প্রিন্ট এর তারিখঃ মে ১২, ২০২৫, ৬:২৯ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ এপ্রিল ১০, ২০২২, ১১:৪৬ পূর্বাহ্ণ
ভোমরা বন্দরের বিপরীতে চলছে কোটি টাকা চাঁদাবাজি
আহাদুর রহমান (জনি): দিনে ৫০ থেকে ৭০ লক্ষ টাকা চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছে ভোমরা স্থল বন্দরের ব্যবসায়ীরা। ওপারের ঘোজাডাংগায় সিরিয়ালের নামে চাঁদা আদায়কারীদের সাথে এপারের রাঘব বোয়ালরাও জড়িত। নতুন করে চাঁদাবাজি শুরু হওয়ায় তা বন্ধের জন্য ওপারের সংশ্লিষ্টদের কাছে পত্র প্রেরন করা হয়েছে।
২০২১ সালের জুলাই থেকে পার্কিং চার্জের নামে সিরিয়াল বাইপাসের এ চাঁদা আদায় শুরু হয়। এভাবে ছ’মাস চলার পর হাঁপিয়ে ওঠেন আমদানিকারকরা। এরই মধ্যে ভোমরা সিএন্ডএফ এজেন্টস্ এসোসিয়েশনের আহবায়ক কমিটি গঠন হয়। মূলত তাদেরই উদ্যোগে এ চাঁদাবাজির প্রথম প্রতিবাদ হয়। ভোমরা স্থল বন্দরের ৮টি সংগঠনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক এ চাঁদাবাজি বন্ধে দীর্ঘ আলোচনার পর চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি ভোমরা সিএন্ডএফ এজেন্টস্ এর পক্ষ থেকে কর্মসূচী ঘোষিত হয়। ২৭ জানুয়ারি থেকে কর্ম বিরতি চলতে থাকে। ২৯ জানুয়ারি সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ২ ঘন্টা কর্মবিরতি ও মানবন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। পরে ভোমরা ও ঘোজাডাঙ্গা স্থল বন্দরের সিএন্ডএফ এজেন্টস্ এসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ দফায় দফায় সীমান্তের জিরো পয়েন্টে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসেন। সর্বশেষ ১২ ফেব্রুয়ারির আলোচনায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে সিরিয়াল ভেঙে কোন ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করলে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর নজরে বিষয়টি আসলে তার আদেশে বন্ধ হয় ঘোজাডাঙ্গায় চাঁদাবাজি। কিন্তু মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে আবারও শুরু হয়ে যায় সিরিয়াল বাইপাসের এ চাঁদাবাজি। এপার ও ওপার বাংলার সমন্বিত আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেটের কাছে হার মানে সকল নির্দেশনা। এদিকে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে আমদানি করায় ক্ষতির মুখে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। ভোমরা বন্দর বিমুখও হচ্ছেন কেউ কেউ। আমদানির অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করার ফলে দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতিও থামানো যাচ্ছেনা। অন্যদিকে স্থবির হয়ে আছে উন্নয়ন কর্মকান্ড।
ঘোজাডাঙ্গায় বে-পরোয়া চাঁদাবাজি বন্ধে একাধিকবার এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ হলেও অদৃশ্য কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি। আন্দোলনে যেয়ে আবারও নিষ্ক্রীয় হওয়ায় ভোমরা সিএন্ডএফ এজেন্টস্ এসোসিয়েশনের ভ‚মিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। চাঁদাবাজি বন্ধে ভোমরা স্থলবন্দর সংশ্লিষ্ট বৈধ আটটি সংগঠন উদ্যোগ নিলেও প্রশাসন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের রক্তচক্ষুর কাছে তা স্তিমিত হয়ে পড়ে। তবে চাঁদাবাজি বন্ধে ভোমরা কাস্টমস্ ক্লিয়ারিং এন্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস্ এসোসিয়েশনের বর্তমান আহবায়ক কমিটির চারজন সদস্য যুক্ত স্বাক্ষরে ঘোজাডাঙ্গা সিএন্ডএফ এজেন্ট (ই) কার্গো ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক বরাবর একটি চিঠি দেয় মার্চ মাসের ৩১ তারিখ।
ভোমরা কাস্টমস্ ক্লিয়ারিং এন্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস্ এসোসিয়েশনের ‘সিএন্ডএফএ/ভো/এডহক/১০১’ নং স্মারকে ঘোজাডাঙ্গা সিএন্ডএফ এজেন্ট (ই) কার্গো ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরারবর চিঠিতে বলা হয়, ‘বিগত যৌথ সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক আগামী ০২/০৪/২০২২খ্রিঃ রোজ-শনিবার থেকে সিরিয়াল বর্হিভ‚ত কোন পন্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করবে না। সিরিয়াল বহির্ভ‚ত কোন পন্যবাহী ট্রাক পাওয়া গেলে পূর্বের যৌথ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবং ভোমরা ইমপোটারস্ এসোসিয়েশনের প্রেরিত পত্র স্মারক নং- বিআইএ/২০২১/০১৮ তরিখ: ১২/০২/২০২২খ্রিঃ অনুসারে ট্রাক প্রতি ৪০ হাজার টাকা হিসাবে জরিমানা আদায় করা হবে। এরপরও যদি সিরিয়াল বহিভর্‚ত ভারতীয় পন্যবাহী ট্রাক প্রবেশ বন্ধ না হয় তাহলে সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দের অবহিত পূর্বক পুনঃরায় আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করতে বাধ্য হইবো।’ পত্রটিতে দু’দেশের ব্যবসায়ীক সু-সম্পর্ক বজায় রাখতে সিরিয়াল ছাড়া পন্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ না করার জন্য বিশেষ ভাবে অনুরোধ করা হয়। তারপরও বদলায়নি এ অচলাবস্থার চিত্র। বন্দরের দুই পারের সিএন্ডএফ নেতাদের সর্বসম্মতিতে যে জরিমানার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেটিতেও বাধ সাধছে প্রশাসন। ফলে চলতি মাসে একদিন বন্ধ হলেও যথারীতি চলতে থাকে চাঁদাবাজি।
মোটা অংকের অর্থ কামিয়ে নেওয়ার নেশায় মাসখানেক বন্ধ থাকার পর মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে আবারও শুরু হয় ভারত থেকে ভোমরা বন্দরে প্রবেশের সিরিয়াল ব্রেক ডাউনের চাঁদাবাজি। আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট সিরিয়াল ভেঙে পন্যের ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করায়। স্বাভাবিক সিরিয়াল দিয়ে একটি পাথরের ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করতে বর্তমানে সময় লাগে ৫০ থেকে ৬০দিন। সেখানে মাত্র এক দিনেই ট্রাক পারাপার করা যায় আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেটের মুরিদ হলে। এমনি এমনি পারাপার হওয়া যায়না। সিন্ডিকেটটিকে পাথরের ট্রাক প্রতি ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকা চাঁদার হাদিয়া দিলেই একদিনের মধ্যেই সীমান্ত পারাপার করতে পারে। শুধু পাথরই নয় একইভাবে তুলা, গম ও গমের ভ‚ষির ট্রাক প্রতি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা অতিরিক্ত দিতে হয় সিন্ডিকেটটিকে। মাত্র ক’দিন আগেই পেয়াজের ট্রাক প্রতি ১৭ হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হয়েছে সিন্ডিকেটটিকে। অন্যদিকে ঘোজাডাঙ্গার নিয়ম অনুসারে কোন ট্রাক আনলোড না করলে প্রতিদিনের জন্য অতিরিক্ত এক হাজার টাকা করে মাশুল দিতে হয়। তাই চাঁদা না দিলে পার্কিং সিরিয়ালের নামে কৌশলে ৫০-৬০ দিন ট্রাক আটকে রাখা হয়। এতদিন আটকে থাকায় প্রতিদিন ১হাজার টাকা করে সেই ৫০-৬০হাজার টাকা মাশুল দিতে হয়। পন্য দ্রুত আনলোড করতে ও ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে অনেকটা বাধ্য হয়েই ভোমরা স্থল বন্দরের আমদানিকারকদের চাঁদা দিতে হচ্ছে। ঘোজাডাঙ্গা-ভোমরা বন্দর দিয়ে প্রতিদিনি গড়ে ৪০০টি ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর মধ্যে ৫০ থেকে ৬০টি ট্রাক স্বাভাবিক সিরিয়ালে প্রবেশ করলেও সাড়ে ৩০০টি ট্রাক সিরিয়াল বাইপাস করে সিন্ডিকেটকে চাঁদা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ফলে স্বাভাবিক সিরিয়ালের গাড়িগুলো বাংলাদেশে প্রবেশে ৩০ থেকে ৬০ দিন সময় নিচ্ছে। ওপারে যদি এই চাঁদাবাজি না হতো তাহলে ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই ভোমরায় পাথরের ট্রাক প্রবেশ করতো।
নিত্যই চাঁদাবাজির ঘটনাটি ওপারের ঘোজাডাঙ্গায় ঘটলেও আখেরে লাভ হয় দুইপারেই। কারণ এই সিন্ডিকেটের রাঘব-বোয়াল আছে দুই পারেই। ঘোজাডাঙ্গা বন্দরে চাঁদাবাজির সুযোগ করে দেন বন্দরের প্রভাবশালী সিএন্ডএফ এজেন্ট নেতারা। তাদের সাথে জড়িত আছে বন্দর আধিকারিকদের কেউ কেউ। পার্কিং স্টেশন চার্জের নামে তোলা হয় বিপুল পরিমান অর্থ। তবে তারা একা ভোগ করেনা এ চার্জ। তারও ভাগ হয়। এপারের প্রভাবশালী সিএন্ডএফ এজন্টস ও প্রশাসনের একটি অংশও হাদিয়ার স্বাদ নেয়। এদিকে এপারের কিছু সংগঠনের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তারা সরাসরি অর্থ না নিলেও তাদের নিজেদের পন্যবাহী ট্রাক সিরিয়াল বিহীন পারাপার করে। সেই সংখ্যাটাও নেহায়েত কম নয়।
এই বেপরোয়া চাঁদাবাজি বন্ধে একাধিকবার উদ্যোগ গ্রহণ হলেও অদৃশ্য কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি। বিষয়টি নিয়ে ভোমরা স্থলবন্দর সংশ্লিষ্ট বৈধ আটটি সংগঠন উদ্যোগ নিলেও স্থানীয় প্রশাসন, রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের রক্তচক্ষুর কাছে তা স্তিমিত হয়ে পড়ে। আমদানিকারকদের আরো একটি সংগঠন চাঁদাবাজি বন্ধের উদ্যোগ নিলে সেই সংগঠনের নেতাকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়। তাদের বলা হয় যেভাবে চলছে সেভাবেই চলবে। চলতে বাধ্য করা হবে।
ভোমরা স্থল বন্দরে প্রধানত আমদানি করা হয় আঙ্গুর, আপেল, পিয়াজ, শুকনো মরিচ, চাল, গম, গমের ভ‚ষি, কাঁচা ভুট্টা, চায়না ক্লে, পাথর সহ প্রায় ৭৭টি পন্য তুলা, ফল, পাথরসহ বেশ কয়েকটি পন্য। এসব জরুরী পন্যে আরোপিত শুল্ক সহ বিভিন্ন খরচ পার করে যখন ভোক্তার হাতে পৌছায় তার দাম এমনিতেই বেড়ে যায়। তার উপর এই অতিরিক্ত চাঁদা দিয়ে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই নিত্য পন্যের দাম বেড়ে যায়।
বন্দরের এই অতিরিক্ত চাঁদা পরিশোধের প্রভাব পড়ছে যোগাযোগ খাতেও। কারণ ভোমরা বন্দর দিয়ে আমদানিকৃত পন্যের একটি বড় অংশ হলো পাথর। যা উন্নয়ন কর্মকান্ডের বিভিন্ন স্থাপনা ও রাস্তা তৈরির প্রধান কাঁচামাল। আর এ বিষয়টিকেই টার্গেট করে পাথর আমদানিতে নজর পড়ে চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটটির। পচনশীল পন্য না হওয়ায় কৌশলে মাসের পর মাস পাথরের ট্রাক আটকে রেখে আমদানিকারককে বাধ্য করা হয় চাঁদা দিতে। আর পাথরের ট্রাকের সিরিয়াল বাইপাসের চাঁদা সব থেকে বেশি। পাথরের ট্রাক প্রতি এ ক্ষেত্রে দিতে হয় ৫২ থেকে ৫৫ হাজার টাকা। বেশ কয়েকজন পাথর আমদানিকারক জানান, অনেকটা বাধ্য হয়ে পার্টি ধরে রাখার জন্য অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ট্রাক বাংলাদেশে ঢুকানো হয়। এদিকে গত মার্চের ১৭ তারিখে ঠিকাদারি মালামালের উর্ধ্বগতি ও টেন্ডারের মূল্য পুনঃনির্ধারনের দাবিতে সাতক্ষীরার তালায় মানববন্ধও হয়। একাধিক ঠিকাদার তাদের উন্নয়ন কাজ বন্ধ করে রেখেছেন শুধু মাত্র পাথরের অতিরিক্ত দামের জন্য।
তুঘলকি কান্ডের পরও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে। তবে এভাবে চলতে থাকলে বন্দরের আমদানিকারকরা বন্দর বিমুখ হবে। লোকসানের মুখে পড়বে ভোমরা স্থলবন্দর। রাজস্ব হারাবে সরকার। কাংখিত উন্নয়নও হবে স্থবির।
Copyright © 2025 দৈনিক সাতনদী. All rights reserved.