্ধ করে। কেন না, মহামারির মধ্যে করোনা টেস্ট, হাসপাতালে এন্ট্রি, ডাক্তারের সাক্ষাৎ পাওয়া, প্রতিদিন ঝুঁকিপূর্ণ যাতায়াত, ওষুধের অপ্রাপ্যতা ইত্যাদি নিয়ে বেশ ঝক্কি ছিল। তারপর রাজশাহী ফিরে আসি।
জিন্নাত আরা জানান, কলকাতা থেকেই মায়ের হরমোনাল থেরাপি ট্যাবলেট চলছে, যা আগামী ৫ বছর চলবে। আর কেমোথেরাপি শুরু হয় গত অক্টোবর থেকে। ৬ মাস পরপর মোট ৬টি কেমোথেরাপি দিতে হবে। ২য় কেমোথেরাপি আগামী ৩রা এপ্রিলে দিতে হবে। আমরা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। মায়ের চিকিৎসার শুরু হয় নিজেদের সামান্য কিছু সেভিংস দিয়ে। তারপর লোন, পাবলিক ফান্ডিং, পার্সোনাল ফান্ডিং ইত্যাদি। যেহেতু করোনা পরিস্থিতির জন্য পরে আর কলকাতায় যেতে পারিনি। তাই আমাদের দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যেই করতে হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ২০ লাখ টাকারও বেশি খরচ হয়ে গেছে। আগামীতে আরো অনেক প্রয়োজন। সাংসারিক টানাপড়েনের মধ্যেই মায়ের জন্য ওষুধ, পুষ্টিকর খাবার, ফলমূল ইত্যাদি নিয়ে যাচ্ছি সাধ্যমতো। কারো কারো সাহায্যও পাচ্ছি। এখন নিজের ব্যবসাটাকে আরো জোরালোভাবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি, যেন পরিবারকে সাপোর্ট দিতে পারি।
অশ্রুসিক্ত জিন্নাত আরা বলেন, মা’কে নিয়ে কলকাতায় চলে যাওয়ার জন্য অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিতে পারিনি। তাই এক বছর পিছিয়ে গেলাম। তাতে কোনো আফসোস নেই। কিন্তু মায়ের পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই। কারণ মায়ের ডাইবেটিসের সমস্যা আছে। তবে যতদিন বেঁচে আছেন তার শারীরিক যন্ত্রণা কমিয়ে রাখার ব্যবস্থা আছে। সেই চেষ্টা আমার সাধ্যমতো অব্যাহত রেখেছি। বাকিটা আল্লাহ্র ইচ্ছা। সবাই দোয়া করবেন যেন লড়াইটা শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারি। যদিও ভেঙে পড়ি মাঝে-মধ্যে। তবে আবার সামলে উঠি মায়ের চিন্তা করে।
জিন্নাত আরাকে সহযোগিতা করতে চাইলে এই নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন। ০১৯১১-৮৩৭৫৬১ (বিকাশ পার্সোনাল)।