নিজস্ব প্রতিবেদক: সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরে গত ৫ দিন ধরে চলা অচলাবস্থা পুরোপুরি নিরসন হয়নি। ডাবল লেবার বিল সমস্যার কারনে বন্দরের মালামাল লোড-আনলোড বন্ধ হয়। এতে করে কর্মহীন হয়ে পড়ে শ্রমিকরা, মালামাল আনলোডের অপেক্ষায় দিনের পর দিন সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে থাকে পণ্যবোঝাই শত শত ট্রাক, নষ্ট হতে থাকে পচনশীল পণ্য, ভোমরা ছেড়ে অন্য বন্দরমুখী হতে থাকে ব্যবসায়ীরা আর প্রতিদিন সরকার হারাতে থাকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। আমদানী রপ্তানীকারক এ্যাসোসিয়েশন, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান, লেবার শ্রমিক সমবায় সমিতির দাবী দাওয়া নিষ্পত্তি না হওয়া ও বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্লিপ্ততায় দীর্ঘায়িত হতে থাকে এই অচলাবস্থা। এ অচলাবস্থা নিরসনে ডিসি কার্যালয়ে সভা হলেও পুরোপুরি সচল হয়নি বন্দরের কার্যক্রম।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ১ এপ্রিল থেকে বন্দরে ডাবল লেবার বিল কার্যকর করা হবে মর্মে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে গত ৩ মার্চ এক চিঠির মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের জানানো হয়। এটি চালু হলে একদিকে ট্রাক প্রতি ১০ হাজার টাকারও বেশি লেবার সংক্রান্ত ব্যয় হতে পারে বলে ধারনা করতে থাকে ব্যবসায়ীরা। বিষয়টি নিয়ে ক্ষেত্র বিশেষ লাভ লোকসানেরও হিসেব কষতে থাকে শ্রমিক সংগঠনের নের্তৃবৃন্দ সহ সাধারণ শ্রমিকরা। তাই বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ী ও শ্রমিক সহ বন্দর সংশ্লিষ্টদের মাঝে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা ও মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
এই ডাবল লেবার বিল কার্যকর করার লক্ষ্যে গত ২৩ মার্চ তারিখে বাংলাদেশ স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষের সচীবের উপস্থিতিতে একটি কার্যকরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় আপাতত এ আদেশ চালু না করার জন্য অনুরোধ জানান ব্যবসায়ীরা। তাছাড়া সিএন্ডএফ এজেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও লিখিতভাবে অনুরোধ জানানো হয়। ব্যবসায়ীরা জানান, উক্ত অনুরোধ সত্ত্বেও কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে বন্দরের উপ-পরিচালক সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্যরা হীন স্বার্থে উক্ত ডাবল বিল প্রথা চালু করতে সচেষ্ট হন। এতে করে ব্যবসায়ীদের মাঝে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
তারা বলেন, প্রতিটি ভারতীয় ট্রাক ছাড় করানোর জন্য সরকারী চালানের মাধ্যমে লেবার বিল ও রাজস্ব একইসাথে পরিশোধ করতে হয়। অন্যদিকে লেবারদের বিল পরিশোধ করে থাকেন সরকার নিযুক্ত লেবার ঠিকাদার। মাস শেষে ঠিকাদার সরকারের কাছ থেকে নির্ধারিত বিল তুলে নেন। অথচ পণ্য খালাসের সময় আবারও লেবারদের বিল দিতে হয়। অর্থাৎ একই পণ্য দু’বার লোড-আনলোড বিল দিতে হয়। ফলে আমদানী খরচ বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা বিরাট ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। আর এ কারনে গত বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) থেকে পণ্য খালাসের জন্য লেবারদের বকশিসের নামে মুজুরি দেয়া বন্দ করে দেয়া হয়।
অপরদিকে শ্রমিক নেতারা বলেন, এতাদিন ট্রাক প্রতি ৫/৬শ’ টাকা করে সরাসরি মুজুরী দিতো ব্যবসায়ীরা। আমদানিকারক সরাসরি মুজুরী না দিলে একজন শ্রমিক সারাদিনে যা মুজুরী পান তা দিয়ে তাতে তার সংসার চলে না। এই মুজুরীর টাকা বন্ধ করে দেয়াতে শ্রমিকেরা কাজ বন্ধ করে দেয়।
ভোমরা সিএন্ডএফ এজেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলেন, পণ্য খালাসে টন প্রতি প্রায় ৭০ টাকা মুজুরী দিতে হয়। এর সাথে লেবারদের বকশিসের নামে বাড়তি মুজুরীর টাকা দেয়া ব্যবসায়ীদের পক্ষে সম্ভব নয় বিধায় নিজস্ব উদ্যোগে লেবার ডাকা বন্ধ করে দেয়া হয়। তারা আপত্তি জানিয়ে বলেন, আমরা আনলোডিং চার্জ দিয়ে থাকে, আবার কেন লোডিং চার্জ কেন দিব এ নিয়ে গত ৫ দিন ধরে বন্দরে সৃষ্টি হয় চলাবস্থা।
কাজ বন্ধের বিষয়ে শ্রমিকরা বলেন, নিজেদের দাবী পূরন না হওয়ায় তারা শুয়ে বসে অলস সময় পার করছে। তারা জানায়, এক দিন পর পর কাজ পাই, সে হিসেবে মাসে ১৫ দিন কাজ পাই। প্রতিদিন মুজুরী পাই ৩০০ টাকা। অর্থাৎ মাসে ৪৫০০ টাকা আয় হয়। তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই আমরা মুজুরী বেশী পাওয়ার দাবীতে কর্মবিরতি পালন করি।
উপরোক্ত কারনে ভোমরা বন্দরে পণ্য খালাসে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়ে প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক। আর এই ৫ দিনে সরকার প্রায় ১৫ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার।
এদিকে ভোমরা স্থল বন্দরের এই অচলাবস্থা সম্পর্কে এক শ্রমিক নেতা বলেন, বন্দর কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের অনিয়মের কারনে ব্যবসায়ীদের সাথে ঝামেলা হওয়ায় তারা শ্রমিকদের কাজে না ডাকায় ৪টি সংগঠনের প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে।
অপরদিকে স্থলবন্দর আমদানী ও রপ্তানীকারক এ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলেন, পণ্য খালাসের জন্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আমাদের লেবার সরবরাহ না করে বন্দরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজসে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে থাকে। আর আমরা বাইরের লেবার দিয়ে ট্রাক প্রতি দু’হাজার টাকা দিয়ে পণ্য খালাস করে থাকি। অর্থাৎ আমরা দু’বার লেবার বিল দিতে বাধ্য হচ্ছি। এভাবে তো আর চলতে পারে না। এর একটা সুরাহা হওয়া দরকার।
এদিকে বন্দরের নানা অনিয়ম ও অচলাবস্থা দূর করা সহ বিভিন্ন দাবীতে গত রবিবার সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করে ভোমরা স্থল বন্দর আমদানী ও রপ্তানীকারক এ্যাসোসিয়েশন। সাতক্ষীরার সম্ভাবনাময় এই বন্দরকে রক্ষায় বন্দরের কাজে গতিশীলতা আনতে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে প্রশাসন ও বন্দর সংশ্লিষ্ঠ উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন ভূক্তভোগীরা।
এদিন দুপুরের পর ভোমরা বন্দরে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, শ্রমিক নেতা সহ বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা হয়। সভায় বন্দরে খালাসের জন্য অপেক্ষমান ট্রাকের পচনশীল পণ্য পেয়াজ, আদা জাতীয় পন্য) সমুহ খালাসের ব্যবস্থা করার জন্য সিদ্ধান্ত হলে কিছু পন্য খালাস হয়। কিন্তু তাতে সামগ্রীক সমস্যার সমাধান হয়নি।
এদিকে বন্দরের অচলাবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে মঙ্গলবার বন্দরের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে ভোমরা বন্দর সিএন্ডএফ এজেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান নাসিম দৈনিক সাতনদীকে জানান, প্রতি টন পণ্য খালাসের জন্য চালানের মাধ্যমে ৬৯.২০ টাকা সরকারকে দেয়া হয়ে থাকে। সভায় ডাবল লেবার বিল সংক্রান্ত বিষয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়ের সচীব মহোদয়ের পরামর্শে একটি সমাধান প্রস্তাব দেয়া হয়। প্রস্তাবে বলা হয় এখন থেকে ৬৯.২০ টাকার অর্ধেক সরকারকে দেয়া হবে এবং বাকী অর্ধেক ঠিকাদারকে দেয়া হবে। সভায় উপস্থিত সকল পক্ষ প্রস্তাবটি মেনে নেয়। এ প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে বন্দরে সৃষ্ট চলমান অচলাবস্থার নিরসন হবে বলে সকলেই আশাবাদী হন। কিন্তু এ বিষয়ে লিখিত কোন কাগজ না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা তা পুরোপুরি মেনে না নিতে পারায় বন্দরের অচলাবস্থা পুরোপুরি নিরসন হচ্ছে না বলে তিনি (নাসিম) অভিমত ব্যক্ত করেন। বন্দরের চলমান অচলবস্থা সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, গত ৫ দিনের অচলবস্থা আংশিক সচল হলেও এখনো পুরোপুরি সচল বলা যাবে না।
এদিকে ভোমরা শুল্ক স্টেশন সূত্রে জানা যায়, এখানে প্রতিদিন গড়ে ৩ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়ে থাকে। সে হিসেবে গত ৫ দিনে প্রায় ১৫ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। তাই দ্রুতই বিষয়টির পুরোপুরি সমাধান হওয়া দরকার বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।